ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিল্টন বিশ্বাস

জঙ্গীবাদ দমনে সরকারের সাফল্য

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ১৯ নভেম্বর ২০১৮

 জঙ্গীবাদ দমনে সরকারের সাফল্য

(গতকালের পর) ॥ তিন ॥ ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর জঙ্গী দমনে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কার্যকর পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করায় জঙ্গী দমনে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ আজ ‘রোল মডেল’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ইতিবাচক ভূমিকা ও অবদান গুরুত্বের সঙ্গে উঠে এসেছে। কারণ, বাংলাদেশে জঙ্গী তৎপরতা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সবসময়ই তৎপর রেখেছেন তিনি। দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হওয়ার পর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দৃষ্টান্ত রয়েছে জঙ্গী সদস্যকে গ্রেফতারের। ধরার পর বিচারে ফাঁসি হয়েছে কয়েকজন দুর্ধর্ষ জঙ্গী সদস্যদের। জঙ্গীদের অনলাইন তৎপরতা রোধে এখন প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে নিশ্চিন্তে কাজ করাচ্ছেন তিনি। পাশাপাশি ফেসবুক, গুগলসহ বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্ম এবং স্মার্টফোন এ্যাপ নির্মাতাদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সখ্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যাতে প্রয়োজন হলে দ্রুত সাইবার ক্রাইমের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া যায়। আসলে বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে এলিট ফোর্স র‌্যাব, বিশেষায়িত ইউনিট সোয়াটসহ পুলিশের সকল ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থাকে জঙ্গীবিরোধী অভিযান ও কার্যক্রম জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ।’ এদেশের মানুষ ধর্মীয় উগ্রবাদিতা ও তাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত জঙ্গীবাদকে ঘৃণা করে। দেশের অগ্রগতি ও নিরাপত্তার জন্য সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ বড় ধরনের অন্তরায়। এই অন্তরায় দূর করার জন্য গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ‘পুলিশ’ ও ‘র‌্যাব’ বাহিনীর সফল অভিযানে শীর্ষ স্থানীয় জঙ্গী নেতাসহ গুরুত্বপূর্ণ সদস্য গ্রেফতার ও নিহত হয় এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলা-বারুদ উদ্ধার করা হয়। ২০১৬ সালের হলি আর্টিজান হামলার পর এ পর্যন্ত যতগুলো অপারেশন পরিচালিত হয়েছে তার সবগুলো থেকেই জঙ্গীগোষ্ঠী আঘাত হানার পূর্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে জঙ্গী আস্তানাসমূহ গুঁড়িয়ে দিয়েছে। জঙ্গী দমনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ফলে বর্তমানে জঙ্গী তৎপরতা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে এবং জঙ্গী দমনে এ সাফল্য আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। উপরন্তু জনগণের নিরাপত্তা এবং দেশের সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার লক্ষ্যে জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড দমনে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। জঙ্গীবাদ এবং জঙ্গীবাদের অর্থায়নে জড়িতদের কার্যকরভাবে দমনের লক্ষ্যে সরকার সন্ত্রাস বিরোধী আইন-২০০৯ (সংশোধনী-২০১৩) এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ প্রণয়ন করেছে। সরকারের আন্তরিকতা এবং গৃহীত নানা পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বর্তমানে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। জনগণের প্রত্যাশা জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ দমনে মন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশনা অব্যাহত থাকবে। উল্লেখ্য, জঙ্গী হিসেবে এযাবৎ যতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই ৪টি সংগঠনের। নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনগুলো হচ্ছে- জেএমবি, নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলাটিম ওরফে আনসার আল ইসলাম ও হিযবুত তাহরির। জেএমবি গঠিত হয়েছে জামায়াতের প্রাক্তন সদস্যদের নিয়ে। আল কায়েদার অনুসারী আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে শিবিরের মানুষ। হিযবুত তাহরিরের সঙ্গে সরাসরি জামায়াতের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া না গেলেও দল দুটির মধ্যে মতাদর্শগত মিল রয়েছে; এরা ওয়াহাবী ধারার জিহাদী। গবেষকরা জানিয়েছেন, বিদেশী অর্থ ছাড়াও জামায়াতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মুনাফার ৪০ হাজার কোটি টাকা প্রতিবছর বিনিয়োগ হচ্ছে জঙ্গী তৈরিতে। এদের নিষিদ্ধ করে নির্মূল করা হলে বন্ধ হবে জঙ্গীবাদ। আর জঙ্গীবাদের বিলোপের মাধ্যমে নিশ্চিত হবেই অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বিজয়। দেশব্যাপী ২০১৭ সালে পরিচালিত অনেকগুলো অভিযানের মধ্য দিয়ে জঙ্গীবাদ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সাফল্য দেখিয়েছেন যা পূর্ববর্তী বছরের মতো সরকার ও জনগণের কাছে সুনাম অর্জন করেছে। এ সময় তারা চাঞ্চল্যকর অপরাধে জড়িত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনেছেন। তবে ২০১৬ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬টির বেশি জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালানো হয়। এতে ৪৬ জন জঙ্গী নিহত হয়েছে। তাদের ৩৫ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী জঙ্গী। এছাড়া বাকি ৫ জন শিশু। ২০১৬ সালের ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’, ‘অপারেশন স্টোর্ম-২৬’, ‘অপারেশন হিট স্ট্রং ২৭’, ‘অপারেশন রূপনগর’, ‘অপারেশন আজিমপুর’, ‘স্পেইট-এইট’, ‘অপারেশন শরতের তুফান’, ‘অপারেশন হারিনাল’, ‘অপারেশন গাজীরাস্ট’, ‘অপারেশন কাপমারা’, ‘অপারেশন রিপল ২৪’ প্রভৃতি জঙ্গীবাদবিরোধী অপারেশনে মন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশনা ছিল। ২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা ছিল নব্য জেএমবির। র‌্যাবসহ পুলিশের যৌথ টিমের অভিযানে (আগস্ট বাইট) সেই পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয়া হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অদূরে পশ্চিম নাখালপাড়া এলাকায় জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পায় ‘র‌্যাব’। সেখানে অভিযানে তিন জেএমবি সদস্য নিহত হয়। উদ্ধার করা হয় গ্রেনেড, বিস্ফোরক ও অস্ত্র। এর পরও ২০১৮ সালে দেশের ভেতর জঙ্গী তৎপরতা ও তার বিরুদ্ধে অভিযানের আরও তথ্য রয়েছে। অর্থাৎ জঙ্গী সদস্যরা এখনও নানা কৌশলে সক্রিয়। এমন বাস্তবতায় জঙ্গীরা আইনের আশ্রয় নিয়ে জামিনে মুক্ত হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবশ্যই ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। এ কথা সত্য দীর্ঘ নজরদারি, গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ, প্রযুক্তিগত ও স্থানীয় তদন্তের পর জঙ্গী কার্যক্রমে জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃত জঙ্গী সদস্যদের তথ্যের ভিত্তিতেও গ্রেফতার হয় অনেক জঙ্গী। এরপরও তাদের অনেকে জামিনে বের হয়ে আবারও একই কাজে যুক্ত হচ্ছে। এতে জঙ্গী কার্যক্রম পুরোপুরি নির্মূল করা যাচ্ছে না। জামিন পাওয়া সবাই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনের সদস্য। আর এসব জঙ্গীর জামিনে উদ্বিগ্ন আমরা সাধারণ জনগণ। ॥ চার ॥ সারাদেশে একযোগে বোমা বিস্ফোরণসহ বিভিন্ন সময়ে নাশকতা সৃষ্টিকারী জঙ্গী সংগঠনসমূহের শীর্ষ সারির নেতা থেকে শুরু করে বিভিন্নস্তরের নেতাকর্মীদেরও গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা সম্ভবপর হয়েছে। আটককৃতদের মধ্যে কারও কারও মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে, কেউ কেউ বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছে এবং বেশকিছু মামলা এখনও বিচারাধীন। তবে, যে সকল জঙ্গী এখনও আত্মগোপন করে আছে তাদের তৎপরতা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। পুলিশ ও র‌্যাবের কঠোর গোয়েন্দা নজরদারি ও অভিযানের ফলে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনগুলোর নেতা কর্মীরা পুনরায় সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে বার বার ব্যর্থ হয়েছে এবং বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে আটক হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের ‘আর এ্যান্ড ডি সেল’ একটি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান। এটি র‌্যাব কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন অপারেশন, অপরাধ ও অপরাধী চক্র, ধর্মীয় জঙ্গীবাদ, চরমপন্থী জঙ্গীবাদ, ইভটিজিং, এসিড-সন্ত্রাসসহ সমসাময়িক ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণাকার্য পরিচালনা ও গবেষণাপত্র তৈরির কাজ করে আসছে। র‌্যাব সদর দফতরে অবস্থিত এ সেলটি মহাপরিচালকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন এবং চরমপন্থী দলের উত্থান, সাংগঠনিক কার্যক্রম, গতিপ্রকৃতি ও বিস্তার ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এ সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে চরমপন্থী ও জঙ্গী দমনে র‌্যাবের করণীয় দিকগুলো এ সেলের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। (সূত্র : ওয়েবসাইট) অর্থাৎ ‘র‌্যাবে’র আছে জঙ্গীবিরোধী আলাদা ইউনিট। আর সেখানে জঙ্গীদের তথ্য সংগ্রহ, জঙ্গীবিরোধী অভিযান এবং তদন্ত চলে। তারা যৌথ অভিযানেও অংশ নেন। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির হামলার পর গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের সহায়তায় একের পর এক জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালিয়ে জঙ্গীসদস্যদের নির্মূল করা হচ্ছে। এসব অভিযানের কারণে জঙ্গীদের নেটওয়ার্ক অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে জনজীবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ফিরে এসেছে। তবে জঙ্গীবাদ উত্থানের কিছু কারণ রয়েছে সেগুলো বন্ধ না হলে জঙ্গীবাদ পুরোপুরি নির্মূল হবে না। অন্যদিকে মনে রাখা দরকার জঙ্গীবাদ একটি বৈশি^ক সমস্যা। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর যে সাফল্য, যে অর্জন, সেটা অকল্পনীয়। বিশ্বের বহু দেশ এটা করতে পারেনি। ১৭ কোটি মানুষের দেশে জঙ্গীসদস্য এবং তাদের আস্তানা খুঁজে বের করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মেধাবী ও চৌকস অফিসাররা যে অপারেশনগুলো করছেন, তা বিরল ঘটনা। (সমাপ্ত) লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×