ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান

প্রকাশিত: ০৪:৩৯, ৭ ডিসেম্বর ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান

বৃহত্তর দিনাজপুর তথা উত্তরবঙ্গের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুখ্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানে অন্যতম বিপ্লবী মুখটি ছিল এ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান। যিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সহচর ছিলেন। ১৯৭১ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় (বর্তমান দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলা) সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মাধ্যমে বাংলাদেশর ভূখ- এবং লাল সবুজের পতাকা পাবার জন্য যে স্বাধীনতা সংগ্রাম, তারই অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব এ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান। স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান এবং সুশৃঙ্খল করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী ৪ মার্চ ১৯৭১ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হলে তিনি ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় পরিষদের সভাপতির দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। প্রবাসী সরকার সুনিয়ন্ত্রিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো সম্পন্ন হলে, মুজিবনগর সরকার এ্যাডভোকেট আজিজুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ৭নং সেক্টর এবং ৬নং সেক্টরের অর্ধেক অঞ্চলের জন্য ল্যাফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল এ্যাফেয়ার্স এ্যাডভাইজার ওই পদে দায়িত্ব প্রদান করে। মোঃ আজিজুর রহমান ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার মোহম্মদপুর গ্রামে ১৯২০ সালের ১ নবেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম আলেকজান নেসা। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তাঁর বিপ্লøবী পিতা মাওলানা আকিমুদ্দিন সরকারের হাত ধরে। তিনি স্কুল জীবনে ১৯৩৭ সালে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে লেখাপড়া শেষে ভারত পাকিস্তান ভাগ হলে তিনিও সেখানের ছাত্রত্ব শেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে নিজ ভূমিতে ফিরে এসে দেশগড়ার কাজে হাত দেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক শিষ্য হিসেবে দেশে ফিরেই কিছু দিনের মধ্যেই তিনি ক্রমান্বয়ে পূর্ব পাকিস্তান শোষণ করার পাকিস্তানী শাসকদের ষড়যন্ত্র উপলব্ধি করতে শুরু করেন এবং কাল বিলম্ব না করে তাঁর শিক্ষা, মেধা, শ্রম এবং অর্থ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন এ অঞ্চলের মানুষের ভেতর বাঙালী বোধটিকে জাগ্রত করতে। ১৯৪৮ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের (বর্তমান ছাত্রলীগ) সভাপতি দবিরুল ইসলাম দিনাজপুরে রাজনৈতিক সভা থেকে গ্রেফতার হলে, আজিজুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। ১৯৫০ সালে আইনজীবী হিসেবে দিনাজপুর বার কাউন্সিলে যোগদান করে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃত্ব দান করেন। পবরর্তীতে ১৯৬৯-৭২ সাল পর্যন্ত তিনি দিনাজপুর বার কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রট সরকার প্রতিষ্ঠার নির্বাচনে ঘোড়াঘাট থেকে তেঁতুলিয়া প্রায় দুশ’ কিলোমিটারের মতো এই বিস্তৃত অঞ্চলে অক্লান্তভাবে সাংগঠনিক পরিশ্রম করেন এবং একজন সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে এ্যাডভোকেট মোঃ আজিজুর রহমান বৃহত্তর দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বাইসাইকেলে চড়ে, কখনও বাস আবার কখনও গরুর গাড়িতে করে হাতে টিনের বানানো চোঙ্গা নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুুটলেন, পথে পথে ডাকলেন বাঙালীকে। তাঁর আইন পেশা এক রকম লাটে উঠল। নিজের জমির ফসল আর কখনও প্রয়োজনে জমি বিক্রির অর্থে দল আর সংসার চালাতে লাগলেন। সাধারণ মানুষের কাছে সাদা কাগজে বানানো অতিক্ষুদ্র আকারের চাঁদার বইসহ কিছু তরুণদের নিয়ে হাত পাতলেন দলের জন্য চার আনা করে চাঁদা চাইতে। যুদ্ধের শেষ ধাপে দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁও শহরে চূড়ান্ত আঘাত হানার পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য শিলিগুড়ির ভারতীয় ক্যান্টনমেন্টে তিনি জেনারেল জগজিত সিং আরোরার সঙ্গে মিলিত হন। তারই ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অকুতোভয় নেতা মিত্র বাহিনীর অগ্রগামী দলের সঙ্গে ৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলার গৌরবের পতাকা উড়িয়ে দেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা উত্তর সংবিধান তৈরি করার প্রত্যয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) এর মর্যাদার বদলে এমসিএ (কনস্টিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলি অব বাংলাদেশ) হিসেবে সংবিধান প্রণয়নে নিয়োজিত হন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সফল ১৬৭ জন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) এবং ৩০০ জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) মিলিয়ে সংবিধান তৈরি করার প্রত্যয়ে এমসিএ (কনস্টিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলি অব বাংলাদেশ) হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অন্যতম কাণ্ডারি এবং বৃহত্তর দিনাজপুরের সূর্যসন্তান, সর্বস্বত্যাগী অকুতোভয় এই ১৯৯১ সালে ৪ ডিসেম্বর ঘাসিপাড়াস্থ বাসায় ইন্তেকাল করেন। লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক
×