ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘তারেকের ভিডিও কনফারেন্স শাস্তিযোগ্য অপরাধ’

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৯ নভেম্বর ২০১৮

 ‘তারেকের ভিডিও কনফারেন্স শাস্তিযোগ্য অপরাধ’

শংকর কুমার দে ॥ হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির পার্লামেন্টারি বোর্ডে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেছেন যাবজ্জীবন দন্ডপ্রাপ্ত লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এটা আদালত অবমাননার শামিল ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন উচ্চ আদালতের আইনজীবী ও আইন বিশেষজ্ঞগণ। তিন মামলায় দ-িত তারেক রহমান কিভাবে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাতকার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে প্রশ্ন রেখেছেন সড়ক, যোগাযোগ ও সেতুমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে নির্বাচন কমিশনার মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেছেন, আইনে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আইনের দৃষ্টিতে পলাতক থাকা অবস্থায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কোন ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি সব ধরনের গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মোঃ সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রুলসহ অন্তবর্তীকালীন এ আদেশ দেন ২০১৫ সালের ৭ জানুয়ারি। একই সঙ্গে তারেক রহমানের বিদেশে অবস্থানের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানাতে পররাষ্ট্র সচিবকে নির্দেশ দেয় আদালত। তারেক রহমানের পাসপোর্টের মেয়াদ বিষয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) একটি প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেয়া হয় ওই আদেশে। রুলে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রকাশ ও প্রচার নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেন বিবাদীদের নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। তথ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, পররাষ্ট্র সচিব, আইজিপি, বিটিভির মহাপরিচালক, বিটিআরসির চেয়ারম্যান, একুশে টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদক ও তারেক রহমানসহ বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়, যা ওই আদেশ এখনও বলবত। বাংলাদেশের ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তারেক রহমানের দেয়া বক্তব্য তুলে ধরে তা প্রচারে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আইনজীবী নাসরিন সিদ্দিকী লিনার পক্ষে আইনজীবী সানজিদা খানম রিটটি করেন। আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন, সাহারা খাতুন, শ ম রেজাউল করিম, এস এম মুনীর ও সানজিদা খানম শুনানি করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ রায়। শুনানি শেষে আদালত আদেশ দেন। পরে শ ম রেজাউল করিম বলেন, পত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অনলাইনে তারেক রহমানের কোন ধরনের বক্তব্য প্রকাশ ও প্রচার করা যাবে না। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দুই দুর্নীতি মামলার সাজায় গত ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবন্দী। তার অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হয়েছেন তার ছেলে তারেক রহমান। দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছর এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা-মামলায় যাবজ্জীবন সাজার রায় মাথায় নিয়ে গত এক দশক ধরে তিনি আছেন লন্ডনে। লন্ডনে অবস্থান করেই রবিবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির পার্লামেন্টারি বোর্ডের প্রার্থী চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় অংশ নেন তারেক রহমান। ভিডিও কনফারেন্সে তারেক রহমান ॥ রবিবার সকালে ঢাকার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর বিভাগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের এই সাক্ষাতকার শুরু হয়। রংপুর বিভাগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাতকারের মধ্য দিয়ে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করে বিএনপির পার্লামেন্টারি বোর্ড। বিএনপির পার্লামেন্টারি বোর্ডের সামনে মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থীদের লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই সাক্ষাতকারে যোগ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সাক্ষাতকার দিয়ে ফেরা কয়েকজন মনোনয়ন প্রত্যাশী। রবিবার সকাল সোয়া ৯টা থেকে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগ্রহীদের সাক্ষাতকার গ্রহণ শুরু হলে তাদের সাক্ষাতকার নেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও। লন্ডন থেকে স্কাইপির মাধ্যমে মনোনয়ন বোর্ডে যুক্ত হন তিনি। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করেন বিএনপির পার্লামেন্টারি বোর্ডের সদস্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মওদুদ আহমদ, জমির উদ্দিন সরকার, মাহবুবুর রহমান, রফিকুল ইসলাম মিয়া, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই বোর্ডের আরেক সদস্য স্থায়ী কমিটির নেতা মির্জা আব্বাস অনুপস্থিত ছিলেন। সাক্ষাতকার দিয়ে বেরিয়ে আসার পর একজন মনোনয়ন প্রত্যাশী সাংবাদিকদের বলেন, তারেক রহমান ভিডিও কনফারেন্সে বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন। তার কছে জানতে চেয়েছেন এলাকায় দলের সাংগঠনিক অবস্থা কেমন? বিএনপির দফতরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রংপুর বিভাগে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার ৩৩টি সংসদীয় আসনের জন্য আড়াই শ’ প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পেতে সাক্ষাতকার দিচ্ছেন। এই সাক্ষাতকারের কারণে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ের সামনের সড়কের মোড়ে পুলিশের ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের ফরম জমার রশিদ নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। তাদের কর্মী সমর্থক নিয়ে আসতে নিষেধ করা হলেও অনেকেই ১০-১২ জনকে সঙ্গে করে নিয়ে আসার ফলে ব্যাপক লোকজনের ভিড় হয়, যা পুলিশকে সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়। আইনে থাকলে ব্যবস্থা নিবে ইসি ॥ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও দ-প্রাপ্ত আসামি তারেক রহমান ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে নির্বাচন কমিশনার মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেছেন, আইনে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে ইসি। রবিবার রাজধানীর নির্বাচন ভবনে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে এমন মন্তব্য করেন তিনি। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দলের মনোনয়নপত্রের তালিকা যাচাই-বাছাই করছেন। একজন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি এটা করতে পারেন কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, আপনারা বলেছেন আমরা শুনেছি। আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোন কিছু মনিটরিংয়ের নিজস্ব ক্যাপাসিটি নাই। যদি কেউ তথ্য-প্রমাণসহ আমাদের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেন তাহলে আমরা আইনের মধ্যে যদি কিছু থাকে, তাহলে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষকে বলব। তিনি বলেন, আর যদি আইনের ভেতর কিছু না থাকে তাহলে আমরা নিজেরা বসে কী করতে পারি, সেটা পর্যালোচনা করে দেখে তারপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। তারেক রহমান যদি দেশে থাকতেন তাহলে তিনি ভিডিও কনফারেন্স করতে পারতেন কি? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদি কেউ দন্ডপ্রাপ্ত আসামি হন, তাহলে অবশ্যই তাকে জেলে বা পলাতক থাকার কথা। কেউ জেলে থাকলে এ ধরনের কাজ করার কথা নয়। জেল থেকে যদি উনি জামিনে আসতেন, তাহলে করলে কোন অসুবিধা ছিল না। কিন্তু ক্ষেত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আইনের কাভারেজে কতটুকু কী আছে সেগুলো দেখে আমরা একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারব। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের প্রশ্ন ॥ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্ন করেছেন, দন্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমান নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন কিনা এবং তা খতিয়ে দেখতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। রবিবার সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনুরোধ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, তারেক রহমান একজন দ-িত অপরাধী। তিনি পলাতক। তিনি একটি দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে আছেন। তারেক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেন কিনা, তা বিবেচনা করার দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানান তিনি। নির্বাচন কমিশনকেও অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, তারেকের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া কতটা সঙ্গতিপূর্ণ, তা আপনারা খতিয়ে দেখবেন। আইন বিশেষজ্ঞরা যা বলেন ॥ সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক রবিবার দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, তারেক রহমান দন্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে হাইকোর্টের আদেশে তার বক্তব্য প্রচার ও প্রকাশ করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করলে তা আদালত অবমাননার শামিল ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখন কারও আদালত অবমাননার দরখাস্ত নিয়ে আদালতে যাওয়া উচিত। সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, তারেক রহমান দন্ডপ্রাপ্ত আসামি। হাইকোর্টের আদেশে তার বক্তব্য প্রচার ও প্রকাশ করার নিষেধাজ্ঞা বলবত আছে। হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে যদি তার বক্তব্য কেউ প্রচার ও প্রকাশ করে থাকে তা আদালত অবমাননার শামিল ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
×