ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সত্তরে রঙিন চারুকলা

হেমন্ত সকালে বকুলতলায় শিল্পী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আড্ডা

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১১ ডিসেম্বর ২০১৮

হেমন্ত সকালে বকুলতলায় শিল্পী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আড্ডা

মনোয়ার হোসেন ॥ বয়সে বাড়ে মানুষের মলিনতা। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ঘটে উল্টোটা। মলিনতা কমার বদলে বেড়ে যায় জৌলুস। বয়স বৃদ্ধিতে যুক্ত হয় বর্ণিলতা। সেই রঙিন রূপেরই দেখা মিলল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। উপলক্ষ ছিল শিল্পাচার্য জয়নুলের স্মৃতিধন্য চারুশিল্প চর্চা ও আন্দোলনের অগ্রণী প্রতিষ্ঠানটির ৭০ বছর পূর্তি। ১৯৪৮ সালে যাত্রা করা প্রতিষ্ঠানটি এ বছর পা রেখেছে সত্তর বছরে। সোমবার হালকা শীতল হেমন্ত সকালে বকুলতলায় বসেছিল সেই উদ্যাপনের আয়োজন। আড্ডার টানে সেখানে বর্তমান চারুশিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জড়ো হয়েছিলেন সাবেক শিক্ষক শিল্পী ও শিক্ষার্থীরা। ছবি তুলেছেন একে অপরের সঙ্গে। কখনও বা এক ফ্রেমে বন্দী হয়েছেন সকলে মিলে। স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে পুরনো সেই দিনের কথা; ব্যক্ত হয়েছে আগামীর পানে এগিয়ে চলার প্রত্যয়। সব মিলিয়ে একরাশ আনন্দের উৎস। প্রাণের স্পন্দনে উদ্দীপ্ত হয়েছে বৃক্ষ-লতায় আবৃত সবুজ আঙিনাখানি। চারুকলার ৭০ বছরকে স্মরণীয় করে রাখতে জয়নুল গ্যালারিতে আয়োজন করা হয়েছে অনন্য এক প্রদর্শনী। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসান, শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদসহ অনুষদের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষক-শিল্পীদের রং-তুলির আঁচড়মাখা ক্যানভাসগুলো ঝুলছে প্রদর্শনালয়ের চারপাশজুড়ে। সেই সঙ্গে আয়োজনে মাহাত্ম্য বাড়িয়েছে দেশের শিল্পকলার অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পাঁচ কিংবদন্তি শিল্পীকে সম্মাননা প্রদান। সম্মাননাপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পীরা হলেনÑ মুর্তজা বশীর, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, মুস্তাফা মনোয়ার, সমরজিৎ রায় চৌধুরী ও রফিকুন নবী। রবীন্দ্রনাথের সুরের আশ্রয়ে সূচনা হয় পত্র-পল্লবে বেষ্টিত বকুলতলার অনুষ্ঠান। চারুশিক্ষকদের সঙ্গে পরিবেশনার সঙ্গী হয়েছে শিক্ষার্থীরা। গুরু-শিষ্যরা এক সুরে গেয়েছেনÑ আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর/মহিমা তব উদ্ভাসিত মহাগগনমাঝে ...। গান শেষে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছেলে প্রকৌশলী ময়নুল আবেদিন। সভাপতিত্ব করেন অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন। স্বাগত বক্তব্য দেন প্রদর্শনী উপকমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনুস। বাংলাদেশের শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের জন্য সম্মাননাপ্রাপ্ত সৈয়দ জাহাঙ্গীর, মুস্তাফা মনোয়ার, রফিকুন নবী ও সমরজিৎ রায় চৌধুরীর হাতে স্মারক তুলে দেন মোঃ আখতারুজ্জামান। মুর্তজা বশীর উপস্থিত না থাকায় তার পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন মোহাম্মদ ইউনুস। অনুভুক্ত প্রকাশে অনুষদের যাত্রা শুরুর দিনগুলোয় ফিরে যান সৈয়দ জাহাঙ্গীর। বলেন, আমি ছিলাম চারুকলা অনুষদের তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র। ভর্তি হয়েছিলাম ১৯৫০ সালে। তখন জনসন রোডের এক বাড়ির দুই কামরায় চলতো চারুকলার অনুষদের শিক্ষা কার্যক্রম। আমরা ছাত্ররা বসতাম এক কামরায়, আরেক কামরায় বসতেন শিক্ষকরা। সেসময় একদিন একটি মুরগির ছবি আঁকছিলাম। কিছুতেই মুরগির পাটা শরীরের সঙ্গে যুক্ত করতে পারছিলাম না। এগিয়ে এলেন জয়নুল আবেদিন। বললেন, একটা মুরগির ঠ্যাং আঁকতে পারছো না? এই বলে দ্রুত টানের কয়েকটি রেখার সাহায্যে মুরগির শরীরে জুড়ে দিলেন পা। বিস্মিত হলাম তার আঁকার ধরন দেখে। এটুকু স্মৃতিকথার পর শিল্পী বলেন, যখন চারুকলা থেকে পাস করে বের হলাম তখন পড়লাম আরেক বিপদে। কারণ, তখনো আঁকাআঁকির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের পথটি তৈরি হয়নি। আমাদের কেউ চলে গেল শিক্ষকতা পেশায়, কেউ বা বেছে নিলেন অন্য পেশা। কিন্তু আমি লেগে থাকলাম। পাস করার পর ১৯৫৮ সাল থেকে শুধু ছবি এঁকেই কাটিয়ে দিলাম গোটা জীবন। অনুভূতি প্রকাশে সমরজিৎ রায় চৌধুরীও ফিরে যান অতীতে। বলেন, ১৯৫৫ সালে আমি ভর্তি হয়েছিলাম চারুকলায়। তখন প্রতিষ্ঠানটি ছিল সেগুন বাগিচায়। ১৯৫৬ সালে সেগুন বাগিচা থেকে অনুষদ স্থানান্তরিত হয় বর্তমানের এই আঙ্গিনায়। আর চারুশিক্ষার শুরু থেকেই শিল্পাচার্যের সঙ্গে সম্পর্কে সখ্য গড়েছিলাম। তার আশীর্বাদেই আজ এত দূর এলাম। অনুষদের নান্দনিক কাঠামো প্রসঙ্গে এই শিল্পী বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটি গড়তে জয়নুল আবেদিন শরণাপন্ন হয়েছিলেন স্থাপতি মাযহারুল ইসলামের। তার অনন্য সুন্দর নক্সার কারণেই দারুণ দৃষ্টিনন্দন রূপ পেয়েছে এই অনুষদ। কথার পিঠে কথা জুড়ে দিয়ে এই শিল্পী আরও বলেন, ৭০ বছরের আয়োজনটি যখন এত সুন্দর হয়েছে, শত বছর পূর্তির আয়োজনটি নিশ্চয় আরও সুন্দর হবে। রফিকুন নবী বলেন, চারুকলাকে ঘিরে আমার এত স্মৃতি যে শুরু করলে বলে শেষ করা সম্ভব নয়। যার মধ্যে সবচেয়ে মধুর স্মৃতি ১৯৬৪ সালে শিল্পাচার্যের সঙ্গে যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নেয়া। ১৬ শিল্পীর ওই প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল ‘সিক্সটিন পেইন্টার শো’। এই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে আমার ছয় বছরের শিক্ষার্থী জীবন আর চুয়ান্ন বছরের শিক্ষকতাÑ সব মিলিয়ে মিলিয়ে চারুকলার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ৬০ বছরের। নিসার হোসেন বলেন, পৃথিবীর আর কোন অনুষদের শিক্ষকদের এত অর্জন নেই, যতটা রয়েছে এই অনুষদের শিক্ষকদের। কথা প্রসঙ্গে তিনি তিনি জানান, আগামী ২৫ থেকে ২৯ ডিসেম্বর পঁাঁচ দিন জয়নুল উৎসব অনুষ্ঠিত হবে চারুকলায়। প্রধান অতিথির বক্তব্যে আখতারুজ্জামান বলেন, আজকে যারা সম্মাননা পেলেন তারা চারুকলার তারুণ্যের ঐতিহ্যকে তুলে ধরলেন। তারা প্রত্যেকেই শিল্পাচার্যে হাত ধরে আজকের এই অবস্থানে এসেছেন। তাদের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে অনেক শিক্ষক ও শিল্পী। সামনের দিনগুলোতে এ অনুষদের মাধ্যমে নিরীক্ষামূলক ও গবেষণাধর্মী কাজ বাড়াতে হবে। লিয়াকত আলী লাকী বলেন, জনসন রোড থেকে সেগুন বাগিচা ঘুরে আজ শাহবাগে জায়গা করে নিয়েছে চারুকলা। এর পুরোটা সময়জুড়েই ছিল শিল্প আন্দোলন। যার পথ ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। লুভা নাহিদ চৌধুরী, চারুকলার প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার গৌরবময় অধ্যায়ের ৭০ বছর পূর্ণ হলো। এই প্রতিষ্ঠানের শুরুর ৩৫ বছরই কেটেছে আন্দোলন সংগ্রামে। সেখান থেকে বের হয়ে আসা শিল্প চেতনা ধারণ করেই এগিয়ে যাচ্ছে এই অনুষদ। এদেশের মানুষের মানস ও রুচি গঠনে এই প্রতিষ্ঠানের অবদান অসামান্য। অনুষদের ১ ও ২নং জয়নুল গ্যালারিতে দর্শনার্থীদের জন্য মেলে ধরা হয়েছে সাবেক ও বর্তমান বরেণ্য শিক্ষক-শিল্পীদের চিত্রকর্ম। তাদের মধ্যে প্রতিষ্ঠানকালীন সাত শিক্ষকের ছবি রয়েছে। তারা হলেনÑ জয়নুল আবেদিন, আনোয়ারুল হক, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, শফিকুল হাসান, সৈয়দ আহসান ও হাবিবুর রহমান জমদার। এছাড়া বরেণ্য শিল্পী-শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে কাইয়ূম চৌধুরী, মোহাম্মদ কিবরিয়া, আমিনুল ইসলাম, রশিদ চৌধুরী, আব্দুস শাকুর শাহ, রোকেয়া সুলতানা, মুস্তাফা মনোয়ার, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, রফিকুন নবী, হামিদুজ্জামান খান, মনিরুল ইসলাম, ফরিদা জামানসহ খ্যাতিমান চিত্রকর ও ভাস্করদের শিল্পকর্ম। শিল্পরসিকের নয়নে মুগ্ধতা ছড়ানো এই প্রদর্শনী চলবে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে এই শিল্পায়োজন।
×