ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তি চুক্তির একুশ বছর

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৫ ডিসেম্বর ২০১৮

শান্তি চুক্তির একুশ বছর

পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ২১ বছর পেরিয়ে গেছে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তি চুক্তি সই-এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে দীর্ঘ দু’দশকের বেশি সময় ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংঘাতের। অকুণ্ঠচিত্তে বলতেই হয় যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সে সময় ক্ষমতাসীন না থাকলে পার্বত্য শান্তি চুক্তি সম্পাদন করা অন্য কারও পক্ষেই সম্ভব হতো না। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পার্বত্যবাসী সেই চুক্তির মর্মবাণী তথা শান্তির অমিয় বার্তা অনুধাবনে যথার্থই ব্যর্থ হয়েছে। শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর সময়ে সময়ে সরকার যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে তা বাস্তবায়নে উদ্যোগী ও সচেষ্ট হয়ে ওঠে। একথাও বলতে হবে যে, সব সমস্যার সমাধান রাতারাতি সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তবে সরকার পাহাড়ীদের যুক্তিসঙ্গত দাবি পূরণে কখনই কালক্ষেপণ করেনি। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী গত ২১ বছরে প্রত্যাগত শান্তি বাহিনীর সদস্যদের পুনর্বাসন, সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারসহ স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন সংশোধন, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করে চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত, ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়িত এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে। তবে পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয় ও শর্ত অদ্যাবধি বাস্তবায়িত হয়নি বলে জনসংহতি সমিতির নেতাদের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ভূমি জরিপসহ বণ্টন ও পুনর্বাসন। এ নিয়ে ভূমি কমিশনও গঠিত হয়েছে। তবে অকপটে স্বীকার করতে হবে যে, বিষয়টি অত্যন্ত জটিল এবং সমাধান সময়সাপেক্ষ। উভয় পক্ষকে অবশ্যই আন্তরিকতার সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে বাস্তবতার নিরিখে সমঝোতায় উপনীত হতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জট ও জটিলতার কারণে বিলম্বিত প্রক্রিয়া ব্যতিরেকে বর্তমান সরকারের সঙ্গে জনসংহতি সমিতির তেমন দূরত্ব আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। বরং পাহাড়ীদের মধ্যে বর্তমান হানাহানি, অশান্তি ও রক্তারক্তির মূল কারণ হলো আত্মঘাতী, ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত-সংঘর্ষ ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব। পার্বত্য অঞ্চলে কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বসবাস। সেসব গোষ্ঠী জনসংখ্যায় বেশি এবং শিক্ষা-দীক্ষায় অপেক্ষাকৃত বেশি আলোকিত, তারা স্বভাবতই অন্য ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে ইচ্ছুক। এর পেছনে কিছু স্বার্থান্বেষী এনজিওসহ বিদেশী শক্তির ইন্ধন থাকাও বিচিত্র নয়। এর পাশাপাশি শান্তি চুক্তি সম্পাদন বাস্তবায়নের সময়ই নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে এর বিরোধী পক্ষ সজাগ ও সক্রিয় হয়ে ওঠে। চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ, মানা না মানা নিয়ে বেড়ে যায় ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত-সংঘর্ষ। পাহাড়ীদের মধ্যে গড়ে ওঠে একাধিক সশস্ত্র গ্রুপ। জাতিগত বিদ্বেষে অব্যাহত সন্ত্রাস, সংঘর্ষ, হানাহানি ও চাঁদাবাজিতে বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে পার্বত্য জনপদ। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন ও জনজীবন সময়ে সময়ে হয়ে ওঠে আতঙ্ক ও বিপদগ্রস্ত। বাঙালীদের কয়েকটি সংগঠনেরও অভিযোগ রয়েছে যে, চুক্তির কারণে পাহাড়ীদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়েছে, যেটি আদৌ সত্য নয়। পাহাড়ীদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার পার্বত্য অঞ্চলসহ দেশের সার্বিক উন্নয়নে যেসব মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করছে, তার সুফল ও সমৃৃদ্ধি পাওয়া যাবে পাহাড়েও। সংঘাত-সংঘর্ষ সেখানে শান্তি বয়ে আনবে না কখনোই বরং অব্যাহত উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিই শান্তি সুনিশ্চিত করবে। পাহাড়ী-বাঙালী বিভেদও কাম্য নয় কোন অবস্থাতেই। বর্তমান সরকার পারস্পরিক সহাবস্থান ও শান্তিতে বিশ্বাসী। নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত-সংঘর্ষ সন্দেহ-অবিশ্বাস স্থগিত রেখে আলোচনার টেবিলে বসে তারা যে কোন যুক্তিসঙ্গত সমঝোতায় উপনীত হতে পারে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পাহাড়ীদের প্রতি সর্বদাই সহানুভূতিসম্পন্ন, মানবিক ও উদার। শান্তি চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হলেই কেবল তাদের সুখ, সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন সুনিশ্চিত হতে পারে। বহির্বিশ্ব প্রধানমন্ত্রীকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ বা মানবতার জননী অভিধায় ভূষিত করেছে। তার পক্ষেই সম্ভব অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে পরিপূর্ণ শান্তি ফিরিয়ে আনা।
×