ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

লৌহমানবের শাসনের পথে ব্রাজিল!

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ৫ ডিসেম্বর ২০১৮

লৌহমানবের শাসনের পথে ব্রাজিল!

ব্রাজিলের নতুন প্রেসিডেন্ট চরম দক্ষিণপন্থী জাইর বোলসোনারো। গত ২৮ অক্টোবর অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ব্রাজিলের ভোটাররা এই মানুষটিকে দেশের শীর্ষ পদে বেছে নিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তারা তাঁর দক্ষিণপন্থী র‌্যাডিকেল ভাবধারা গ্রহণে কতখানি প্রস্তুত। সাবেক সেনা ক্যাপ্টেন উগ্রভাষী এই কংগ্রেস সদস্যকে রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রান্তভাগ থেকে তুলে এনে প্রেসিডেন্টের পদে বসানোর পেছনে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভূত ভূমিকা ছিল। ব্রাজিলীয়রা তাকে দ্বিতীয় দফা ভোটে চূড়ান্তভাবে জয়ী করেছে। এখন তারা ভাবছে তারা যাকে বেছে নিয়েছে সেটা ঠিক হয়েছে কিনা। বোলসোনারো ৫৫ শতাংশ ভোট পেয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী বামপন্থী ওয়ার্কার্স পার্টির (পিটি) ফার্নান্ডো হাদ্দাদকে পরাজিত করেছেন। তবে লক্ষ্যণীয়, এবারের নির্বাচনে রেকর্ড সংখ্যক ভোটার অনুপস্থিত ছিল। ভোটারদের যারা বোলসোনারোকে ভোটে জিতিয়েছেন তারা এই প্রত্যাশা নিয়ে সেটা করেছেন যে তিনি ব্রাজিলের তিন অভিশাপ থেকে তাদের মুক্ত করবেন। বোলসোনারোর বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ এবং লাতিন আমেরিকার বৃহত্তম দেশটিতে একটা রাজনৈতিক ভূমিকম্প ঘটে গেছে। তার ক্ষমতায় আগমনকে যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় কিংবা ব্রেক্সিটের পক্ষে গণরাসের সঙ্গে তুলনা করেছেন কোন কোন পর্যবেক্ষক। বোলসোনারো আসলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শ্রেণীর চরম দুর্নীতি, দেশের ইতিহাসে ভয়াবহতম মন্দা ও নজিরবিহীন সন্ত্রাস-সহিংসতার বিরুদ্ধে জনগণের রুদ্ররোষের জোয়ারে ভেসে জয়ী হয়েছেন। এই ত্রয়ী অভিমানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের সম্পদহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠী। বেকারত্বের যন্ত্রণায় তারা নিষ্পেষিত, সহিংসতায় তারা আতঙ্কিত যেখানে দিনে গড়ে নরহত্যা ঘটছে ১৭৫টি করে। বোলসোনারো তাদের এই অভিশাপ থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বলেছেন যে সহিংসতাকে বৃহত্তর সহিংসতা দিয়ে দমন করা হবে। এমন এক ভবিষ্যত গড়া হবে সেখানে দুর্র্র্নীতি থাকবে না, অপরাধ থাকবে নাÑ সেগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাসীনরা বিশেষ করে হাদ্দাদের ওয়ার্কার্স পার্টি জড়িত বলে অনেক ভোটারের ধারণা। গত ১৫ বছরের মধ্যে ১৩ বছরই এই দলটি ক্ষমতায় ছিল। ভোটারদের ক্রোধ এই রাজনৈতিক শ্রেণীটির প্রতি যারা নির্বাচনে জিতে রাজপথের মানুষের কথা শোনেনি, যারা ভেবেছে ক্ষমতার ওপর তাদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তারা যা চায় তাই করে পার পেয়ে যেতে পারবে। ভোটারদের এই মনোভাবের প্রতিফলন এবারের নির্বাচনের ফল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো ১৯৬৪-৮৫ পর্বের একনায়কত্বের পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন। তখন রাষ্ট্রীয় অনুমোদনে নির্যাতন ও হত্যা ছিল নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনা। গত আগস্ট মাসে ‘টাইম’ সাময়িকীর কাছে তিনি অবশ্য বলেছেন তিনি এখন গণতন্ত্রের সমর্থক তবে বেশ ক’জন জেনারেলকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদে নিয়োগের ইচ্ছাও তাঁর আছে। ‘টাইম’-এর সঙ্গে সেই সাক্ষাতকারের দু’সপ্তাহ যেতে না যেতে তিনি তার বামপন্থী বিরোধীদের জেলে পোড়ার কিংবা নির্বাসনে পাঠানোর হুমকিও দিয়েছিলেন। বোলসোনারো স্বৈরাচারের পথ বেছে নেবেন এমন আশঙ্কা অবশ্য করেন না ব্রাজিলের বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জাইরো নিকোলাউ বলেন, এদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী, সুশীল সমাজ সক্রিয় এবং সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ ও রাজনীতি থেকে দূরে। তবে মানবাধিকারবাদী ও নাগরিক অধিকার গ্রুপগুলো এবং পরিবেশবাদীরা নতুন প্রেসিডেন্টের আমলে ব্রাজিলে যে পথে যেতে পারে তা নিয়ে শঙ্কিত। কারণ নির্বাচনের সময় এই গ্রুপগুলোও বামপন্থীদের ওপর নজিরবিহীন হামলা হয়েছে। শুধু সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হুমকি ও হামলার ১৪১টি ঘটনা ঘটেছে। দেশ পরিচালনায় বোলসোনারোর বিস্তারিত নীলনক্সা এখনও জানা না গেলেও ইতোমধ্যে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে খুনখারাবি রোধে গুলি করে হত্যা করার অধিকতর ক্ষমতা পুলিশের হাতে দেয়া হবে। কিন্তু তাতে করে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের এই এক বছরে ব্রাজিলে ৬৩ হাজার ৮৮০টি হত্যাকা- সংঘটিত হয় যা কিনা এক রেকর্ড। সুতরাং সহিংস অপরাধের উৎস বন্ধ না করে র‌্যাডিকেল পন্থায় তা দমনের চেষ্টা হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। এরপর আসে অর্থনীতির প্রসঙ্গ। মারাত্মক বাজেট ঘাটতি ও চরম বেকারত্বে অর্থনীতির পঙ্গুত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে বেশ আগেই। বোলসোনারো রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলো বিরাষ্ট্রীয়করণ, পেনশন ব্যবস্থার বেদনাদায়ক সংস্কার এবং বিদেশী বিনিয়োগের পথ আরও উন্মোচিত করে ব্রাজিলকে সঙ্কট থেকে উদ্ধার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তিনি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত তেল কোম্পানি পেট্রোবাস কিংবা বিদ্যুত উৎপাদন ব্যবস্থাকে ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়ার কথা বলেননি। তবে তিনি অর্থনৈতিক সংস্কারে যে পদক্ষেপই নিন না কেন শ্রমিক সংগঠনসহ বিভিন্ন ফ্রন্ট থেকে প্রবল বিরোধিতা আসবে এমনটা অবধারিত। এ অবস্থায় বোলসোনারোর উত্তরোত্তর কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা ছাড়া পথ সম্ভবত আর থাকবে না। চলমান ডেস্ক সূত্র : টাইম/ দি ইকোনমিস্ট
×