ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আকিল জামান ইনু

নার্গিস তারাকির পথচলা...

প্রকাশিত: ০৮:২৯, ১১ ডিসেম্বর ২০১৮

নার্গিস তারাকির পথচলা...

১৯৯৭ এ আমি যখন পৃথিবীর আলোয় প্রথম চোখ মেলি পরিবারের পঞ্চম কন্যাশিশু হিসেবে তখনকার অবস্থা ভাবতে এখনও আমার কষ্ট হয়। জন্মের পর পরই আত্মীয়রা আমার মায়ের ওপর চাপ দেয় পিতার দ্বিতীয় বিয়েতে সম্মতি প্রদান করতে। আফগানিস্তানে পুরুষদের জন্য ২-৩টি বিয়ে অস্বাভাবিক কোন বিষয় নয়। অনেকেই এমনটা করে থাকেন পুত্রসন্তান লাভের আশায়। মা অনুমতি না দেয়ায় তারা যে প্রস্তাবটি দেয় সেটি আরও অদ্ভুত। এবার বাবার কাছে তাদের প্রস্তাব ছিল হাসপাতালে কোন ছেলে শিশুর সঙ্গে আমাকে বদলে নেয়ার। খুঁজে পেতে তারা একটি পরিবার বেড় করে যারা এতে সম্মত। আমার বাবা তাদের সে প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন। একুশ বছরে পা দিয়ে নার্গিস আজ অভিভাবকদের আস্থার প্রতিদান দিতে চান। ২০১৮ তে বিবিসির নির্বাচিত ১০০ নারীর তালিকায় ঠাঁই করে নেয়া তরুণ নার্গিস তারাকি এভাবেই জানালেন তার গল্প। আফগানিস্তানে পরিবারের রুটিরুজির কথা ভেবে কন্যার চেয়ে পুত্রকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। কোন পুত্র না থাকায় আমার মাকে অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে হয়েছে। কিন্তু আমার বাবা ছিলেন ভিন্ন মানসিকতার, তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন তিনি আমাদের ভালবাসেন। তার বিশ্বাস ছিল একটা ছেলের পক্ষে যা সম্ভব মেয়েরাও তা পারবে। বাবার জন্যও সময়টা সহজ ছিল না। ধর্মীয় উগ্রবাদের প্রভাব বাড়ছিল। প্রতিবেশীরা দূরত্ব রেখে চলত। বাবা ছিলেন তার অবস্থানে অনড়। ১৯৯৮ এ তালেবানরা এলাকার দখল নিলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। বাবাকে পালিয়ে যেতে হয় পাকিস্তানে। কিছুদিন পর আমরাও তার সঙ্গে যোগ দিই। সেখানে জীবন ছিল কঠিন; বাবা একটি জুতার দোকানে কাজ করতেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল আমার ভাইয়ের জন্ম। ২০০১ এ তালেবান শাসনের অবসান ঘটলে আমরা দেশে ফিরি। আমাদের থাকার মতো কোন বাড়ি ছিল না, চাচার বাসায় আশ্রয় নেই। সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমাকে আর আমার বোনকে স্কুলে যেতে হয়েছে। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে আমি স্নাতক সম্পন্ন করি। কয়েক বছর আগে বোনকে সঙ্গে নিয়ে কাবুল স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ম্যাচ দেখাকালীন আমাদের ছবি, ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ব্যস, শুরু হলো বিরূপ সমালোচনা। পুরুষভর্তি স্টেডিয়ামে আমাদের উপস্থিতির কারণে আমাদের বলা হয় নির্লজ্জ। এমনকি মার্কিন দালাল পর্যন্ত বলা হয়। আমার বাবা ফেসবুকের মন্তব্য দেখে বলেছিলেন, তোমরা ঠিক কাজটিই করেছ। এসব নির্বোধের মন্তব্যে কান দেয়ার প্রয়োজন নেই। জীবনটা ছোট, যতটা পার উপভোগ কর। এ বছরের শুরুতে বাবা ক্যান্সারে ভুগে মারা যান। তিন বছর আগে আমি আমাদের পাশের গ্রামে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল চালুর পরিকল্পনা করি। সে কথা বাবাকে জানালে বাবা বলেন, বিষয়টি বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় অসম্ভব। এমনকি ছেলেদের স্কুল চালুও সম্ভব নয়। বরং মাদ্রাসা জাতীয় কিছু করতে চাইলে সেটি সম্ভব হতে পারে। শেষ পর্যন্ত স্কুল চালু তো দূরে থাক আমি সে গ্রামে প্রবেশ পর্যন্ত করতে পারিনি। তবে আমি এখনও আশা ছাড়িনি। এ সময়ে আমি নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ক্ষমতায়ন নিয়ে কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে কাজ করি। কথা বলেছি নারীদের শিক্ষা ও চাকরির অধিকার নিয়ে। আমি সব সময়ই স্বপ্ন দেখেছি একদিন অক্সফোর্ডে পড়তে যাব। অবসরে বই পড়তে ভালবাসি, প্রিয় লেখক- পাওলো কোরেলহো। আমি চাই জীবন সঙ্গী বেছে নেয়ার বিষয়ে পরিবার আমার মতকে প্রাধান্য দেবে। আমি এমন কাউকে আমার জীবনে চাই যার থাকবে আমার বাবার সমস্ত গুণাবলী। যিনি আমার কাজকে সমর্থন দেবেন, আমার পছন্দ-অপছন্দকে মূল্যায়ন করবেন। এক্ষেত্রে পরিবারও গুরুত্বপূর্ণÑ দেখা গেল আপনি সেরা মানুষটিকে বেছে নিয়েছেন কিন্তু তার পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলেন না। আমি জীবনের লক্ষ্য অর্জনে তাদেরও সমর্থন চাইব। তারা বাধা দিলে আমি তাদের মন পরিবর্তনের চেষ্টা করব। আমি যা কিছু বিশ্বাস করিÑ যা কিছু সত্য, সুন্দর সে পথে কোন আপোসে আমি রাজি নই। গল্পচ্ছলে বলা কথাগুলোর গভীর থেকে ওঠে আসে এক সংগ্রামী তরুণের মুখÑ নার্গিস তারাকি।
×