ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নেতৃত্ব সংগঠনে জরিপ ॥ মানবিক বাংলাদেশের রাজনীতির এক নতুন মাত্রা

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ১৮ নভেম্বর ২০১৮

নেতৃত্ব সংগঠনে জরিপ ॥ মানবিক বাংলাদেশের রাজনীতির এক নতুন মাত্রা

বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নানা প্রতিবেদন ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর ৫ জুলাই সংসদীয় দলের বৈঠকে দেয়া বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, সভানেত্রী স্বয়ং তাঁর দলের নেতৃত্ব নির্ধারণে নানামুখী জরিপের আয়োজন করেছেন, মতামত গ্রহণ ও তথ্য সংগ্রহ করছেন ও সেসব জরিপে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত, ফলাফল ও পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী দলের আইন সভার প্রতিনিধি নির্বাচনসহ ভবিষ্যত নেতৃত্ব বাছাইয়ের কাজ করছেন। ১৫ নবেম্বর আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ডের সভা শেষে দলের সাধারণ সম্পাদক সংবাদ সম্মেলনে জানান যে, দেশী-বিদেশী বেশকিছু জরিপ হয়েছে যেগুলো তাঁরা বিশ্লেষণ করছেন ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই দলের মনোনয়ন চূড়ান্ত করবেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘নেতৃত্ব’ একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ’৭৫ পরবর্তীকালে এত বেশি বিভ্রান্তি ছড়িয়ে রাজনীতিকে ও একই সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসকে কলুষিত করার অপচেষ্টা হয়েছে; যার মূল উৎপাটন করে, গোটা দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নানা রকম বিভক্তি থেকে মুক্ত করে, একটি মৌলিক আদর্শের পথে (যা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়) টেনে আনার এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব আপনা থেকেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ওপরে এসে পড়েছে। এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী তাঁর নিজের দলকে সংগঠিত রাখাও হয়েছে প্রধান দায়িত্ব। ফলে একই সঙ্গে দেশের রাজনীতিতে আদর্শ প্রতিষ্ঠা বা আদর্শহীন রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা ও দলের রাজনৈতিক আদর্শ সমুন্নত রাখা যুগপৎ শেখ হাসিনাকে তাঁর নিজ কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে। ফলে সে লড়াইয়ে তাঁর পিতার মতো তাঁকেও পদে পদে মৃত্যুর ঝুঁকি বহন করে এগুতে হচ্ছে। এদেশের রাজনীতি এতটাই কলুষিত হয়েছে যে, শেখ হাসিনার মতো একজন নারী যিনি দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করছেন তাঁকে প্রকাশ্যে, নিষ্ঠুরভাবে হত্যার চেষ্টা হয়েছে একাধিকবার। এর কারণ আদর্শহীন রাজনীতি ও সে রাজনীতির যাঁরা ধারক তাঁদের সীমাবদ্ধতা। ভারতবর্ষে রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণের কাছাকাছি থেকে মত সংগ্রহ ও সমর্থন আদায়ের কাজ শুরু করে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময়। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সবাই মিলে একটি লক্ষ্য নিয়েই কাজ করেছে। যদিও সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ব্যক্তিত্বের সংঘাত ও ইংরেজদের চক্রান্ত ভারতীয় নেতৃত্বে নানারকম বিভক্তি এনেছে কিন্তু কেউই তাঁদের মূল আদর্শ ‘কুইট ইন্ডিয়া’ বা ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন থেকে বিচ্যুত হননি। স্বাধিকার আন্দোলনে জয়ী হয়ে এখন পর্যন্ত দুনিয়ার দেশে দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় শাসন পদ্ধতি হলো গণতন্ত্র বা সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে সরকার গঠন ও পরিচালনা করা। বাংলাদেশ একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে তার স্বাধীনতা অর্জন করেছে যার নেতৃত্ব দিয়েছে ’৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা দল আওয়ামী লীগ। সে সময়ে যারা পরাজিত হয়েছিল ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল তারা ’৭১ পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের মূল আদর্শকে নিজেদের আদর্শ হিসেবে মেনে না নিয়ে উল্টোপথে রাজনীতিকে নিয়ে যেতে সচেষ্ট ছিলÑ যার পরিণতিতে এরাই স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল নায়ক ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকেও হত্যা করতে সমর্থ হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর উদার মানবিক ও মহানুভব নেতৃত্বের গুণে সে সময়ে কোন কঠোর ও সহিংস রাজনীতি তাঁর দলে ও সরকারে ঠাঁই দেননি বলেই সে ষড়যন্ত্রের হত্যা সংঘটন সম্ভব হয়েছিল। এর পরের রাজনীতি বাংলাদেশকে একটি কলঙ্কজনক ইতিহাসের দিকে নিয়ে গেছে যার সমর্থনে নানারকম কুশীলবের সমাগম ছিল। বাংলাদেশকে তার মূল আদর্শ থেকে সরিয়ে নিয়ে এক আদর্শহীন, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাবিরোধী শক্তি তৈরির অপচেষ্টা হয়েছে। ইতিহাসের এ দায় থেকে দেশকে ও দেশের রাজনীতিকে মুক্ত রাখতে ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ছয় বছর জোর নির্বাসনে থাকার পর, যখন তার নিজের দলও নানা মত ও বিভক্তির মধ্যে হিমশিম অবস্থায় ছিল। ১৯৮১ থেকে ২০১৮, এই প্রতিকূল ৩৭ বছরে শেখ হাসিনা কি কি দায়িত্ব পালন করেছেন দেশের মানুষ তা প্রত্যক্ষ করেছেন, এমনকি প্রত্যক্ষ করেছেন আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরাও। সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন, এই দায়িত্ব পালন করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রাখা কখনই সম্ভব হতো না যদি না দলের আদর্শকে মিলিয়ে সামনে রেখে দেশের ’৭৫ পরবর্তী বিচ্যুত রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক আদর্শের বিপরীতে লড়াই করে তিনি জয়ী না হতেন। সে কৃতিত্ব শেখ হাসিনার ও তার দলের এতে কোনই সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরে? নিশ্চয়ই সেখানেই তৈরি হয়েছে জরিপের পটভূমি। বঙ্গবন্ধুর (জন্ম ১৯২০) রাজনৈতিক চর্চা ও সংগঠকের বয়স তাঁর কুড়ি বছর থেকে পরিপূর্ণ শুরু হয়েছে ধরে নিলে ’৭১ সাল পর্যন্ত হয় ৩১ বছর। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পরে দেশ পরিচালনা করেছেন সাড়ে তিন বছর। মোটামুটি ৩৫ বছরের সক্রিয় রাজনীতিক জীবন পাড়ি দিয়ে ১৯৭১ সালে তিনি যখন জাতির পিতার সম্মান অর্জন করেন তখন তাঁর বয়স ৫১। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী যখন দলের কঠিনতম দুঃসময়ে হাল ধরেন তখন তাঁর বয়স ৩৪ ও কোলে ১০ ও ৯ বছরের দুই শিশু। এই যে গত ৩৭ বছর একজন গৃহবধূ, দুই সন্তানের এক বাঙালী মা রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব নিলেন, আওয়ামী লীগের মতো একটি বিশাল দল পরিচালনা করে এই পর্যন্ত নিয়ে এলেন, সেখানে মোটা দাগে তাঁর বড় বড় অর্জন কি এই নিয়ে আমাদের চিন্তা করা দরকার। তখন আমরা দেখব তাঁর প্রথম এক দশকই কেটেছে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে, পরে দুই পর্বে দশ বছর গেছে জামায়াত-বিএনপির অপশাসন মোকাবেলায়, মাঝখানে জেল ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। মাঝের পাঁচ ও শেষের দশ বছর গেছে উন্নয়ন ও ডিজিটাল বাংলাদেশ পেরিয়ে একটি মানবিক বাংলাদেশের সূচনা তৈরি করতে। আর ওই তিন দশকে অন্তত কুড়িবার তাঁকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে কিন্তু অটল এই সাহসিনী কোনভাবেই তাঁর মাথা নত করেননি। প্রায় প্রতিটি হত্যাচেষ্টা থেকেই তিনি বেঁচে গেছেন প্রকৃতির অপার মায়ায় আর কর্মীদের রক্ষাকবচে। ফলে তাঁর জন্য যে ভালবাসা আজ এই দেশে বিকশিত হয়েছে তা তাঁর পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবেই শুধু নয়, স্বাধীনতার মূলমন্ত্রগুলো রক্ষার প্রধান সংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্যও। ফলে আজ শেখ হাসিনা যে প্রান্তে এসে পৌঁছেছেন ও দেশকে পৌঁছে দিয়েছেন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা তাঁর নেতৃত্বের সঠিক ও যোগ্য ধারাবাহিকতা দেখতে চাই। তিনি নাগরিকের সে আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশা অনুভব করেন তাঁর দূরদর্শী চোখ দিয়ে। পত্র-পত্রিকায় দেখছি তিনি বেশ ক’বছর ধরেই দলের তৃণমূলের বা প্রান্তিক পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ করছেন, সংশ্লিষ্ট এলাকার ভৌগোলিক ও উন্নয়ন চাহিদা নিরূপণ করছেন ও সে অনুযায়ী উন্নয়ন পরিকল্পনা করছেন। যাঁরা জানেন তাঁরা বিশ্বাস করেন, শেখ হাসিনা সারা বাংলাদেশের ইউনিয়ন পর্যায়ের এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গ্রাম পর্যায়ের উন্নয়ন কর্মকা- ও নেতৃত্বের খবর জানেন এবং রাখেন তাঁর পক্ষে হুটহাট উপায় অনুসরণ করে নেতৃত্ব বাছাই কেমন করে সম্ভব? তাই তিনি বিগত বছরগুলোতে নানারকম রীতি অনুসরণ করে কার্যকর গবেষণা পদ্ধতি অনুসরণ করেই দলের ভবিষ্যত নেতৃত্ব অনুসন্ধান করছেন। এই অনুসন্ধান জরিপ শুধু যে নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার লক্ষ্যে নয় তা এতদিনের পত্র-পত্রিকার খবর থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে ১৬ নবেম্বর বাংলা ট্রিবিউন এক প্রতিবেদনে লিখেছে, দলে কার কী অবদান, সাংগঠনিক তৎপরতা, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তার ও পরিবারের ভূমিকা, এক-এগারোর সময়ের ভূমিকা, নেতাকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক, জামায়াত-বিএনপির সঙ্গে যোগসাজশ আছে কিনা, জরিপগুলোতে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সঙ্গত কারণেই ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প বাস্তবায়নের প্রধান পথপ্রদর্শক শেখ হাসিনা একটি কার্যকর জ্ঞানসমাজ প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব দিতে সমর্থ জনসমাজের কাছে এ দাবি করতেই পারেন। তাঁর প্রতি আস্থা রাখতে ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে যার ফলে সম্ভব হবে সামষ্টিক নেতৃত্বে একটি আধুনিক বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুতি নেয়া। বিশেষ করে ২০২০ সালে মুজিববর্ষে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন ও ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালনে দেশে ও বিদেশে যেসব কর্মসূচী নিতে হবে সেসবের জন্য জ্ঞাননির্ভর একটি সামষ্টিক নেতৃত্ব শক্তির ভূমিকা হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বিশ্বাস করি, এই দুটি পর্বের আনুষ্ঠানিকতার দ্বিবার্ষিক আয়োজনগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের ঘুরিয়ে দেয়া পেছনের চাকা আবার সঠিক পথে চলার প্রেরণা দেবে। শেখ হাসিনা জানেন বাংলাদেশের তারুণ্য শক্তির নেতৃত্বে এখন ’৭৫ প্রজন্ম। যাদের মধ্যে ২০১৮ সালে ১৮-উর্ধ জনগোষ্ঠীর বয়স ২৫। আগামী ২৫ বছরের সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে এই প্রজন্মে যাদের শিখে নিতে হবে নেতৃত্বের ভাষা, শৈলী ও জেনে নিতে হবে গত ২৫ বছরে কি কি ঘটেছিল সেসবের সঠিক ইতিহাস। জেনে নিতে হবে বঙ্গবন্ধুকে, কেমন করে টুঙ্গিপাড়ার এক অখ্যাত গ্রামের দামাল ছেলে পৃথিবীর ইতিহাসে নাম লিখিয়ে দিলেন নিজের ও একটি নতুন স্বাধীন দেশের। জেনে নিতে হবে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পটভূমি ও সংগ্রামের ঘটনাগুলো। এখন এই সম্ভাবনাপূর্ণ নেতাদের কে কোথায় কি অবস্থায় আছেন তার সঠিক উপাত্ত না থাকলে তার পরিকল্পনা হবে কেমন করে? আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা নানারকম জরিপের মাধ্যমে এই সম্ভাবনা শক্তিকেই খুঁজে নিচ্ছেন, এটা আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে। সে শক্তির সম্মিলিত উদ্যোগ তাঁর দলকে আধুনিক ও সংগঠিত করে গড়ে তুলতে সমর্থ হবে এতে কোনই সন্দেহ নেই, কিন্তু এতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে শেখ হাসিনার মানবিক বাংলাদেশ। আর আইন সভার জন্য মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হয়ে কারা যাবেন সে যাচাই তিনি করে নিতেই পারেন সম্ভাব্য নেতৃত্বের শিক্ষা, দীক্ষা, অভিজ্ঞতা ও জাতীয় জীবনের নানা পরিস্থিতিতে তাঁদের ভূমিকা যাচাই করে। এতেও লাভবান হবে বাংলাদেশ। আর এ রকম গবেষণা প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব সংগঠনের প্রচেষ্টা বাংলাদেশের রাজনীতি চর্চায় যুক্ত করতে যাচ্ছে এক নতুন মাত্রা, যে খবর আমাদের আশান্বিত ও আশ্বস্ত করছে। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×