শাহীন রহমান ॥ জোট, মহাজোটের ভোটে সরগরম এবারের নির্বাচনী পরিবেশ। ইসি নিবন্ধিত অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই এবার জোটগত নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। জোটের নিবন্ধন নেই এমন রাজনৈতিক দলগুলোও এবার বিভিন্ন জোট-মহাজোটে ভিড়ে নির্বাচনে লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। চলছে শেষ মুহূর্তে জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে দরকষাকষি। হিসাবে দেখা গেছে অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে এবারের নির্বাচনে জোটগত অংশগ্রহণের সংখ্যা অনেক বেশি। ইসিতে দেয়া তালিকায় অনুযায়ী এবারে ৩৯ রাজনৈতিক দলের দুই-তৃতীয়ংশ রাজনৈতিক দলগুলোই এবার জোটগত নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।
আগামী ৩০ ডিসেম্বর হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সব রাজনৈতিক দলই এবার নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক পরিবেশও হয়ে উঠছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। উৎসবমুখর পরিবেশে বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা মনোনয়নর ফরম সংগ্রহ ও জমা দিয়েছেন। এখন কোন আসনে কোন প্রার্থীকে বা জোট শরিকদের দিলে, জেতার সম্ভাবনা বেশি বিষযটি নিয়েই হিসাব-নিকাশ চলছে। দলগুলোর পক্ষ থেকে আলাদা এবং জোটের পক্ষ থেকে ইসিতে চিঠি দিয়ে জোটবদ্ধ নির্বাচনের বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। জোটবদ্ধভাবে অংশ নেয়ায় এবারের নির্বাচনও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলে উল্লেখ করেছেন নির্বাচন কমিশনার বি.জে অব. শাহাদত হোসেন চৌধুরী।
নির্বাচন সামনে রেখে সব রাজনৈতিক দল দলীয় মনোনয়নপত্র এখন যাচাই-বাছাই করছেন। দু’একদিনের মধ্যে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হবে। নিজ দলের প্রার্থী চূড়ান্তের পাশাপাশি জোটের প্রার্থীদের মনোনয়নের বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। বিশেষ করে কোন আসনে কাকে দিলে পাস করার সম্ভবনা বেশি, কোন আসনে কোন দলের প্রভাব বা গুরুত্ব বেশি রয়েছে প্রার্থী মনোনয়নে এটাও বিবেচনা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনে দলগুলো হারতে চায় না। সবাই ক্ষমতায় আসতে চায়। এ কারণেই নির্বাচনে এবারের জোটের গুরুত্ব বেশি পাচ্ছে। কারণ দলীয় সরকারে অধীনে এবারই প্রথম সব দল অংশ নিচ্ছে। বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট অবশ্য বলছে আন্দোলনে অংশ হিসেবে এবারের তারা নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে এবার জোটে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সংখ্যা বাড়লেও জোটের এই হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে আরও অনেক আগ থেকেই। গত ২০০১ সালের নির্বাচনে জোটগত নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। এরপর থেকে যত নির্বাচনই হয়েছে জোটের প্রাধান্যই বেশি ছিল। ১৯৯১ সালে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী সব দল নির্বাচনে অংশ নিলেও দলগুলো আলাদাভাবে অংশগ্রহণ করে। ফলে কোন দলই সরকার গঠনের জন্য একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। জামায়াতের সমর্থন নিয়ে ’৯১ সালে সরকার গঠন করে বিএনপি। এরপর ’৯৬ সালে জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের দুটি নির্বাচনে আলাদাভাবে অংশ নেয়ায় কোন দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কিন্তু ২০০১ সালে এবং ২০০৮ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে প্রথমে বিএনপি এবং পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ২০০১ সালে বিএনপি চার দলীয় জোট করে নির্বাচন করে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ মজহাজোটের মাধ্যমে নির্বাচন করে বিএনপির চেয়ে বিপুল সংখ্যগরিষ্ঠতা পায়। সেই থেকে দলগুলোর মধ্যে জোটগত নির্বাচনে ধারণায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। দেশের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে জোটভাবে। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকার সময় দেশে জোটগত নির্বাচনের সূচনা হয়। তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন হলেও এরশাদের পতনের পর দলগুলো আলাদা আলাদা নির্বাচনে অংশ নেয় দলগুলো। ফলে তারা একক সফলতা দেখাতে পারেনি। বিশেজ্ঞরা বলছেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর থেকে দেশে জোটগত নির্বাচনের গুরুত্ব আরও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০১১ সালে গিয়ে চারদলীয় জোট ১৮ দলীয় জোটের রূপ লাভ করে। পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২০ দলীয় জোটে। দশম সংসদ নির্বাচনকে সামন্যে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণায় নির্বাচনে পরিবেশের চিত্র পাল্টে গেছে। একাদশ নির্বাচনকে সামন্যে রেখে ২০ দলীয় জোট এখন ২৩ দলীয় জোটে পরিণত হয়েছে। এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের পাশাপাশি এরশাদের সঙ্গে মহাজোট করে নির্বাচনে অংশ। ২০১৪ সালে প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় তা একতরফা নির্বাচনে পরিণত হয়। ওই নির্বাচনেরও আওয়ামী ১৪ দলীয় জোটের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করে।
এবার সব দল নির্বাচনে অংশ নেয়ার নির্বাচনে পরিবেশ যেমন পাল্টে গেছে। দলগুলোর মধ্যে জোটগত নির্বাচনে প্রবণতা বাড়ছে। তবে এবারের এত বেশি সংখ্যক রাজনৈতিক দলের জোটের মাধ্যমে নির্বাচনে নেয়ার ঘটনা আগে ঘটেনি। অবশ্য নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দেয়ার আগে বিএনপি নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে অনড় ছিল। পরে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, নির্বাচনকে তারা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এদিকে জোটের মাধ্যমে অংশ নেয়ার কারণে নির্বাচনকে সামন্যে রেখে ছোট রাজনৈতিক দলের গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলগুলোও নির্বাচনে অংশ নিতে বড় দুই দলের জোটের শরিক হয়েছে। বাইরে জোটের থাকা দলগুলো ভেতরে ভেতরে লবিং শুরু করেছে জোটের নির্বাচনে অংশ নিতে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলীয় জোট সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়াও আওয়মী লীগ জাতীয় পার্টির এবং যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে মহাজোটের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রক্রিয়াও এখন চূড়ান্ত হওয়ার পথে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে বৃহত্তর জোটের মাধ্যমে আওয়মী লীগ এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। আওয়ামী লীগের এই জোটের নিবন্ধিত দল যেমন রয়েছে। তেমনি অনিবন্ধিত দলগুলো এই জোটের শরিক হয়েছে। তবে নিবন্ধন আছে এমন ১০টি দল নৌকা প্রতীকে অংশ নিচ্ছে এবার। তবে আওয়ামী জোটের শরিক জাতীয় পার্টি তাদের লাঙ্গল প্রতীকেই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব রুহুল আমি হাওলাদার। অপরদিকে বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন জোট প্রতীক নির্ধারণের বিষয়ে ইসির কাছে সময়ের আবেদন জানিয়েছেন।
এর পাশাপাশি বিএনপি, ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে জোট করে এবারে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এছাড়াও নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটকেও সম্প্রসারণ করে ২৩ দলীয় জোটে পরিণত করা হয়েছে। বিএনপি জোট এবং ঐক্যফ্রন্টের যাদের নিবন্ধন রয়েছে তারা এবার ধানের শীষে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত ইসিকে জানিয়ে দিয়েছে। বিএনপিসহ মোট ১১টি রাজনৈতিক দল এবার ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছে।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, নিবন্ধিত ৩৯ দলের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ রাজনৈতিক দল জোটের নির্বাচনের রয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১০ রাজনৈতিক দল ছাড়া এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় জোটের তিনটি দলের, বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টের ১১ রাজনৈতিক দল, সিপিবির নেতৃত্বে বাম জোটের তিনটি দল এবং বি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের চারটি দলের নিবন্ধন কমিশনে রয়েছে। তবে নিবন্ধিত এসব দলের বাইরের অনেক রাজনৈতিক দল রয়েছে যারা এসব জোটের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। ইসি জানিয়েছে, শুধু নিবন্ধিত দলে প্রার্থীরা কে কোন জোটে বা প্রতীকে অংশ নেবে তা ইসিকে জানাতে হবে। অনিবন্ধিত দলের কেউ কোন জোট বা দলের অংশ নিলে তার দেখার দায়িত্ব ইসির নয়। অনিবন্ধিত দলের কেউ অন্য দলের প্রার্থী হলে ইসি তাকে সংশ্লিষ্ট দলের প্রার্থী বলেই গণ্য করবে।
গত ৮ নবেম্বর একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর আবেদনের প্রেক্ষিতে ১২ নবেম্বর পুনর্তফসিলে নির্বাচনের তারিখ ৩০ ডিসেম্বর করা হয়েছে। নির্ধারিত এই তারিখের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করার যাবতীয় প্রস্তুতি এখন ইসিতে। পুনর্তফসিল অনুযায়ী জোট ও প্রতীকে নির্বাচনের জন্য ইসির ১৫ নবেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দেয়। শেষ দিনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে জোট ভোটের বিষয়ে ইসিতে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। ইসি সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন জোটের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে জোটবদ্ধ নির্বাচনের বিষয়ে ইসিতে অবহিত করেছে। আবার দলগুলো আলাদাভাবেও চিঠি দিয়ে কে কোন জোটে এবং প্রতীকে নির্বাচন করবেন তাও জানিয়েছে। ইসির কাছে দেয়া তালিকা অনুযায়ী অধিকাংশ দলই এবার জোটভুক্ত হয়ে অংশ নিচ্ছে।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জোটের বাইরে যেসব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল রয়েছে তারাও মতাদর্শগত কারণে এই দুই জোটের বাইরে নয়। কোন না কোনভাবে তাদের সমর্থন এই দুই জোটকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা বলেন, এবারের নির্বাচনের পেক্ষাপট অন্যবারের তুলনায় ভিন্ন। অতীতে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। সামরিক শাসনের অধীনে নির্বাচন হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালিত হয়েছে কিন্তু এবারই প্রথম সরকার, সংসদ বহাল থেকে নির্বাচন হচ্ছে। যেখানে সব দল নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। ফলে এবারের নির্বাচন হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, সরকার সংসদ রেখে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও সেই নির্বাচনে সব দল অংশ নেয়নি। ফলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল না।
আইন অনুযায়ী নিবন্ধিত কোন রাজনৈতিক দল দলীয়ভাবে যেমন নির্বাচন অংশ নিতে পারবে। আবার অন্য দলের সঙ্গে জোট করেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। আবার জোটের শরিকদের প্রতীকেও যে কোন দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। এক্ষেত্রে তফসিল ঘোষণার তিনদিনের মধ্যে কমিশনকে চিঠি দিয়ে অবহিত করার বিধান রয়েছে। পুনর্তফসিলের পর ১৫ নবেম্বর অধিকাংশ রাজনৈতিক দল কমিশনকে চিঠি দিয়ে নির্বাচনে তাদের অবস্থানের কথা জানিয়েছে দিয়েছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: