ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলামোটরে মৃত শিশুর শরীরে আঘাতের চিহ্ন নেই, রহস্যের সৃষ্টি

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৭ ডিসেম্বর ২০১৮

বাংলামোটরে মৃত শিশুর শরীরে আঘাতের চিহ্ন নেই, রহস্যের সৃষ্টি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর বাংলা মোটরের এক বাড়ি থেকে আড়াই বছরের নূর সাফায়েতের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তার বাবা নুরুজ্জামান কাজলকে (৩৮) তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এদিকে শিশু সাফায়েতের লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, নিহত শিশু সাফায়েতের শরীরে ধারালো কোন বস্তুর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে কপালে ছোট আঘাতের চিহ্ন ছিল। তা পড়ে গিয়েও হতে পারে। এ নিয়ে শিশু সাফায়েতের মৃত্যু নিয়ে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, শিশু সাফায়েতকে হত্যার অভিযোগে তার বাবা নুরুজ্জামান কাজলের বিরুদ্ধে বুধবার গভীর রাতে শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন মা মালিহা আক্তার প্রিয়া। এ মামলা বৃহস্পতিবার সকালে নুরুজ্জামানকে দশ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই চম্পক চক্রবর্তী। পুলিশের রিমান্ড আবেদনের শুনানি করে ঢাকার মহানগর হাকিম ধীমান চন্দ্র মণ্ডল নুরুজ্জামান কাজলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। অন্যদিকে কাজলের পক্ষে রিমান্ড আবেদনে বিরোধিতা করেন আইনজীবী আবদুস সাত্তার। তিনি বলেন, কাজলের বাড়ি নিজের নামে লিখিয়ে নিতে চাইছিলেন তার স্ত্রী মালিহা। তা না দেয়ায় তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে যান। কাজল দুই সন্তানের অন্তত একজনকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মালিহাকে অনুরোধ করেছিলেন। সেজন্য তাকে পরে উকিল নোটিসও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মালিহা শিশু দুটোকে ওই বাড়িতেই ফেলে রাখেন। শুনানি শেষে বিচারক আসামি নুরুজ্জামান কাজলকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। কাজল শুনানিতে ছেলের মৃত্যুর বিষয়ে কোন কথা বলেননি। তবে আদালতের বাইরে তিনি সাংবাদিকদের সামনে দাবি করেন, ছেলেকে তিনি মারেননি। আগের দিন বিদ্যুতস্পৃষ্ট সাফায়েতের মৃত্যুর কথা বললেও আদালতের বাইরে কাজল সাংবাদিকদের বলেন, তার ছেলের জ্বর হয়েছিল। মারা গেছে ঘুমের মধ্যে। এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে সাফায়েতের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন তিন সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড। ময়নাতদন্ত শেষে বাইরে এসে সাংবাদিকদের সামনে মুখোমুখি হয়ে চিকিৎসক বোর্ডের প্রধান ঢামেক ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডাঃ সোহেল মাহমুদ বলেন, সাফায়েতের শরীরে ধারালো কোন বস্তুর আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কপালে ছোট দুটি আঘাত আছে। তবে তাতে কোন রক্তক্ষরণ হয়নি। এটি পড়ে গিয়ে হতে পারে। সেই আঘাত তার মৃত্যুর জন্য দায়ী কি-না বা কি কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। তা হিস্টোপ্যাথলজির প্রতিবেদন পাওয়ার পর বলা যাবে। এছাড়া তার ব্রেইন ও লিভারে কিছুটা ফোলা পাওয়া গেছে। তবে অপুষ্টি ও অসুস্থতার কারণে এই ফোলা হতে পারে। তার ব্রেইন, লিভার, ব্লাড ও লাংস্ হিস্টোপ্যাথলজিতে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যুতস্পৃষ্টের আলামত নেই। নিহতের পরিবারের সদস্যরা জানান, পরে বিকেলে সাফায়েতের লাশ আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে বুধবার গভীর রাতে সাফায়েতকে হত্যার অভিযোগে তার বাবা নুরুজ্জামান কাজলের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন মা। শাহবাগ থানায় ৩০২ ধারায় হত্যা মামলাটি দায়ের করা হয়। এজাহারে বলা হয়, ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে নুরুজ্জামান কাজলের সঙ্গে বিয়ে হয় প্রিয়ার। বিয়ের কিছুদিন পরই স্বামী মাদকাসক্ত বলে জানতে পারেন তিনি। প্রায় ৫ বছরের সাংসারিক জীবনে কয়েক দফায় স্বামীর অত্যাচারে ঘর ছাড়তে হয়েছে তাকে। সবশেষ তিন মাস আগে স্বামীর নির্যাতনে ঘর ছেড়ে কামরাঙ্গীরচরে বাবার বাসায় ওঠেন প্রিয়া। এই সুযোগে আড়াই বছরের ছেলে সাফায়েতকে হত্যা করে তার বাবা মাদকাসক্ত কাজল। এ ব্যাপারে মামলা বাদী প্রিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার বাবা মোহাম্মদ বশির মোবাইল ধরে। মেয়ে অসুস্থ। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। বশির বলেন, পারিবারিকভাবেই নুরুজ্জামানের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে হয়। কিন্তু এরপর থেকেই আমার মেয়েকে বর্বর নির্যাতনের শিকার হতে হয়। কাজল একজন মাদকাসক্ত। তার আচরণ পাগলের মতো। সে-ই আমার নাতি সাফায়েতকে খুন করেছে। আমার মেয়ে সেখানে থাকলে সেও খুন হয়ে যেত। তবে বিষয়টিকে এখনই হত্যাকাণ্ড বলছে না পুলিশ। নুরুজ্জামান কাজলের পরিবারের সদস্যরা জানান, এলাকায় বেশ সুনাম রয়েছে কাজলের বাবা মনু মেম্বার পরিবারের। কাজলের আচার-আচরণের জন্য পরিবারের সদস্যরা তার ওপর বিরক্ত ছিলেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ওই বাসার দোতলায় থাকতেন কাজল। তার নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মাস খানেক আগে তার স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। স্থানীয় একজন বাসিন্দা আকিল জামান বলেন, কয়েক মাস আগে স্ত্রীকেও মারধর করেন কাজল। প্রতিবেশীরা এসে তার স্ত্রীকে উদ্ধার করেন। নির্যাতন সইতে না পেরে স্ত্রী চলে গেছেন। বাচ্চা দুটো বাবার সঙ্গে ছিল। কাজলের ভাই নুরুল হুদা উজ্জ্বল সে সময় বলেছিলেন, কাজল সারাদিন নেশা করে, খায় আর ঘুমায়। এটা ওর নিজের বাড়ি। এত দিন আমরা সহ্য করছি। পুলিশ আনি নাই। শুধু ওই বাচ্চাগুলোর কারণে। এখন বাচ্চাটাকেই মেরে ফেলছে। কাজলের মার খেয়ে ওর বৌ বাপের বাড়ি চলে গেছে। বাসায় দুই বাচ্চা নিয়ে ও থাকত। আজকে এই কাণ্ড করল। তবে আটক হওয়ার পর কাজল পুলিশের কাছে দাবি করেন, সাফায়েতের মৃত্যু হয়েছে বৈদ্যুতিক শকে। তিনি তাকে হত্যা করেননি।
×