ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতের অর্ধেক দক্ষতাও এই অস্ট্রেলিয়া দলের মধ্যে নেই ॥ জেফ থমসন

প্রকাশিত: ২০:১১, ৮ ডিসেম্বর ২০১৮

ভারতের অর্ধেক দক্ষতাও এই অস্ট্রেলিয়া দলের মধ্যে নেই ॥ জেফ থমসন

অনলাইন ডেস্ক ॥ কখনও তিনি আগ্রাসী। কখনও ভীষণ আগ্রাসী। কখনও ক্ষিপ্ত, কখনও প্রবল ক্ষিপ্ত। আবার কখনও বা পরোয়াহীন, পরমুহূর্তেই আরও পরোয়াহীন। এখনও যেন নিজের বোলিংয়ের সেই প্রতিমূর্তি তিনি। সামনে যা পড়বে, উড়ে যাবে তাঁর গতির ঝড়ে। এটা বরাবরই এমন এক সাক্ষাৎকার, যেখানে উত্তরদাতা প্রায়ই মাঝপথে প্রশ্নকর্তাকে থামিয়ে দেবেন। হঠাৎ পাল্টা প্রশ্নও ধেয়ে আসার জন্য তৈরি থাকতে হবে। আর বেশ কিছু অস্ট্রেলীয় চলতি ভাষায় ‘স্ল্যাং’ কাটছাঁট করার জন্য তৈরি থাকা। বিরাট কোহলিদের অস্ট্রেলীয় অভিযান শুরুর লগ্নে দীর্ঘ, একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন জেফ থমসন সেই তাঁর পুরনো আগুনে মেজাজে। প্রশ্ন: সকলের মনের প্রশ্নটা দিয়েই শুরু করছি। স্টিভ স্মিথ ও ডেভিড ওয়ার্নারকে ছাড়া অস্ট্রেলিয়া। এ কেমন অস্ট্রেলিয়া? জেফ থমসন: শুনুন ভাই, আমাদের ব্যাটিংটার একদম বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে আছে। ভীষণ, ভীষণ দুর্বল একটা ব্যাটিং লাইন আপ। ছন্নছাড়া অবস্থায় রয়েছে। স্মিথ আর ওয়ার্নার না থাকাতেই এটা হচ্ছে। নিজেদের দক্ষতায় বিশ্বের অন্যতম সেরা দুই ব্যাটসম্যান হয়ে উঠেছিল ওরা। এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া দলের হয়ে যাদের ব্যাট হাতে নামতে দেখছি, তাদের মধ্যে কারও ওই দু’জনের অভাব পূরণ করার ক্ষমতা আছে বলে তো আমি অন্তত বলতে পারছি না। প্র: তার মানে এই অস্ট্রেলিয়া... থমসন (থামিয়ে দিয়ে): দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমাকে বলতে দিন (শুনে মনে হল, আপনি-টাপনি নয় তুই করে বললেন)...আপনাদের ব্যাটিং আমাদের চেয়ে অনেক, অনেক শক্তিশালী। ভারতের ব্যাটিং লাইন আপে উৎকর্ষ আছে। বড় নাম আছে। আমি তো বলব, ব্যাটিংয়ে ভারতের অর্ধেক শক্তি বা দক্ষতাও এই অস্ট্রেলিয়া দলে নেই। এই যে ছেলেটাকে নিয়েছে... হ্যাঁ, অ্যারন ফিঞ্চ। ওকে কেন নিয়েছে কে জানে! ওর টেস্ট ক্রিকেট খেলার দক্ষতাই নেই। আমার মনে হয়, শন মার্শ ভাল প্রতিভা। কিন্তু বাকিরা কতটা কী অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলে জায়গা পাওয়ার যোগ্য, আমার যথেষ্ট সন্দেহ থাকছে। ভারতীয় শিবিরে লড়াইটা নিয়ে যেতে পারে এমন কোনও ব্যাটসম্যান আমি এই অস্ট্রেলিয়া দলে দেখছি না। প্র: দু’দলের গুণগত মান নিয়ে আর কী বলতে চাইবেন আপনি? থমসন: ভারতের বোলিংও যথেষ্ট ভাল। পেস এবং স্পিন দু’টো বিভাগেই বেশ শক্তিশালী। সেই কারণেই আরও বেশি করে আমাদের ব্যাটিংটা পাকাপোক্ত হওয়ার দরকার ছিল। অস্ট্রেলীয়রা ঐতিহাসিক ভাবে পেস ও বাউন্সের বিরুদ্ধে ভাল খেলে। কারণ, আমাদের এখানকার উইকেট সে রকমই হয়। কিন্তু কাজের কথাটা কী জানেন তো, পেস খেলুন বা স্পিন, ফুটওয়ার্কটা লাগবে। এখানে ফ্রন্টফুটের চেয়ে ব্যাকফুট প্লে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আসল হচ্ছে দেরিতে খেলা, বলের পিছনে এসে খেলা। যাক গে, এত সব গুরুগম্ভীর ব্যাপার স্যাপার আমি এই দলের ব্যাটসম্যানদের থেকে আশা করছি না। বল হাতে আমাকে লোকে নির্দয় ব্যক্তি বলেই চিনত। নির্মম সত্যিটা বলেই দিই। ভারতের অর্ধেক যোগ্যতা বা দক্ষতাও এই অস্ট্রেলিয়া দলের মধ্যে নেই। এখানে রান করতে গেলে টেকনিক দরকার। সাহসও দরকার। ব্যতিক্রম আছে। যেমন বীরেন্দ্র সেহবাগ। টেকনিক নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও অস্ট্রেলিয়ায় এসে রান করে গিয়েছে। কারণ ডাকাবুকো মনোভাব। তা আমি কোনওটাই বাপু দেখত পাচ্ছি না অস্ট্রেলিয়ার এই দলে। প্র: জোর বিতর্কও তো চলল যে, স্মিথ আর ওয়ার্নারকে ফেরানো উচিত কি না। আপনার কী মত? থমসন: এত তর্ক চলছিল কেন, সেটাই তো বুঝলাম না। আমার কিন্তু এক বারের জন্য মনে হয়নি, স্মিথ আর ওয়ার্নার ভারতের বিরুদ্ধে ফিরতে পারে। এত বড় ঘটনার পরে কী করে ফিরবে? ভুগছে দলটা। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যদি আমি একটা বিশ্ব একাদশ বানাই, অস্ট্রেলিয়া থেকে একটাও ব্যাটসম্যান থাকবে! এমনকি, দ্বিতীয় বিশ্ব একাদশ গড়লে তাতেও কেউ জায়গা পাবে কি না, সন্দেহ। অথচ, বিশ্ব ক্রিকেটে ধারাবাহিক ভাবে কী সব ব্যাটিং মহাতারকা উপহার দিয়েছি আমরা! প্র: এখন বল-বিকৃতি করার দরকার পড়ছেই বা কেন? আপনাদের সময়ে এত সব ভয়ঙ্কর ফাস্ট বোলার ছিল। তাদের দর্শনই ছিল, হয় উইকেট নেব নয়তো ব্যাটসম্যানের মাথা। প্রতারণা তো করতেন না কেউ। থমসন: হাতে বল আছে তোমার। ওটাই তো কথা বলবে। আসলে আমাদের সময়ে পেস আর সুইংয়ের উপর অনেক বেশি জোর দেওয়া হত। সুইং বলতে আমি বলছি নতুন বলে সুইং। মানে প্রথাগত সুইং যেটা। এখন এদিক-ওদিক শুনতে পাই যে, বোলাররা নাকি তাড়াতাড়ি পালিশ তুলে দিতে চায়। যাতে পুরনো বলে রিভার্স সুইং করাতে পারে। এ আবার কেমন স্ট্র্যাটেজি কে জানে! আমি তো নতুন বল হাতে নিয়ে ব্যাটসম্যানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলতাম, আয় এ বার দেখি তোর কত বুকের পাটা। নতুন বল গোলার মতো ছুটবে। তখনই তো ব্যাটসম্যানের রিফ্লেক্সের পরীক্ষা নেব। দক্ষতার পরীক্ষা নেব। টেকনিকের পরীক্ষা নেব। তা না, এখনকার বোলাররা নাকি নতুন বল পেয়েই খালি ঘষে। পালিশ তোলে। আর অপেক্ষা করে কখন বল পুরনো হবে। গোলমেলে, খুবই গোলমেলে ব্যাপার। আমার অত ধৈর্য ছিল না যে, অন্যরা বল ‘বানিয়ে’ দেবে আর আমি সেটা হাতে পেয়ে কেরামতি দেখাব। প্র: অস্ট্রেলিয়ার স্লেজিং নীতি নিয়েও তোলপাড় চলছে। স্লেজিং করব কি করব না? আপনি কোন দিকে? থমসন: সত্যি, এগুলোর খেয়েদেয়ে কাজ নেই আর। এটাও একটা তর্ক করার মতো বিষয় হল? সে দিন সংবাদপত্রে দেখলাম, মাইকেল ক্লার্ক আর ম্যাথু হেডেন মন্তব্য করেছে, আমাদের ছেলেদের আক্রমণাত্মক হওয়া উচিত। সরি, কী হতে হবে ভাই? আমি ঠিক বুঝলাম না। তোমার হাতে তো বল আছে। ওটাকেই কথা বলাও না। মুখে কথা বলে কে আর কবে কটা উইকেট তুলতে পেরেছে? আমাদের এই ক্রিকেটারগুলোকে বোঝানো দরকার যে, এটা ব্যাট ও বলের লড়াই। দু’টো বেয়াদপের মুখের তরজার জায়গা নয়। আমাদের সময়কার দর্শন ছিল, মুখে কথা বলার কী দরকার যখন হাতে তোমার বলটাই আছে! এখন দেখছি উল্টো হয়ে গিয়েছে। কী না কি, কথার যুদ্ধে হারিয়ে দিলেই ম্যাচ জেতা হয়ে যাবে! কী সব আজগুবি ব্যাপার। অন্যকে অসম্মান করে কখনও সম্মান পাওয়া যায় না। এটা মনে রাখা দরকার সকলের। প্র: অস্ট্রেলিয়ার এই বল-বিকৃতির ঘটনাটা নিয়ে আপনার বক্তব্য কী? থমসন: হতাশজনক বললেও কিছুই বলা হয় না। মনে হয়েছিল, কতগুলো নির্বোধকে দেখছিলাম। কারও যদি মনে হয়, সকলের চোখের সামনে বলটাকে নখ দিয়ে খুঁটে বা শিরিস কাগজ দিয়ে ঘষে লোকের চোখে ধুলো দেবে, তা হলে নিজেকে একটু বেশিই স্মার্ট ভেবে ফেলেছে। টিভি-তে দেখতে দেখতে আমিই বলে ফেলছিলাম, ওরা করছেটা কী? সারা বিশ্বের সামনে এ ভাবেও নিজেকে একটা গাধা প্রতিপন্ন করা যায়! কী ভাবছিল ওরা? অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস না কি অতিরিক্ত ঔদ্ধত্য? আমরা সকলে এত দিনে জেনে গিয়েছি যে, বল-বিকৃতি মহাবিদ্যা, যদি না পড়ো ধরা। এটার জন্য নিশ্চয়ই আমার পাকিস্তানের বোলার বন্ধুদের অনেক অবদান আছে। ১৫-২০ বছর ধরে পাকিস্তান রিভার্স সুইংয়ের শিল্পকে আয়ত্ত্বে এনেছে। রিভার্স সুইং করাতে গেলে বলটাকে যে ‘বানাতে’ হবে, সেটাও এখন ওপেন সিক্রেট। তা বলে ভর দুপুরে কেউ যদি চোখের সামনে শিরিস কাগজ দিয়ে বল ঘষে, তা হলে বুঝতে হবে গর্ধবটার মাথায় ঘোর গন্ডগোল আছে। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সৌজন্যে ব্যাপারটা আরও ঘোঁট পাকিয়ে গেল। আসলে টিভি-তে সারা বিশ্ব যে দেখল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারেরা এমন কেলেঙ্কারি ঘটাচ্ছে, সেটাই আমাদের দেশের মানুষ মেনে নিতে পারেনি। স্বাভাবিক, কী ভাবেই বা মেনে নেওয়া যায়! সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
×