ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুদূর মাদাগাস্কারের পাখি ‘লাভবার্ড’ ভালবাসার কথা কয়

প্রকাশিত: ০৫:২১, ১৯ নভেম্বর ২০১৮

 সুদূর মাদাগাস্কারের পাখি ‘লাভবার্ড’ ভালবাসার কথা কয়

স্টাফ রিপোর্টার, বগুড়া অফিস ॥ মায়াভরা ছোট্ট পাখি। বনের এই পাখি গাথা ভালবাসার মায়ায়। মানুষের বাড়িতেই এরা থাকে। তবে খাঁচাবন্দী। খাঁচায় বন্দী হলেও থাকে পারিবারিক বন্ধনে। তারপরও পাখি তো। ইচ্ছে হলেই আকাশে উড়াল দিতে পারে না। কোন্্ পাখি না চায় আকাশে উড়ে বেড়াতে। তবে এদের বৈশিষ্ট্য- মানুষের হৃদয় নিঙড়ানো ভালবাসা পেলে এবং এদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গান করলে, খেললে এরা এক স্বর্গীয় মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। এই ছোট্ট পাখিটির নাম ‘লাভ বার্ড’। বিদেশী বংশোদ্ভূত এই পাখি বাংলাদেশে পোষ মানিয়ে খাঁচায় রাখতে আইনী বাধা নেই। লাভ বার্ড- বাংলায় ভালবাসার পাখি। আদিনিবাস আফ্রিকা মহাদেশ। কখন, কিভাবে সুদূর মাদাগাস্কার থেকে এরা ভারতীয় উপমহাদেশে উড়ে এলো, নাকি কেউ ওদের নিয়ে এলো, তা স্পষ্ট নয়। কেউ লাভ বার্ডের জেন্ডার চিনে প্রজননের মাধ্যমে এদের বংশ বিস্তার ঘটিয়েছে। লাভ বার্ডের জেন্ডার (স্ত্রী-পুরুষ) চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। বাইরে থেকে কোন্ পাখিটি কোন্ সেক্সের (লিঙ্গ) তা বোঝা যায় না। ভারত ও থাইল্যান্ডে ডাঅক্সিরিবোনিউক্লিকএ্যাসিড (ডিএনএ) সেক্সিং প্রযুক্তিতে লাভ বার্ডের লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায়। বাংলাদেশের শৌখিন পাখিপ্রেমী ও পাখি ব্যবসায়ীরা লাভ বার্ডের লিঙ্গ নির্ধারণ করে আনত ভারত ও থাইল্যান্ড থেকে। এতে সময় ও খরচ বেশি। দিনে দিনে বাংলাদেশে পাখিকে পোষ মানিয়ে ঘরে পালনকারী শৌখিন পাখিপ্রেমীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। দেশের প্রতিটি স্থানে পাখি ব্যবসায়ীরা পসরা সাজিয়েছে। এরই মধ্যে সম্প্রতি চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ভেটেরিনারি এ্যান্ড এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ^বিদ্যালয়ের (সিভাসু) একদল গবেষক ডিএনএ সেক্সিং প্রকল্পের আওতায় লাভ বার্ডসহ বেশ কিছু বিদেশী পাখির লিঙ্গ নির্ধারণে সাফল্য পেয়েছেন। সূত্র জানিয়েণ্ডে দেশে ডিএনএ সেক্সিং প্রযুক্তি উদ্ভাবন এই প্রথম। সিভাসুর প্রধান গবেষক ছিলেন প্যাথলজি ও প্যারাসাইটোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শুভাগত দাস। তার সঙ্গে ছিলেন আরও ছয়জন। তারা বিদেশী পাখির রক্ত ও বুকের পালকের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে আধুনিক প্রযুক্তিতে মলিকুলার কম্পোজড, বডি সেল, ক্রোমোজম পরীক্ষা করে সব পাখির লিঙ্গ নির্ধারণে সক্ষম হন, যা এ দেশের গবেষণায় বড় সাফল্য। বিশে^ একমাত্র লাভ বার্ড ভালবাসা দিবসকে প্রতিনিধিত্ব করে। মাদাগাস্কারের এই পাখিকে বলা হয় স্বর্গের পাখি। টিয়া গোত্রের এই পাখির অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এরা জোড়ায় জোড়ায় থাকতে চায়। লাভ বার্ডের আটটি জাত আছে। কোনটি সবুজে হলদে লাল, কোনটির হলুদ পিঠ, বর্ণিল ঠোঁট, লম্বা লেজ। কোনটি মেরুন রঙের ঠোঁট, হলুদ রঙের বুক। দৃষ্টিনন্দন এই পাখি সহজেই নজর কেড়ে নিতে পারে। এরা ৪ থেকে ৭ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা। ছোট হলেও খুব পরিশ্রমী। শীতের চেয়ে উষ্ণতা এদের বেশি পছন্দ। এই পাখি খুবই সামাজিক। খাঁচায় এরা একাকী থাকতে পারে না। সব সময় সঙ্গী খোঁজে। খাবারের মধ্যে লাভ বার্ডের বেশি পছন্দ আম, আঙুর, পেঁপে, সবজি। এরা যে বাড়িতে পোষ মানে সে বাড়ির লোকজন ছাড়া নতুন কাউকে দেখলে প্রথমে ভয় পায়। তারপর ধীরে ধীরে ভাব করলে লাজুক তার প্রেম বিলিয়ে সঙ্গে ভাব বিনিময় করে। একবার ভাব হলে ভাবের মানুষকে দেখতে চায়। দেরি করে দেখলে এরা অভিমানে লুকোচুরি খেলে। তারপর চুপি চুপি ডাকে। ইশারা দেয়। ছন্দে নেচেও ওঠে। এক সময় সুর তুলে যে ভাবের সৃষ্টি করবে তা দেখে মনে হবে যেন স্বর্গ নেমে এসেছে ভুবনে। যে একবার লাভ বার্ডকে পোষ মানাতে পেরেছে সে কখনও ভুলতে পারবে না। বগুড়ার সূত্রাপুর এলাকার পাখি ব্যবসায়ী মীর এনায়েত আলী জানালেন, প্রকৃতিগতভাবেই স্ত্রী ও পুরুষ পাখি বাইরে থেকে একই রকম। দেশী কিছু পাখির আচরণ দেখে আঁচ করা যা কোন্টি কোন্ লিঙ্গের। স্ত্রী ও পুরুষ লিঙ্গের পাখির প্রজননে বংশ বিস্তার হয়। বিদেশী পাখি যেমন লাভ বার্ড, বাজেরিগা, কাকাটাইল, সালকুলুর, লরি, ফিন্স, জাভা, ইন্ডিয়ান রিং নেক, গ্রে প্যারোট ইত্যাদির লিঙ্গ চেনা খুবই কঠিন। এতদিন দেশে ডিএনএ সেক্সিং প্রযুক্তির উদ্ভাবন না হওয়ায় শৌখিন পাখিপ্রেমী ও পাখি ব্যবসায়ীরা এসব পাখির রক্ত ও বুকের পালক বিশেষ ব্যবস্থায় বিদেশে পাঠিয়ে লিঙ্গ নির্ধারণ করে আনত। এখন দেশেই ডিএনএ সেক্সিং প্রযুক্তির উদ্ভাবনে লিঙ্গ নির্ধারণ সহজ হবে। আনাম বললেন, আগে বিদেশ ও দেশের বিভিন্ন স্থানের পাখির বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পাখি কিনে আনতেন। লিঙ্গ না চেনায় প্রজননের মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা যেত না। এখন সেই সুবিধা পাওয়া যাবে। বিদেশ থেকে বেশি দামে আর পাখি কিনতে হবে না। দশ বছর ধরে পাখি বেচাকেনা করছেন বেলাল। বললেণ্ড লাভ বার্ড দেখে তিনি কিছুটা চিনতে পারেন কোন্টি স্ত্রী ও কোন্টি পুরুষ। গভীরভাবে এদের ঠোঁটের রং দেখে কিছুটা আঁচ করা যায়। তিনি একজোড়া লাভ বার্ড বিক্রি করেন ৫ থেকে ৬ হাজার টাকায়। অন্যান্য বিদেশী পাখি বিক্রি করেন ৫শ’ থেকে দুই হাজার টাকায়। বার্ড ব্রিডার্স এ্যাসোসিয়েশনের একটি সূত্র জানায়, দেশে শৌখিন পাখিপ্রেমী ও খামারির সংখ্যা অন্তত ৭ লাখ। এ সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। তারা বিদেশী পাখি পোষ মানিয়ে পালন করে। বগুড়ার গোহাইল রোডের ধারে, চারমাথা এলাকায়, শিবগঞ্জে বিদেশী পাখি বেচাকেনা হচ্ছে। যারা ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকেন তাদের অনেকেই বিদেশী পাখি পালন করছেন। লাভ বার্ড দিনে দিনে পাখিপ্রেমীদের মনের দুয়ারে প্রবেশ করছে।
×