১.
কবি সাযযাদ কাদির ৬ এপ্রিল ২০১৭ চলে গেলেন- আমাদের ছেড়ে! তিনি ১৯৪৭ সালের ১৪ এপ্রিল টাঙ্গাইল জেলার মিরের বেতকা গ্রামে তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুর সংবাদটি শোনার পরও তাঁর শেষযাত্রায় গিয়ে দাঁড়াতে পারিনি প্রেসক্লাবে! তাঁর মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর থেকেই আমি এক হাসপাতালে অস্থির সময় কাটিয়েছি আমার মেয়ের অপারেশনের জন্য, কাটিয়েছি নির্ঘুম রাত, কী এক অস্থির সময় শুক্রবার হয়ে শনিবার অবধি! আর এই সময়ে সাযযাদ ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদটা আমাকে আরও বেদনাবিহ্বল করে রেখেছিল! তাঁর সঙ্গে আমার বহু বছরের জানাশোনা। মৃত্যুর চার-পাঁচদিন আগে আমাকে ফোন করেছিলেন তিনি, আমি একটি শব্দ ব্যবহার করেছিলাম ফেসবুকের এক স্ট্যাটাসে, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুললেন ও আলাপ করলেন, আমি তাঁকে যুক্তি ও রেফারেন্স দিলাম, তখন তিনি মেনে নিলেন। তিনি মাঝে মাঝে ফোন করতেন, কথা বলতেন বিভিন্ন বিষয়ে। সেদিন অন্য আরও কিছু বিষয়ে বলেছিলেন।
জাতীয় কবিতা পরিষদ করেছি একসঙ্গে বহুদিন। তিনি মৃত্যুর আগ অবধি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর সম্পাদিত পত্র-পত্রিকায় আমার লেখা ছাপিয়েছেন অনেক। তিনি ক’বছর কবিতার সংকলন বের করতেন, সেখানেও কবিতা রেখেছেন, প্রবন্ধেও আমার কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। আমি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতাম, সেখান থেকে বহু বছর সাংবাদিকতায় পুরস্কার ও ফেলোশিপ দেয়া হতো। এসব নির্বাচনে তিনি ছিলেন একজন বিচারক, আরও দু’তিনজন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও অধ্যাপকের সঙ্গে। আমি এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কমকর্তা হিসেবে যখনই তাঁকে এ বিষয় ভূমিকা নিতে বলেছি, তখনই তিনি তা আনন্দে গ্রহণ করেছেন। বহু সাংবাদিক এসব পুরস্কার ও ফেলোশিপ পেয়েছিলেন। তাঁর বিভিন্ন কর্মের জায়গায় কতবার গিয়েছি, আড্ডা দিয়েছি। বহু ম্মৃতি ও বহু ঘটনা জড়িয়ে আছে সাযযাদ ভাইকে নিয়ে। এক এক করে সেসব মনে পড়ছে।
মৃত্যুর পর আপনাকে দেখতে যেতে পারিনি, ক্ষমা করবেন সাযযাদ ভাই, যেমন করে ক্ষমা করেছিলেন আপনার সঙ্গে সাতক্ষীরায় এক সাহিত্য সম্মেলনে যেতে চেয়েও যেতে পারিনি, আর এই তো আপনার মৃত্যুর কিছুদিন আগে আপনার এক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আলোচক হওয়ার পরও যেতে পারিনি, ক্ষমা করেছিলেন! আর মৃত্যুর পর আপনাকে দেখতে যেতে পারলাম না, ক্ষমা করবেন নিশ্চয় সাযযাদ ভাই!
রাজনৈতিক সংকীর্ণতার কারণে ও বিভাজনে, সময়ের পরতে পরতে, রাষ্ট্রের ও প্রতিষ্ঠানের পুরস্কার দ্বিধা নিয়ে খ-িত হয়ে যায়, যার ফলে সাযযাদ কাদিরের মত মূলধারার কবি-লেখকরাও হয় এর শিকার, সেটা বেদনামাখা আর এক আখ্যান। সেই বেদনা সাযযাদ ভাইকেও কষ্ট দিয়েছে বলে আমিও অনুভব করেছি!
২.
সাযযাদ কাদির শুধু কবিতাই নয়, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ-গবেষণা, শিশুতোষ, সম্পাদনা, সঙ্কলন, অনুবাদসহ বিভিন্ন বিষয়ে ৬০টির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
সাযযাদ কাদির মূলত কবি, দীর্ঘদিন তাঁর সৃজনশীলতায় কাব্য-সৌন্দর্য উন্মুখ করে রেখেছিলেন। দশক-বিভাজনে তিনি ষাট দশকের কবি। ‘এই যে আমি’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা নিয়ে কিছু বিবেচনাবোধ এখানে তুলে ধরছি। এই কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৯ সালে, ব্যতিক্রম প্রকাশনী থেকে। আরও কিছু কাব্যগ্রন্থ তাঁর উল্লেখযোগ্যÑযথেচ্ছ ধ্রুপদ, রৌদ্রে প্রতিধ্বনি, দূরতমার কাছে, দরজার কাছে নদী, আমার প্রিয় ও অন্যান্য।
‘এই যে আমি’ কাব্যগ্রন্থের নামটি উচ্চারিত হলেই মনে হয় কবি তাঁর আত্মপ্রকৃতির প্রতিভাস নিয়ে যেন পাঠককে এক ভিন্ন জগতে নিয়ে যেতে চান, যে জগতটি কবির একান্ত নিজস্ব বৈভব নিয়ে রচিত। এই গ্রন্থে লক্ষ করিÑস্মৃতিকাতরতা, বিচ্ছিন্ন হওয়া বন্ধুর প্রতি ভালবাসা, প্রেমের আকুলতা নিয়ে একধরনের দহন-কষ্টবোধ, নারীকে দেখার তাৎপর্যময় দৃষ্টিভঙ্গি, ঢাকা নগরের অবস্থানগত অনুভূতি, মৃত্যু-উপলব্ধি, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় চৈতন্য ও কবির আপন মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকবার স্বভাব-সৌন্দর্য। মনে হয়েছেÑএই কাব্যগ্রন্থের কবি হৃদয় বৃত্তিকেই প্রধানত গুরুত্ব দেন। তাঁর এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাÑঅনুভূতি আশ্রয়ী, মগ্নচৈতন্যের কবিতা।
নিজের জগত থেকে উৎসারিত অনুভূতি থেকে তিনি কবিতা নির্মাণ করেছেন। বলা জলে তিনি ব্যক্তি-অনুভূতির কবি, মগ্নচৈতন্যের কবি।
বাংলাদেশে পঞ্চাশ দশক থেকে এ-পর্যন্ত বহু কবির ভূমিকায় এ-ভূখ-ের কবিতার আকাশম-ল রচিত হয়েছে। বর্তমানে আমরা অনেকে আধুনিকতা ও দুবোর্ধ্যতাকে সমার্থক ভেবে কবিতা রচনা করছি, কিন্তু আধুনিকতা-দুবোর্ধ্যতা এক নয় বা সমার্থকও নয়। আবার অনেকে আমরা শুধু শব্দবাহিতাকে আধুনিক কবিতা হিসেবে চিহ্নিত করছি। এই দুটি প্রবণতাই কবিতাকে চোরা¯্রােতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কবিতা বিভ্রান্তির জটাজালেও বন্দী হচ্ছে। কিন্তু কবি সাযযাদ কাদির এই দুটি ক্ষতিকর প্রবণতার বাইরে থেকে কবিতা রচনা করেছেন। তিনি সরল বাক্য-বিন্যাসে, রূপকল্পে-রসকল্পে কবিতা নির্মাণে করতে আন্তরিক থেকেছেন বলে আমার মনে হয়েছে।
আধুনিক কবিতায় অনেক কবি নতুন শব্দ সংযোজন করেন, আবার অনেক কবি প্রচলিত শব্দে নতুন ব্যঞ্জনা আনেন। কবি সাযযাদ কাদির এই আলোচ্য কাব্যগ্রন্থে প্রচলিত শব্দ ব্যবহার করে নতুন ব্যঞ্জনা দিতে সচেষ্ট হয়েছেন। উদাহরণ : ক) আমার চোখ দুটিই ভিজে আছে নিঃশব্দ অশ্রুতে।
( কবিতা : কতদিন পর)
খ) তোমরা আসোনি বইমেলায়, কোনদিন
আসবেও না, কিন্তু আমি তোমাদের হয়ে আছিÑ
থাকব, অন্তত যত দিন চেনা-চেনা থেকে
যাবে আমের বোলের গন্ধ, কামিনী ফুলের
কিংবা ছাতিমের ঘ্রাণ!
( কবিতা : বইমেলায় প্রতিদিন)
গ) তবুও একটি রুগণ শীর্ণ হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে
একা-একা কেমন উঠে যায় আকাশের দিকে!
( কবিতা : আমরা পাঁচজন)
ঘ) এখন সন্ধ্যার বাতাসে মিশে যাওয়া
ক্ষীণ এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়া
আর কিছু নই আমি।
( কবিতা : শিশিরের শরীরে)
ঙ) ধূলিময়, শাহবাগের ধূসরিত আঙিনা থেকে
ওই শব্দগুলোই তোমাকে নিয়ে যাবে
ডনঃসীম নীল নক্ষত্রের প্রান্তরে।
( কবিতা : শব্দগুলো)
কবি সাযযাদ কাদির কবিতায় শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে শব্দকে অসংলগ্ন করে তোলেননি, কুঞ্চিত করেননি কিংবা এবড়ো-থেবড়ো। উল্লিখিত উদাহরণ থেকে তা আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয় না। সাধারণ শব্দও কবিতায় তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে।
আমরা জানি যে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জয়গান থেকে রোমান্টিকতা কবিতায় সম্পর্কিত হয়ে থাকে। এই কাব্যগ্রন্থে কবি সাযযাদ কাদির ক’টি কবিতা লিখেছেনÑরোমান্টিক বোধ থেকে। এসব কবিতায় প্রেম-বিচ্ছিন্ন কষ্টবোধ, স্মৃতিকাতরতা, বন্ধুর প্রতি ভালবাসা, অন্তরের সৌন্দর্য, মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার প্রতিভাস পাঠক হিসেবে হৃদয়তন্ত্রীতে অনুরণন তোলে। এসব কবিতা রোমান্টিকতার নামে বিকার প্রবণতায় আক্রান্ত হয়নি, তথাকথিত যৌনতার নামে হয়নি রুচিহীন ও কামপ্রদ।
উদাহরণÑ ক) এখনও দু’জনে মিলে আবারও ভিজতে চাই
শেষ দুপুরের বৃষ্টিতে,
তোমার পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে এখনও
বসে থাকতে চাই শেষ বিকেলের রোদ
সারা গায়ে মেখে;
শেষ জ্যোৎ¯œার রাতে তুমি আর আমি
এখনও হারিয়ে যেতে চাই আমাদের মনের গহন বনে।
(কবিতা : আমার নিঃশ্বাসে)
খ) ঘুমিয়ে পড়ার আগে জানালাটা খুলে রাখি
সকালের রোদে জাগার আশায়। ভাবি
একটি নতুন দিন
দস্যুর মতো রুটে এসে চমু খাবে দুই ঠোঁটে আমার।
( কবিতা : টেলিফোন)
গ) আসলে তোমার এই মুহূর্তের
ত্রস্ত-ব্যস্ত সলজ্জ-বি¯্রস্ত রূপটি
ফুটি ফুটি করে ফুটে ওঠা
এক নারী-ফুলের।
( কবিতা : নারী-ফুল)
এই নারী-ফুল কবিতাটি এই কাব্যগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা, এই কবিতায় কবি ভিন্ন আঙ্গিক ও বোধে একজন নারীর চিত্রময় বিশেষ অবস্থান সৃষ্টি করেছেন।
তাঁর কবিতা পড়ে পাঠক হিসেবে পাঠস্পৃহা মিটিয়ে সংবেদী হয়ে উঠতে পারি, এমনই কবিতা শুধু এই কাব্যগ্রন্থে নেই, আরও বহু কবিতা রয়েছে তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থেও। অবলোকনের সীমিত সামর্থ্য দিয়ে এই একটি কাব্যগ্রন্থের কবিতার মধ্যে দিয়ে তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থে প্রবেশের আগ্রহ তৈরি করতে একটি সেতু রচনা করা হলো মাত্র।
শীর্ষ সংবাদ: