ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চাঞ্চল্যকর জরিনা হত্যা ॥ যেভাবে ধরা পড়ল দুর্বৃত্তরা

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৮ নভেম্বর ২০১৮

চাঞ্চল্যকর জরিনা হত্যা ॥ যেভাবে ধরা পড়ল দুর্বৃত্তরা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করে খুনীদের বাস ড্রাইভার, কন্ডাক্টর ও হেলপার সাজিয়ে বহুল আলোচিত জরিনা হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটানো হয়। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খুনীদের বাসেই বাড়ি পাঠানোর কথা বলে যাত্রী হিসেবে জরিনা বেগম ও তার বাবাকে তুলে দেয়া হয়েছিল, যাতে তারা বিষয়টি বুঝতে না পারেন। জরিনার বাবাকে মারধরের পর খুনীরা বাস থেকে নামিয়ে দেয়। আর নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যার পর জরিনার লাশ রাস্তার পাশে ফেলে দেয়, যাতে খুনীরা ‘ডাকাত’ বলে পুলিশ ও নিহতদের স্বজনরা মনে করেন। এর পর হত্যার পরিকল্পনাকারী ঘটনাটি ডাকাতি বলে চালিয়ে দিয়ে নিজেকে আড়াল করতে নিজেই বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। পারিবারিক কলহের জের ধরে এমন অভিনব পন্থায় বহুল আলোচিত জরিনা হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। হত্যার সঙ্গে জড়িত নিহত জরিনার মেয়ে জামাই, বেয়ান ও ঘটক পিবিআইর হাতে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। শনিবার পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার ধানম-ির প্রধান কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। তিনি জানান, জরিনা হত্যার ঘটনায় জরিনার জামাই নূর ইসলাম, শাশুড়ি আমেনা ও জরিনা এবং নুর ইসলামের বিয়ের ঘটক স্বপনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে জরিনা হত্যাকা-ের চাঞ্চল্যকর ঘটনা। ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার জানান, গত ৯ নবেম্বর রাতে আকবর আলী (৭০) নামের এক বৃদ্ধকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের আশুলিয়ার মরাগাং এলাকা থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। আকবর আলীর তথ্যমতে তার ঘণ্টাখানেক পরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের মরাগাং এলাকার পাশ থেকেই আকবর আলীর মেয়ে জরিনা বেগমের (৪৫) লাশ উদ্ধার করা হয়। আকবর আলী পুলিশকে তাৎক্ষণিকভাবে জানান, তাদের বাড়ি সিরাজগঞ্জের চৌহালী থানাধীন খাসকাওলী গ্রামে। তারা গত ৯ নবেম্বর জরিনার মেয়ে রেজিনার স্বামী নূর ইসলামের সাভারের আশুলিয়া থানাধীন গাজীরচট এলাকার মুন্সীবাড়িতে গিয়েছিলেন। ওই দিনই তারা কাজ সেরে বাড়ি যেতে চাইলে তাদের টাঙ্গাইলের একটি বাসে তুলে দেয় জরিনার মেয়ের জামাই। খানিকদূর যাওয়ার পর বাসের চালক, হেলপার, কন্ডাক্টর মোট চারজন মিলে তাকে বেধড়ক মারধর করে আশুলিয়ার মরাগাং এলাকার রাস্তার পাশে জোরপূর্বক ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয়। তার মেয়ে জরিনাকে নিয়ে বাসটি চলে যায়। পরে জরিনার লাশ উদ্ধার হয়। এমন ঘটনায় জরিনার মেয়ের জামাই নূর ইসলাম নিজেই বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় অজ্ঞাত খুনীদের আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। ঘটনাটি আলোচনায় এলে পিবিআই মামলাটির তদন্ত করে। তদন্তের এক পর্যায়ে বেরিয়ে আসে হত্যাকা-ের প্রকৃত রহস্য। জানা যায়, পাঁচ বছর আগে রেজিনার সঙ্গে বিয়ে হয় নূর ইসলামের। বিয়ের ঘটক ছিলেন গ্রেফতারকৃত স্বপন। স্বপন রেজিনাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয়। রেজিনার সঙ্গে তার স্বামীর বনিবনা হচ্ছিল না। প্রায়ই নানা বিষয়ে ঝগড়া হতো। ঝগড়া হলে রেজিনা তার মা নিহত জরিনা বেগমকে বিষয়টি জানাতেন। ইতোপূর্বে বহুবার জরিনা বেগম তার মেয়ে ও মেয়ের জামাইয়ের মধ্যে ঝগড়া মিটিয়েছেন। গত ৯ নবেম্বর এমনই পারিবারিক ঝগড়া মেটাতে জরিনা বেগম তার পিতা আকবর আলীকে সঙ্গে নিয়ে মেয়ে জামাইয়ের বাড়ি যান। বার বার জরিনা বেগম মেয়ে জামাইয়ের বাড়ি গিয়ে ঝগড়া মেটান, বিষয়টি রেজিনার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের পছন্দ ছিল না। বিশেষ করে গ্রেফতার রেজিনার শাশুড়ি আমেনা বেগম ও রেজিনার স্বামী নূর ইসলাম বিষয়টি একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। এজন্য তারা রেজিনার মাকে এমন শিক্ষা দিতে চান, যাতে আর কোনদিন রেজিনার মা আর তাদের বাড়িতে না আসেন। এমন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা বিয়ের ঘটক জরিনার দূর সম্পর্কের মামা স্বপনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। স্বপন মাত্র ১০ হাজার টাকায় একটি বাসসহ বাসটির এক চালক, দুই হেলপার এক কন্ডাক্টরকে ঠিক করেন। পরিকল্পনা মোতাবেক খালি বাসটি জরিনার শ্বশুরবাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। তারা দাঁড়িয়ে টাঙ্গাইল টাঙ্গাইল বলে যাত্রীদের ডাকতে থাকে। আর জরিনার স্বামী, শাশুড়ি, জরিনা বেগম ও শাশুড়ির পিতা আকবর আলীকে সেই বাসে তুলে দেয়। বাসে ওঠার পর পরই লোহার রড, লাঠিসোটা দিয়ে জরিনা ও তার পিতাকে বেধড়ক মারধর করতে থাকে। গুরুতর আহত অবস্থায় জরিনার পিতাকে মরাগাং এলাকায় নামিয়ে দেয়। আর জরিনাকে নিয়ে বাসটি চলে যায়। জরিনাকে বেধড়ক মারধর করে। মারধরের একপর্যায়ে জরিনাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে। হত্যার পর লাশ মরাগাং এলাকায়ই ফেলে দিয়ে বাসটি চলে যায়। পরিকল্পিত হত্যাকা-টি যাতে ডাকাতি বলে চালিয়ে দেয়া যায়, এজন্য হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনাকারী নিজেকে সন্দেহের আড়ালে রাখতে নিজেই বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। হত্যাকা-ে ব্যবহৃত ঢাকা-মেট্রো-জ-১১-১৭৯২ নম্বরের মিনিবাসটি জব্দ করা হয়েছে। তবে হত্যাকা-ে জড়িত চারজন পলাতক। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের অতিরিক্ত ডিআইজি মাইনুল হাসান, পিবিআই সদর দফতরের বিশেষ পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান আসাদ, পিবিআই ঢাকা মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ ও বশির আহমেদসহ উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×