ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সেই পুরনো কৌশল

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২১ নভেম্বর ২০১৮

সেই পুরনো কৌশল

এ উপমহাদেশে যখন নতুন সমাজ গড়ার প্রচেষ্টা চলছে তখন নানা রকম রাজনৈতিক স্বার্থের পাশাপাশি ধর্মকে উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহারের তাত্তি¡ক আয়োজনও চলছিল। উনিশ শ’ একাত্তরে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল তারা তাদের আগের ধারাবাহিকতা মেনেই তা করেছিল। ভারত যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পুরোপুরি জড়িয়ে গেছে তখন আজকের জামায়াতে ইসলামীর তাত্তি¡ক মাওলানা আবু আলা মওদুদী তার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য জাতির মতো আমাদের স্বাধীনতার অর্থও কি এই যে, বিজাতির শাসনমুক্ত হওয়া? স্বজাতির শাসন কিংবা স্বদেশীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া কি আমাদের লক্ষ্যের জন্য প্রয়োজন?... আমাদের সামনে তো শুধু একটি উদ্দেশ্য রয়েছে আর তা হলো আল্লাহর বান্দার আল্লাহকে ছাড়া আর কারও অধীন না হওয়া, মানুষের সার্বভৌমত্বের অবসান হওয়া এবং আল্লাহ প্রেরিত ন্যায়নীতির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া।... যে আজাদী জাতীয়তাবাদীদের লক্ষ্য তার সমর্থনে সংগ্রাম করার কোন অর্থ নেই। আমি তো একে ইংরেজের গোলামির চাইতেও ঘৃণ্য মনে করি, আমাদের নিকট (এই আজাদী সংগ্রামের) পতাকাবাহীরা মুসলমানদের জন্য সে পর্যায়ভুক্ত, যে পর্যায়ের ছিল ক্লাইভ, ওয়েলেসলি। এবং তাদের সমর্থক মুসলমানরা কোন অবস্থাতেই মীর জাফর ও মীর সাদেক থেকে ভিন্নতর নয়। যদিও অবস্থা ও পরিস্থিতির ভিন্নতা রয়েছে, কিন্তু শত্রæতা ও বিশ্বাসঘাতকতার ধরনে কোন ফারাক নেই।... ইসলামের দৃষ্টিতে ইংরেজ এবং ভারতবাসী উভয়েই মানুষ, সে উভয়কেই নিজের আহবানে সম্বোধন করছে, ইংরেজের সঙ্গে ইসলামের এই জন্য দ্বন্দ্ব নয় যে, সে এক দেশের বাসিন্দা হয়ে অন্য দেশ কেন শাসন করছে, বরং এই জন্য যে, সে খোদার সার্বভৌমত্ব এবং আইন-কানুন কেন স্বীকার করছে না...।’ [জামায়াতের আসল চেহারা মাওলানা আবদুল আউয়াল। অথচ এই মওদুদী এক সময় কংগ্রেসের রাজনীতি সমর্থন করেছেন। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি বা এর বিকৃতি কোনটাই তার চরিত্রে সে সময় ছিল না। কংগ্রেসের রাজনৈতিক আদর্শ সমর্থন করে তিনি এক সময় লিখেছিলেন, ‘এখন দেশের জন্য দুটো পথ রয়েছে। প্রথমটি হলো, নিজেদের আবেগ, অনুভূতির বশবর্তী হয়ে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা, এবং যেদিক ইচ্ছে পা বাড়ানো, দ্বিতীয়টি হলো, কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত মেনে চলা এবং এক মুহূর্তের জন্যও অন্তরে এর বিরোধিতার ধারণা পোষণ না করা। প্রথম পথ অনুসরণের পরিণাম আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী, দ্বিতীয় পথ যদিও আবেগ-অনুভূতিবিরোধী, তবু এটাই হচ্ছে ঐক্য ও সংহতির পথ। আর ঐক্য ও সংহতি সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে উত্তম। একতা সকল অবস্থায় বিভেদের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। আর সংহতি সব দিক থেকেই অগ্রগণ্য। মওদুদী বিভিন্ন সংবাদপত্রে কাজ করেছেন এক সময়। সে সুবাদে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হন। সে সম্পর্কে লিখেছেন, ‘১৯১৯ সালে খেলাফত ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হলে আমি এই দুটো আন্দোলনের পক্ষে কাজ করি। সে সময় আমি গান্ধীজীর জীবন চরিত লিখি, বইটি ছাপা হচ্ছিল। আমার এক বন্ধু পুলিশ সুপারকে জানিয়ে দেয়। ছাপা অবস্থাতেই বইটি বাজেয়াফত করা হয়... জব্বলপুরের মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগদানে উৎসাহ দানকারীদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। [জামায়াতের আসল চেহারা] ফরাসী বিপ্লবের আগে এক খ্রিষ্টান ধর্ম যাজক ধর্মের উদ্দেশ্য মূলক রাজনৈতিক ব্যবহার দেখে নিজ পেশা ত্যাগ করেছিলেন। যাজক জ্যাঁ মেসলিয়ে মানুষের কল্যাণে যা করেছিলেন মওদুদী ঠিক তার উল্টোটা করেছেন, যদিও এখানে তুলনাটা একেবারেই বেমানান, মেসলিয়ের সময় ও সে সময়ের ফ্রান্সের সঙ্গে উপনিবেশ ভারতের তুলনা চলে না। ফ্রান্সের সমাজের বিকাশ ঘটেছে ধারাবাহিকতা মেনে স্বাভাবিকভাবে, বিকাশের প্রতিটি স্তর পরিপুষ্ট হয়েছে দার্শনিক মতাদর্শের ভিত্তিতে। একটি ঔপনিবেশিক দেশে সে রকম হওয়ার সুযোগ কম। এখানে সমাজের বিকাশ হয় অস্বাভাবিক বা কৃত্রিমভাবে ঔপনিবেশিক প্রভু নিজের প্রয়োজনে কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠী বা শ্রেণী তৈরি করে যাদের বেশিরভাগের পক্ষে দেশের জন্য বড় কিছু করা সম্ভব হয় না। ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনে মওদুদী তেমন কোন ফ্যাক্টর না হলেও তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ বদল পরবর্তীতে সমাজে বিভিন্নভাবে প্রভাব ফেলেছে। একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি বলেছেন ‘পাকিস্তানের শত্রু ও দুষ্কৃতকারী’। সত্তরের নির্বাচনে তাঁর দল জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের প্রতিদ্ব›দ্বী হিসেবে অংশ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মাত্র চারটি আসনে জয়ী হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সবগুলো আসনে তারা শুধু হারেনি জামানত বাজেয়াফত হয়েছিল। পূর্ব বাংলা যখন স্বাধীনতার জন্য লড়ছে তখন মওদুদী ও তাঁর রাজনৈতিক দলের আসল চেহারা এদেশের প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে। এরপর ধারাবাহিকভাবে তাদের কর্মকান্ড এ দেশের মানুষ দেখেছে। কিন্তু এ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যত বিভেদ বিভাজন থাক, যতই ডান-বামের দ্বন্দ্ব-বিরোধিতা থাক জামায়াত-শিবির প্রশ্নে দুটো স্পষ্ট ভাগ হয়ে যায় এখনও। এখনও তারা মেরুদন্ডে ভর করে নিজস্ব পরিচয়ে জনগণের সামনে দাঁড়ানোর সাহস রাখে না। নানা কৌশলে এর ওর ঘাড়ে চেপেই এ পর্যন্ত পথ চলেছে তারা। এখন দলীয় নিবন্ধন না থকলেও নির্বাচন নিয়ে বিশ দলীয় ঐক্যজোট এবং ড. কামাল হোসেন ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে নানান কৌশলী হিসেব নিকেশ করছে। এ তাদের পুরনো অভ্যাস।
×