ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস ॥ মাঠে নামতে হবে

প্রকাশিত: ০৬:৪৯, ১৯ নভেম্বর ২০১৮

 নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস ॥ মাঠে নামতে হবে

সোজাসাপটা কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তাই বলে দিয়েছেন সামনে কঠিন সময়। যে হারে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ভিড় তাতে এটা স্পষ্ট আদর্শের চাইতে এমপি হওয়াটাই এখন বড় কথা। সবাই কেন এমপি হতে চায়? এই নিয়ে সামাজিক বিশ্লেষণ জরুরী। তবে এটা আমরা সবাই বুঝি কি তার উদ্দেশ্য বা কেন সবাই এমন ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছুক। বলাবাহুল্য, একই প্রবণতা আমরা বিএনপির বেলাতেও দেখেছি। প্রধানমন্ত্রীর এই সতর্কবার্তা মনোনয়নপ্রত্যাশীরা কিভাবে নেবেন জানি না, তবে আকাশে কিন্তু সিঁদুরে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। নয়া পল্টনের ঘটনার দুটো দিক। একদিকে যেমন সহিংসতা আরেক দিকে আছে সর্তকতা। আওয়ামী লীগের আত্মতুষ্টি তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার পুঞ্জিভূত ক্রোধ আর মানুষের রাগও আছে সঙ্গে। তারা নানা কারণে তিতিবিরক্ত। সামাজিক মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া সোহেল তাজের একটা ভাষণ আমার মনে ধরেছে। কাপাসিয়ার জনগণের উদ্দেশ্যে দেয়া এই ভাষণে সোহেল তাজ বলেছেন, সরকারী দলের বিপদ বেশি। এই সত্য ভাষণ নেতারা দিতে চায় না। অথচ তারা যে কাচের স্বর্গে বাস করছেন সেখানে ঢিল বা পাটকেল ঠিকমতো লাগলেই খবর আছে। সে ঢিল এখনও নির্দেশনা বা জায়গাচ্যুত হওয়ার মূল কারণ একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর ইমেজ আর উন্নয়ন। সেটা যেদিন ষড়যন্ত্রকারীরা ব্যর্থ বা অকেজো করতে পারবে, সেদিনই ঘটবে বিপর্যয়। এবার তারা একা মাঠে নামেনি। আওয়ামী লীগের এককালের নেতাদের অনেকেই তাদের সঙ্গে। বিশেষত ড. কামাল হোসেন। আগেই লিখেছিলাম মুখে যাই বলুক সেগুলো মূলত মুখের কথা। অন্তরে ও গোপনে আঁতাত আছে বলেই তারা সবাই এক হয়েছেন। সে কথার প্রতিধ্বনি এখন কাজে দেখতে পাচ্ছি। সবাই ধানের শীষে লড়বেন এবং অচিরেই ড. কামালেরা জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক বলবেন। আর কিছুদিন পর এও শুনতে হবে তারেক জিয়াই তাদের নেতা। সংবাদ সম্মেলন বা সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠকে যে প্রশ্নটির উত্তর এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলা বলা হচ্ছে আসলে কি তা এড়িয়ে গেছেন তারা। খবরে দেখলাম প্রশ্নটি করেছিলেন মতি ভাই। মানে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান। সেখানেই তো উত্তর আছে। মতিউর রহমানকে যারা জানেন তাদের অজানা না তিনি কম কথা বলেন। যখন বলেন তখন তার একাধিক অর্থ থাকে। আসলে তিনি বলিয়ে নিতে চেয়েছিলেন যে ড. কামাল হোসেন হবেন প্রেসিডেন্ট আর তারেক জিয়া প্রধানমন্ত্রী। ফ্রন্টের নেতারা এখনই তা বলতে নারাজ বলে হয়ত মুখ খোলেননি। মতিউর রহমান জানতে চেয়েছিলেন আসল কথা। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়া খালেদা জিয়া আর তারেক জিয়া কিভাবে জায়েজ হবে? আপাতত উত্তর না দিলেও ড. কামাল হোসেন কিন্তু এড়িয়ে যাননি। তিনি বলেছেন: ধৈর্য ধরতে। সময়ে সব জানা যাবে। যার মানে কথা একটাই। সময়ে এক কলমের খোঁচায় সব বাতিল করে দিয়ে সেটাই করা হবে। এ দেশে কি অসম্ভব? বিশেষত রাজনীতিতে? ইনডেমনিটির সমাজে খালেদা জিয়া বা তারেকের প্রত্যাবর্তন কেন অসম্ভব? তাই আমাদের মনে রাখা দরকার গেমের ভেতরও গেম চলছে। কাদের সিদ্দিকী, আসম রব বলছেন। আর মান্না তো মুখরই। তাদের কথা ফলো করলেই বুঝবেন বিএনপির কাঁধে বন্দুক রেখে রিটায়ার্ড যোদ্ধারা জয়ী হতে চাইছে। শেখ হাসিনা সেটা বুঝছেন বলেই সাবধান করে দিয়েছেন। পল্টনের ঘটনার দিকে তাকালেই বুঝবেন পরিবেশ কতটা ভয়ঙ্কর। বাংলাদেশ ও তার মানুষের চরিত্র বরাবরই বিচিত্র। নানা কারণে তারা সবসময় বিরোধী দলের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকে। কথায় বলে মানুষের চাওয়ার শেষ নেই। এক সময় অন্ন-বস্ত্র বা বসবাস নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষ সেগুলো নিয়ে নিশ্চিত হলেও আশা কমেনি তাদের। শান্তি আর নিরাপত্তার মতো মৌলিক বিষয়গুলো যেহেতু এখনও প্রশ্নময় সেহেতু বিরোধী দলের প্রতি দুর্বলতা থাকা স্বাভাবিক। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে বিএনপি আসলে মুসলিম লীগের বিকল্প। যারা জামায়াতের সঙ্গে থাকে আবার মুক্তিযুদ্ধের দল বলেও নিজেদের প্রচার করতে ভালবাসে। তাদের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সুযোগে একজন মুক্তিযোদ্ধা। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের ইতিহাস ও অর্জনকে তিনি যতভাবে হেনস্তা করুন না কেন মধ্যবিত্তের মনে তার একটা জায়গা আছে। বিশেষত সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তের মনে। মনে রাখা দরকার বিএনপি পাকিপ্রেম আর বাংলাদেশ মিলে যে ককটেল তৈরি করেছিল তা ভালই গিলেছিল এ দেশের মানুষ। যখন চেতনা প্রায় মৃত আর আদর্শ প্রায় শেষ তখন শেখ হাসিনা হঠাৎ সব বদলে দিলেন। ইতিহাসের কাঁটা সাফ থেকে দেশের উন্নয়নে তার হাজারো অবদান থাকার পরও এদেশের একশ্রেণীর মানুষ বিএনপি বলতে অজ্ঞান। এদের সমর্থন আর দুই টার্মে আওয়ামী লীগে স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠা নেতা-কর্মীদের মস্তানী সন্ত্রাস আর বেপরোয়া মনোভাবের কারণে নমিনেশন প্রার্থীরা ধরে নিয়েছেন ধানের শীষে নির্বাচন করতে পারলেই তারা জিতে আসবেন। তাই আজ নয়া পল্টনে ঢল দেখলাম। এদিকে আত্মতুষ্ট আওয়ামী লীগে নেতার চাইতে অভিনেতাদের ভিড় বাড়ছে। মনোনয়নপত্রের জন্য মরিয়া বেশিরভাগ মুখ বা চেহারায় আওয়ামী ভাব নেই। তারকা খচিত নির্বাচন দলের জন্য কতটা সুখকর হবে বলা মুশকিল। তবে নয়া পল্টনের সমানে যে ভিড় পরবর্তীতে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এটা পরিষ্কার বিএনপিই চ্যালেঞ্জ। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা মানে দেশের এক বিরাট অংশের মোকাবেলায় নামা। সরকারী দলের সে রাজনৈতিক প্রস্তুতি কতটা সেটাই দেখার বিষয়। তবে ভিড় ও সমাবেশ এবং আগতদের আচরণ ও চেহারা বলে দিচ্ছে বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী। এমন কঠিন সময়ে ইতিহাস তো ইতিহাস বঙ্গবন্ধুও ছাড় পাবেন না। যে কারণে আগ বাড়িয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী ড. কামালকে বঙ্গবন্ধুর সমান বলে দিচ্ছেন। আরো কত কিছু শুনতে হবে, দেখতে হবে। তবে ভরসার মূল জায়গাটা জনগণ। আওয়ামী লীগে এখন খাই খাই মানুষের ভিড়। তাদের বিরুদ্ধে কিছু বললে তারা ফেসবুকসহ সামাজিক মিডিয়ায় গালাগাল করেন। মন্দ বলেন। কিন্তু এদের না দমালে দলের জয় নিশ্চিত হবে না। আওয়ামী লীগের দুশমন তাদের ভেতরে। এত উন্নয়ন এত অর্জনের পরও মানুষের ভালবাসা বা সমর্থনের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী হতে না পারার কারণও এরা। বহু নামী নেতার পাশাপাশি আজ সুবিধাবাদীরাই দলের সর্বনাশে এগিয়ে আছে। দেশে বিদেশে এদের উৎপাতে আমরাই বিচলিত। আর জনগণ তো হতাশ হবেনই। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দুই টার্মে গদিতে থাকা আওয়ামী লীগের জয়-পরাজয়ের চাইতেও বড় কথা দেশ ও সমাজ কোন্দিকে যাবে? যাদের কামানোর তারা যা দরকার কামিয়ে নিয়েছেন। যাদের ধান্দার প্রয়োজন তারা তা করছেন। কিন্তু আসল যে ব্যাপার সমাজ ও দেশের প্রগতিশীলতা অসাম্প্রদায়িকতা বা মুক্তবুদ্ধি সে দিকগুলোই আমাদের ভাবনার বিষয়। আহমদ ছফা লিখেছিলেন, আওয়ামী লীগ জিতলে শুধু তারা জেতে আর হারলে আমরা সবাই হেরে যাই। সে বাস্তবতা আরও একবার যেন প্রকট না হতে পারে সে বিষয়টা মাথায় রেখে কাজ না করলে, এ দেশের ভবিষ্যত কি হবে ভাবতে শিউরে উঠি। শেখ হাসিনার ওপর ভরসা রাখার পাশাপাশি আমরা চাই যে যার জায়গা থেকে দেশ ও জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে এগিয়ে আসবেন। দানবের মোকাবেলায় শুধু বাহিনী মাঠে রেখে নিজেরা নিশ্চিন্তে থাকলে চলবে না। জাগরণের বিকল্প নেই। এটাই পারবে নৌকাকে কূলে ভিড়িয়ে দিতে আরও একবার। [email protected]
×