ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাণিজ্য যুদ্ধ প্রভাব ফেলতে পারে বাংলাদেশেও

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৮ নভেম্বর ২০১৮

বাণিজ্য যুদ্ধ প্রভাব ফেলতে পারে বাংলাদেশেও

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ চীন-মার্কিন বাণিজ্য যুদ্ধের হুমকি-পাল্টা হুমকি সাম্প্রতিকতম বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম আলোচিত বিষয়। পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে চীন হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্য দেশগুলো একে অপরের পণ্যের ওপর ট্যারিফ ও পাল্টা ট্যারিফ আরোপের ফলে যে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে তাতে বৈশ্বিক জিডিপি’র ০.৮১ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্ভাবনা রয়েছে দীর্ঘ বৈশ্বিক মন্দা। এর ফলে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোষাক রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। তবে বিশ্ব বাণিজ্য যুদ্ধে যে সঙ্কট সৃষ্টি হবে তা থেকে উত্তরণে মানব সম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানো এবং নীতিমালা সংস্কারের ওপর জোর দিতে হবে। শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট যৌথভাবে আয়োজিত ‘বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধ এবং বাংলাদেশে-এর প্রভাব’ শীর্ষক এক সেমিনার বক্তারা এসব বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শুভাশীষ বসু। বিশেষ অতিথি ছিলেন রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)’র ভাইস চেয়ারম্যান বিজয় ভট্টাচার্য। ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশন’র সিনিয়র ইকোনোমিস্ট ড. এম মাশরুর রিয়াজ, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান, ঢাকা চেম্বারের পরিচালক ও এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড’র ব্যবস্থপনা পরিচালক হুমায়ুন রশিদ নির্ধারিত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলী আহমেদ। প্রবন্ধে তিনি বলেন, চলতি বছরের যুক্তরাষ্ট্র প্রথম দফায় মার্চ মাসে চীনে উৎপাদিত স্টিল পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ ও এ্যালুমনিয়াম পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ হারে শুল্কারোপ করলে প্রতি উত্তরে চীন যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত পণ্যের বিভিন্ন পণ্যেও ওপর শুল্কারোপ করে, যার মূল্য ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি জানান, এ বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক জিডিপি’র ০.৮১% ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বৈশ্বিক মন্দা সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং সূতার দাম বৈশ্বিক বাজারে ১০% কমে যাওয়ায় আমাদের উদ্যোক্তাবৃন্দ কম খরচে তৈরি পোশাক উৎপাদনে সুযোগ পাবেন। বিদ্যমান অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তিনি বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনায় কৌশল নির্ধারণ, মানব সম্পদের দক্ষতা উন্নয়ন, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানো এবং নীতিমালা সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। শুভাশীষ বসু বলেন, সম্প্রতি শুরু হওয়া বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে সারা পৃথিবীজুড়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে, তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হবে না বলে, তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক চীনের রফতানিকৃত যেসব পণ্যের ওপর শুল্কারোপ করেছে, তার পরিমাণ প্রায় ২৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাণিজ্য সচিব বলেন, আমেরিকার দুটো চেম্বার কর্তৃক ইতোমধ্যে চীনের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, ৯৪% প্রতিষ্ঠান তাদের বিনিয়োগকে পুনরায় আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহী নয় এবং এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান সমূহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশকে প্রধান্য দিয়ে থাকবে। তিনি চীনের সানসেট ইন্ডাস্ট্রিকে স্থানান্তরের লক্ষ্যে বাংলাদেশকে উপযোগী গন্তব্য হিসেবে উপস্থাপনের জন্য বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন, মানব সম্পদের দক্ষতা বাড়ানো এবং তথ্য-প্রযুক্তি খাতের ওপর গুরুতারোপের বেসরকারীখাতের প্রতি আহ্বান জানান। কারণ তিনি মনে করেন, অতিদ্রুত এগুলোর বাস্তবায়ন সম্ভব হলে, আমরা আরও বেশি হারে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ সম্ভব হবে। তিনি বলেন, এলডিসি হতে বাংলাদেশের উত্তরণ পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকার ব্রিটেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যতানামা একজন অধ্যাপককে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যিনি ভিয়েতনামের এলডিসি পরবর্তী সময়ের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। বাণিজ্য সচিব বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও চামড়া খাতের উদ্যোক্তাদের আরও বেশি হারে প্রযুক্তি নির্ভর করখানা স্থাপনের আহ্বান জানান। তিনি আরও বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করা হলে আমাদের দেশের শিল্প-কারখানার কাঁচামালা আমদানি নির্ভর হওয়ার কারণে পুরো ব্যবসায়িক কার্যক্রমে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং এ থেকে আমাদের উত্তরণের জন্য উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর আরও বেশি হারে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন বলে, অভিমত ব্যক্ত করেন। এ বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের ‘বেকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি’-এর সম্ভাবনা আরও বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)’র ভাইস চেয়ারম্যান বিজয় ভট্টাচার্য বলেন, মূলত চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ব্যবধান কমানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি চীনের এ্যালুমেনিয়াম ও স্টল পণ্যের ওপর শুল্কারোপ করে, যার ফলে দুটো বৃহৎ রাষ্ট্রের মধ্যে সৃষ্ট বাণিজ্য যুদ্ধ হতে বাংলাদেশ কে সুবিধা নিতে হলে সরকার-বেসরকারী খাতের সমন্বয়ে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, ৮০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলোর চীনে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্তের পিছনে তৎকালীন সময়ে চীনের অবকাঠামো, দক্ষ মানব সম্পদ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্ভাবন প্রভৃতি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছিল এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে রয়েছে। তিনি বাংলাদেশর বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য শুধুমাত্র চীনের সানসেট ইন্ডাস্ট্রি (ঝঁহংবঃ ওহফঁংঃৎ)-এর ওপর নির্ভর না করে ‘ফিউচার ইন্ডাস্ট্রি’-এর আরও বেশি হারে গুরুত্বারোপ আহ্বান জানান। ডিসিসিআই’র পরিচালক হুমায়ুন রশিদ বলেন, বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রতিযোগিতার ফলে তেল ও ডলারের মূল্য বাড়ার সম্ভাবনা পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের উচ্চহারের ফলে ফলে আমাদের পণ্যের উৎপাদান খরচ বাড়বে এবং এর ফলে আমাদের ব্যবসায়ীদের বৈশ্বিক বাজারে সক্ষমতা হারাবে। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সদস্য ড. মোস্তফা আবিদ খান বলেন, বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে চীন হতে ইলেকট্রিকাল ও ইলেকট্রনিক্স খাতের কারখানা স্থানান্তরের সম্ভাবনা রয়েছে এবং এক্ষেত্রে ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়া অগ্রাধিকার পাবে, কারণ হিসেবে তিনি দুটো দেশের দক্ষ মানব সম্পদ, অবকাঠামো এবং প্রযুক্তির অগ্রগতিকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ভিয়েতনামের মোট রফতানির ৫২ শতাংশ আগে বৈদেশিক বিনিয়োগ হতে। তিনি বাংলাদেশের মানব সম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং উৎপাদিত পণ্যেও ‘রুলস অফ অরিজিন’ বিষয়ক জটিলতা নিরসনের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশন’র সিনিয়র ইকোনোমিস্ট ড. এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, বিদ্যমান অবস্থা হতে উত্তরণের জন্য আমাদের অবশ্যই স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। তিনি জানান, চীনের মোট রফতানির ৩০ শতাংশ অন্যান্য দেশ হতে আমদানির মাধ্যমে মিটিয়ে থাকে এবং এক্ষেত্রে চীনের রফতানি কমে গেলে আমাদের দেশের রফতানি কমার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে, তাই বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের অবশ্যই উৎপদান বাড়ানোর প্রতি আরও বেশি মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান। সেমিনারের স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসেব অনুযায়ী, বাণিজ্য যুদ্ধের আর্থিক প্রভাবের পরিমাণ প্রায় ৪৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এটি বৈশ্বিক জিডিপি’র প্রায় ০.৫ শতাংশ। তিনি বলেন, সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, বাংলাদেশ, লাওস এবং শ্রীলঙ্কা হতে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর চীন শুল্কারোপ করেছে। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বলেন, চীনের সানসেট ইন্ডাস্ট্রিকে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উৎকৃষ্ট স্থান হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এজন্য অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন, বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি এবং পরিকল্পিত বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর ঢাকা চেম্বারের সভাপতি গুরুত্বারোপ করেন।
×