ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

একজন স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা এবং কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ৭ ডিসেম্বর ২০১৮

একজন স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা এবং কিছু কথা

আমি নিজে একজন শিক্ষক এবং অনেক বছর ধরেই দেশে-বিদেশে শিক্ষকতা করেছি এবং এখনও করছি। অনেক ধরনের ছাত্র-ছাত্রী হ্যান্ডেল করেছি। এমনকি এগারো ক্লাসেও পড়িয়েছি। অটিস্টিক ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে ‘ডিফিকাল্ট’ স্টুডেন্টদের ম্যানেজ করেছি। আমাদের মনে রাখতে হবে, টিনএজ বয়সটা খুবই কঠিন সময় বাবা-মায়ের জন্য। এমনকি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যও। ভিকারুননিসা নূন স্কুল নিয়ে বলার কিছুই নেই। এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে, ভর্তি পরীক্ষার সময়টার চিত্র দেখলেই বলে দেয়া যায় বাংলাদেশে মেয়েদের শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে এবং রাখছে অবশ্যই। আমার ধারণা স্কুলটিতে নিশ্চয়ই ‘কাউন্সিলিং বিভাগ’ এবং ছাত্রীদের ম্যানেজ করার জন্য একটা প্রটোকল অথবা ডিসিপ্লিনারি কমিটি আছে এবং কোন্্ কাজের জন্য কী শাস্তি এবং কিভাবে হবে এর একটা নীতিমালাও আছে। পরীক্ষাতে অনৈতিক কাজের জন্য নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়াটাই উচিত এবং এতে অযাচিত কথা বলারও কিছু নেই। প্রয়োজনে সরাসরি কাউন্সিলরদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া অথবা ডিসিপ্লিনারি কমিটিতে রিপোর্ট করা। একজন শিক্ষক তাৎক্ষণিক আইন তৈরি করতে অথবা ডিসিশন দিতে পারে না। তবে নকল ধরা পড়লে পরীক্ষাটা বাদ দিতে এবং পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করতে পারে। সেই কমিটিই সিদ্ধান্ত নেবে শিক্ষকের রিপোর্ট অনুযায়ী এবং স্টুডেন্টের সঙ্গে কথা বলে। সেই জন্য প্রতিটি শিক্ষালয়ে একটা গ্রিভেন্স কাউন্সিলও থাকে। স্টুডেন্ট তার কথাও জানাতে পারে, তারপরই একটা সিদ্ধান্ত আসতে পারে টিসি দেয়া হবে কি-না। যদি এটা প্রথমবার হয় তাহলে ওয়ার্নিং দেবে অথবা প্রটোকল বা নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবে। তবে শিক্ষকের কখনও সবার সামনে যাচ্ছেতাই বলা উচিত নয়। একা ডেকে কড়া কথা বলা আর সতীর্থদের সামনে বলার মধ্যে বিরাট পার্থক্য আছে। প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে বৈকি। টিনএজ মেয়েদের সেভাবেই হ্যান্ডেল করা উচিত। আমি জানি না বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় কোন কাউন্সিলর উপস্থিত ছিল কিনা। তাছাড়া মেয়েটিকে সামনে রেখে মা-বাবাকে কটু কথা বলা তো খুবই অনৈতিক। কথা বলা একটা আর্ট। সেজন্য সবক্ষেত্রেই প্রফেশনালদের এত কদর। তাই তেমনি গুছিয়ে পরিস্থিতি বুঝে কথা বলায় পারদর্শী কাউন্সিলরদের অনেক চাহিদা। কিছুদিন আগে ইউটিউবে ‘হামি’ নামে কলকাতায় নির্মিত খুব ভাল ডাইরেক্টরদের পরিচালিত একটা দারুণ মজাদার সিনেমা দেখেছিলাম। একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুল নিয়েই সিনেমাটি। কিন্তু কাউন্সিলরদের ভূমিকাটা সেখানে সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে সিনেমাটিতে। তাহলে ভিকারুননিসাতে কী কাউন্সিলর বলে কেউ নেই? এই ‘হামি’ সিনেমাটা সব স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দেখা উচিত। আজকাল পরীক্ষা হলে সেলফোন ব্যবহার করতে পারবে না তাও সিলেবাসে বা পরীক্ষার পত্রে লেখা থাকতে হবে। আর সেলফোন ব্যবহার করে নকল করেছে কি-না তাও নিশ্চিত হতে হবে। আমাদের সময়ে শিক্ষকগণ বেত মারত। সেটাই তখন রীতি ছিল। কিন্তু এখন বেত মারার প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশেও এখন কোন শিক্ষকই আর বেত হাতে নেয় না। মেজাজি শিক্ষক আগেও ছিল, এখনও আছে; কিন্তু বর্তমান নীতিমালা মেনে চলতে হবে। আমি বুঝতে পারছি না, একদিনের মধ্যে একেবারে টিসি দিয়ে দেয়া! এটাই কী ভিকারুননিসার প্রটোকল? এত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাইতেও কড়া। ভিকারুননিসা স্কুলের ঘটনাটা অবশ্যই অপ্রত্যাশিত এবং ভিকারুননিসাও চায় না এমন ঘটনা ঘটুক। প্রেম-ভালবাসার কারণে কিংবা বাবা-মায়ের বকুনির কারণে ছেলেমেয়েরা অনেক সময় আত্মহত্যা করে থাকে। স্কুলের কারণে আত্মহত্যা খুবই কম, তবে ঘটে না যে তেমন নয়। তবে ভাবতে ভাল লাগছে, তড়িতগতিতে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী চলে এসেছে, শিক্ষককে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তদন্ত ৩ দিনের মধ্যে শেষ করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এমনকি হাইকোর্ট বলছে নীতিমালা তৈরি করতে। জানি না স্কুলটিতে অডিও-ভিডিওর অর্থাৎ সার্কিট টিভির ব্যবস্থা আছে কিনা? তাহলে বোঝা যেত কতটা অনৈতিক কা- ঘটেছে। এখন বড় বড় স্কুল-কলেজে আধুনিক টেকনোলজির যুগে সব সার্কিট টিভির ব্যবস্থায় রাখে তাতে একটা ব্যালেন্স থাকে। হয়ত সেই শিক্ষকও সংযত হয়ে কথা বলত। আর প্রিন্সিপালের তো অপমানজনক কোন কথাই বলা উচিত নয়। একটা সাধারণ কথা তো খুবই প্রচলিত, ‘বিযয়টা সবকিছু জেনে পরে আপনাদের জানাব’- প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিরা তাই করে থাকেন। সমাজে ‘বুলিইং’ অর্থাৎ ব্যঙ্গ বলে একটা কথা চালু আছে। ছাত্র-ছাত্রীরা বা বন্ধু-বান্ধবরা একে অন্যকে করে থাকে। এটা একটা মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। একজন অপরাধ করতেই পারে, তার জন্য নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে ‘বুলিইং’ নয়। পত্রপত্রিকা পড়ে যতটুকু বুঝতে পেরেছি বিষয়টা আরও সহজেই ম্যানেজ করা যেত এবং তা এখন বুলিইং পর্যায়ে চলে গেছে। আমি শিক্ষক হিসেবে বুঝতে পারছি, যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত তারা এখন ঠিকমতো ঘুমুতে পারছে না। তারা নিশ্চয়ই ভাবতে পারেনি এমনটি হবে। ভেবে দেখুন আপনারা একটা মেয়ের মৃত্যুর জন্য কিছুটা হলেও দায়ী। পরিশেষে একটি কথা না বলেও পারছি না। বাংলাদেশের হাইকোর্ট অনেক ক্ষেত্রেই অভিভাবকের ভূমিকায় কাজ করে থাকে এবং তা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। এক্ষেত্রেও বলছে আত্মহত্যা প্রতিরোধে একটা নীতিমালা থাকা উচিত। বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়ন কামনা করছি। লেখক : আমেরিকান প্রবাসী অধ্যাপক [email protected]
×