ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লাল গ্রহে অনুসন্ধানের স্বপ্ন নিয়ে মঙ্গল তরী

প্রকাশিত: ০৮:২৭, ১১ ডিসেম্বর ২০১৮

লাল গ্রহে অনুসন্ধানের স্বপ্ন নিয়ে মঙ্গল তরী

প্রতিবেশীকে নিয়ে কৌতূহল মানবজাতির জন্মগত। চাঁদে বেড়িয়ে আসার পর নজর এবার মঙ্গলে। এই কয়েকদিন আগেই মঙ্গলে গিয়ে হাজির হয়েছে নাসার ইনসাইট। রোবটটি মঙ্গল গর্ভের রহস্যভেদ করবে বলে আশাবাদী নাসা। কেমন হবে যদি লাল গ্রহে কোন রোবট লাল সবুজের পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়? আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে স্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্ন থেকেই যে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। সে রকমই কয়েকজন স্বপ্নবাজের দেখা মিলল ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মঙ্গল তরী’ দলে। কয়েকজন তরুণ স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন বাংলাদেশের নাম পৌঁছে যাবে মঙ্গলে। তার পরই যাত্রা শুরু ‘মঙ্গল তরী’র। এ বছরই নাসার ইউএসএ মার্স সোসাইটি আয়োজিত রোবোটিক প্রতিযোগিতা থেকে ১৩তম স্থান অর্জন করে ফেরার পর সেই স্বপ্ন যেন ভালভাবেই ডানা মেলেছে। এই প্রতিযোগিতাকে বিশ্বের অন্যতম কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং প্রতিযোগিতা হিসেবে ধরা হয়। এই দলটিতে আছেন জহিরুল, আলি আহসান, রাজীন, শায়ান্তন, কামরুজ্জামান, জারিফ, সোয়েব, রওশনি, মাহাবুব, রাগিব, ইখওয়ান, ফাহিম, মাসরুর, ফারিহা, তারিন, মেহজাবিন, নওশিন, গাজী মুসা, জাবের এবং মনির। ‘মঙ্গল তরী’ দলটির সাক্ষাতকারে তাদের গল্প তুলে ধরেছেনÑ সারতাজ আলীম ডি-প্রজন্ম : ‘মঙ্গল তরী’র যাত্রা শুরু কীভাবে? রাজীন : মঙ্গল তরীর যাত্রা শুরু হয় ২০১৫ থেকে। তখনকার বেশ ক’জন শিক্ষার্থী খলিলুর রহমান স্যারকে জানান যে, তারা নাসার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে চায়। প্রথমে খুব সহযোগিতা না পেলেও অনেক চেষ্টার পর একটা দল অংশ নেয় কিন্তু বাদ পড়ে যায় বাছাই পর্ব থেকেই। পরের বছরও একই ঘটনা। এর পর ২০১৭ সালে আসে সাফল্য। মূল পর্বে ১৮তম। ডি-প্রজন্ম : এখন পর্যন্ত কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে? সোয়েব : এখন পর্যন্ত আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ফান্ড। ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জে সারা বিশ্ব থেকে ৮০টির বেশি দল অংশ নেয়। তাদের সবারই থাকে বেশ ভাল স্পন্সর। ফাইনাল পর্যন্ত একটা ভাল রকম সহযোগিতার দরকার হয়। এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ই আমাদের স্পন্সর করে থাকে, দেশে রোবটিক্স নিয়ে কাজ করে তেমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই। এ ছাড়াও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো রোবটের চেয়ে কনসার্ট স্পন্সর করতে বেশি আগ্রহী। খুচরা যন্ত্রপাতি পেতেও সমস্যায় পড়তে হয়। অন্য দেশে উন্নতমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার হলেও আমাদের সেটা রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং করে বানাতে হয়। বাইরে থেকে আনতে গেলেও প্রচুর অর্থ চলে যায় তাতে। তবু এত কিছুর পর লাল সবুজের পতাকা যখন বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে ওড়ে তখন মনে হয় আমরাও পারি। মেহজাবিন : নারী হিসেবে কোন চ্যালেঞ্জেই পড়তে হয়নি। আমি বলব কৌতূহল এবং উৎসাহ থাকাই আসল ব্যাপার। খলিল স্যার, সাইফুল স্যার আমাদের যোগ্যতা দিয়েই আমাদের মেপেছেন সব সময়। ডি-প্রজন্ম : ‘মঙ্গল তরী’র কাছে সফলতার অর্থ কী? জারিফ : আমাদের প্রধান এ্যাডভাইজর, খলিলুর রহমান স্যার, সফলতার সংজ্ঞাÑ একটি পাথরের উদাহরণ দিয়ে বর্ণনা দিয়েছেন। একটি পাথরকে ঠেলে যদি আমি এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নিতে পারি, তবেই আমি সফল (কাজ হয়েছে)। যতক্ষণ না পাথর নড়ছে কিংবা সরছে, যত পরিশ্রমই করি না কেন আমি ততক্ষণ পর্যন্ত সফল নই (কাজ এর পরিমাণ শূন্য)। আমাদের পুরো দলটিও এমনই ভাবনা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এটাকেই সফলতার সংজ্ঞা ধরে আগাই আমরা। ডি-প্রজন্ম : ইউএসএ মার্স সোসাইটির রোবোটিক প্রতিযোগিতার বিশেষত্ব কী? রাজীন : ইউএসএ মার্স সোসাইটির রোবোটিক প্রতিযোগিতা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অন্যতম সেরা প্রতিযোগিতা বলে বিবেচিত হয়। এখানে ৫০ কেজি ওজনের একটি রোবটকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় ১ কিমি দূর থেকে। রোবট নিজে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার একটি সুবিধাও রাখতে হয় এখানে। সব মিলে রোবটকে ৪ ধরনের কাজ করতে হয়। ডি-প্রজন্ম : আপনাদের সম্প্রতি নির্মাণ করা রোবটে কী কী ফিচার আছে? মাহাবুব : নভোচারীরা এটাকে বেসে বসে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে রোবট নিজেই একটির পর আরেকটি গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে। মাটির নমুনা সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ করার ব্যবস্থাও আছে এতে। অণুজীবের অস্তিত্ব থেকে প্রাণের স্পন্দন খুঁজে বের করতে পারবে রোবটটি। ৫ কেজি নমুনা নিয়ে রোবটটি নিজেই বেসে ফিরতে পারবে এবং ৩ ফুট পর্যন্ত উঁচু ঢাল বেয়ে নামতে পারবে। ডি-প্রজন্ম : রোবোটিক্সে বাংলাদেশের সম্ভাবনা... নওশিন : শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা এবং পুরস্কার অর্জনের জন্য যাচ্ছে। বর্তমানে কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা এই ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখাচ্ছে। হাতে নির্মাণ করা রোবটকে কাজ করতে দেখা তো সত্যিই দুর্দান্ত। আমরা একটি কলেজে ২/৩ বার বিজ্ঞান মেলায় গিয়েছিলাম এবং বাচ্চাদের রোবোটিক্সের উৎসাহ দেখে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছি। তাই নতুন মুখগুলো প্রশিক্ষিত এবং সঠিকভাবে পরিচর্যা করা হলেই কেবল বাংলাদেশ এক্ষেত্রে উজ্জ্বল ভবিষ্যত পাবে। ডি-প্রজন্ম : ‘মঙ্গল তরী’ নতুন কী ধরনের কার্যক্রম নিচ্ছে বা সামনের দিনগুলোতে আপনাদের পরিকল্পনা কী? জারিফ : এই মুহূর্তে আমরা আমাদের পরবর্তী প্রতিযোগিতা ইউআরসি ২০১৯ এর জন্য প্রস্তুত হচ্ছি এবং সম্পূর্ণ নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে এটি পুনরায় ডিজাইন করছি। এ ছাড়াও নজরদারি রোবট, খামার, আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ রোবট প্রভৃতি বহুমুখী রোবটগুলোতেও মনোযোগ দিচ্ছি। সরকার এবং বেসরকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করারও চেষ্টা করছি আমরা। আমরা সব উৎসাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একত্রে কাজ করার স্বপ্ন দেখছি। এ ছাড়াও যন্ত্রাংশ তৈরি করতে আমরা একটি ল্যাবরেটরির কথা ভাবছি যদিও এই জন্য সহয়তা দরকার। ডি-প্রজন্ম : কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান? জারিফ : আমরা একটি বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছি যেখানে প্রত্যেকে স্বপ্ন দেখতে পারবে এবং সেই অনুযায়ী তার কর্মজীবনে যাবার সুযোগ থাকবে। আমরা আশা করছি যে আমাদের দেশে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করবে, যা আমরা পৃথকভাবে করতে পারব না। এভাবে আমরা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অন্যের ওপর কম নির্ভরশীল হব, আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি সম্প্রদায়ের সঙ্গে একত্রে কাজ করব এবং এই উন্মুক্ত ক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম হব। ডি-প্রজন্ম : তারুণ্যের কাছে প্রত্যাশা... রাজীন : প্রত্যেকের মনে রাখা উচিত আমার স্বপ্নটি সবার জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। তাই পরিবেশের ক্ষতি নয় এমন কিছু না করে সবার কল্যাণে আসতে পারে এমন কাজে মনোযোগ দেয়া উচিত। তরুণদের অবশ্যই মনে রাখা উচিত তাদের কাজই তাদের দেশকে একদিন গর্বিত করতে পারে। এ ছাড়াও অন্যদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে এবং জ্ঞান ভাগাভাগি করতে হবে। ডি-প্রজন্ম : তৃণমূল পর্যায়ে রোবোটিক্স জনপ্রিয় করতে আপনাদের কোন পরিকল্পনা আছে কী? সোয়েব : বিভিন্ন স্কুল-কলেজের বিজ্ঞান মেলায় আমরা আমাদের রোবট নিয়ে যাই যার ফলে শিক্ষার্থীরা অনুপ্রেরণা পায়। ২০১৭ সালে বিএএফ শাহীন এবং ২০১৮ সালে নটর ডেম কলেজে যাবার পর অনেকেই চমকে উঠেছিল এ রকম কিছু দেশেও সম্ভব। এ ছাড়াও ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ২০১৭, স্পেস উইক ২০১৮তেও আমরা অংশ নিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাগতদের নিয়ে আমরা ফ্রি সেমিনারও করে থাকি। ভবিষ্যতে বিস্তৃত করার লক্ষ্য আছে।
×