ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তন্বিতা ঘোষ

রাগ এবং রাগের নিয়ন্ত্রণ

প্রকাশিত: ০৮:৩২, ১১ ডিসেম্বর ২০১৮

রাগ এবং রাগের নিয়ন্ত্রণ

প্রথমেই মনে প্রশ্ন জাগে ‘রাগ’ কি? আপনার মনের বা মতের বিরুদ্ধে কিছু হলে আপনি রেগে গেলেন। ‘রাগ’ হচ্ছে মানুষের একটি আবেগ। মানুষ সাধারণভাবেই মনে করে ‘রাগ’ খুবই খারাপ, এটা শুধুই মানুষকে ক্ষতি করে। কিন্তু কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। কারণ রাগ যত সময় নিজের বা অন্যের ক্ষতি না করে তত সময় ভাল। আমরা যদি ‘রাগ’ নামক আবেগের ভাল দিকটি লক্ষ্য করি তবে অনেক কিছু বুঝতে পারব। যেমন- একটি শিশু প্লাস্টিক জারের মুখ খুলতে প্রথমবার ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয়বার আবার চেষ্টা করে। কিন্তু তখন ব্যর্থ হলে তার মধ্যে ‘রাগ’ নামক আবেগের সৃষ্টি হতে থাকে এবং সে বেশি বেশি চেষ্টা করতে থাকে এবং একপর্যায়ে গিয়ে সফলও হয়। আবার ছাত্ররা বন্ধুদের সঙ্গে রাগ করে ভাল রেজাল্ট করে, কোন ব্যক্তি না জানা কোন বিষয় আত্মস্থ করতে পারে যদি তাদের মধ্যে ওই রাগের উৎপত্তি হয়। এক কথায় ‘রাগ’ নামক আবেগ আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করে, সাহায্য করে টিকে থাকতে আবার সমস্যা সমাধানও করে। তবে অতিরিক্ত ‘রাগ’ খারাপ। ঠিক তখনি এটা একটা সমস্যা, যখন এটা ঘনঘন হচ্ছে, নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, ভুল জায়গায় ভুলভাবে বহির্প্রকাশ ঘটে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, ধ্বংসাত্মক ঘটনাও পর্যন্ত ঘটায়। রাগের মুহূর্তে রক্তচাপ বেড়ে যায়, মনুষের দেহের এ্যাড্রেনালিন (adrenaline) এবং নরএ্যাড্রেনালিন (noradrenaline) নামক হরমোনের মাত্রায় পরিবর্তন ঘটায় অর্থাৎ এটা বেড়ে যায় ফলে শারীরিক ও মানুসিক স্বাস্থ্যের অনেক ক্ষতি হতে পারে। কারা বেশি রেগে যায়?- প্রচুর মানুসিক চাপের মধ্যে থাকলে, সবসময় ভয়ে থাকলে, হতাশা এবং বার্থতাকে মেনে নেয়ার ক্ষমতা কম হলে, সামাজিক বা পারিবারিক সাপোর্ট কম থাকলে, প্রচুর ক্লান্তি নিয়ে দীর্ঘসময় কাজ করলে, পারিবারিক সমস্যা, পারিবারিক শিক্ষা, জেনেটিক বা মনস্তাত্ত্বিক কারণে, ক্রনিক কোন রোগ বা ব্যথা থাকলে, শরীরে হরমোনের পরিবর্তন ঘটলে, ব্যক্তিগত ধরনের, অর্থনৈতিক সমস্যা দীর্ঘদিন থাকলে, দীর্ঘসময় কোন ওষুধের অপব্যবহার করলে, নেশা করলে, চাকরি বা পড়া বা সেক্স বা ব্যক্তিগত কোন সম্পর্ক নিয়ে হতাশা থাকলে মানুষ রেগে যায়। এছাড়াও বিভিন্ন মানুসিক রোগের সঙ্গেও এই সমস্যা থাকতে পারে। রাগের জন্যই মানুষ আত্মহত্যা বা খুনের মতো খারাপ ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে। রাগ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা- এই আবেগের নিয়ন্ত্রণ করে সুস্থ, সুন্দর, সাফল্যমণ্ডিত জীবনযাপনের জন্য এবং পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক ও সামাজিক জীবনকে শান্তিপূর্ণ করার জন্য আমাদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত প্রয়োজন। তবে যদি কেউ নিজেই কাজটি করতে পারে তাহলে তো খুবই ভাল কথা। আর যদি নিজে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে হবে। প্রয়জনে ওষুধও খেতে হতে পারে। তবে খুশির খবর হচ্ছেÑ যদি কেউ চায় তবে আগে নিজে থেকেই চেষ্টা করে দেখতে পারেন রাগ কমানো যায় কিনা, এতে অনেকটাই ফল হতে পারে। সেক্ষেত্রে করণীয়- * নিজের ইচ্ছাশক্তিকে বাড়াতে হবে। * ‘আমি হঠাৎ করে কথনই রেগে যাব না’ এটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। * রাগ ওঠার প্রাথমিক অবস্থাতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে নিজেই স্ট্রোক দিতে হবে। * কোথায় কখন রেগে যাচ্ছি তা খুঁজে বের করতে হবে। * কেন রেগে যাচ্ছি নিজে নিজেই বুঝতে হবে। * রিলাক্স হওয়ার পদ্ধতিগুলো নিয়মিত চর্চা করতে হবে। * চিন্তার ধরনে পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করতে হবে। * কোথাও সমস্যা হলে আগে থেকেই সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। * ঘটনা বা পরিস্থিতি সৃষ্টির জায়গা থেকে নিজেকে সরিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। * অপছন্দের বিষয়ে আপনার রাগের কারণ অন্যকে ভদ্রভাবে-আঘাত না দিয়ে- অনুভূতিকে গুরুত্ব দিয়ে-খোঁড়া যুক্তি না দেখিয়ে-সুন্দর করে বুঝিয়ে বলুন। * রাত না জাগা। * হালকা খাবার খাওয়া। * আরামদায়ক পোশাক পরা। * আনন্দদায়ক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক/সামাজিক বিষয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করা। * প্রতিদিন হালকা ব্যায়ম করা। * অনেক কিছু আছে যা আমরা বদলাতে পারব না তা মনে নিতে না পারলেও মেনে নিতে হবে। * অনেক কথা অপ্রয়োজনীয় বা মিথ্যা তা ছেড়ে দিতে হবে। * রাগ ওঠার প্রাথমিক অবস্থায় অর্থাৎ রাগ ওঠার শুরুতে উল্টা দিক থেকে সংখ্যা গণনা করা যেতে পারে। * রাগের সময় আয়নার সামনে গিয়ে নিজের রাগান্বিত চেহারার দিকে তাকানো। * বাথরুম-এ গিয়ে হাতমুখ ধোয়া/মাথায় পানি দেয়া/ গোসল করে ফেলা। এই সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তির সঙ্গে তার পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক ব্যক্তিরা যেভাবে আচরণ করবেনÑ * ব্যক্তির কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। * কথার প্রথমে বা মাঝে ‘আমি জানি তুমি কি বলতে চাও’ বলে থামিয়ে দেবেন না পুরা কথা শেষ করতে দিন। * কোন বিষয়ে কথা বলার সময় একবারে পরিবারের সবাই না বলে একজন কথা বলতে হবে। * এ ধরনের রেগে যাওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে ‘তোমার এটা ভুল, ওটা পার না, এটাও জান না’ এমন বাক্য ব্যবহার করা যাবে না। * ছোট ছোট বিষয় নিয়ে তর্ক শুরু করা যাবে না, বা তাকে সরাসরি ধরা উচিত হবে না। * পারিবারিক পরিবেশের পরিবর্তন আনতে হবে। * ব্যক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক আলোচনা করবেন না। * এই ধরনের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলার সময়Ñ আমি অনুভব করতে পারছি, আমি চিন্তা করছি, ঠিক আছে তুমি বল, যদি তুমি আমাকে বল এভাবে কথা বলতে হবে। * কথা বলার সময় একবারে সব বিষয়ে না বলে একটা বিষয় নিয়ে বলতে হবে এবং ব্যক্তির নাম ব্যবহার করতে হবে। * ব্যক্তির আচরণের পরিবর্তন ঘটলে তাকে পুরস্কৃত করতে হবে। * রাগান্বিত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার সময় সঠিক পদ্ধতিতে উত্তর দিন এবং গলার স্বর নিচু করে কথা বলতে হবে। পরিশেষে বলা যায়, অতিরিক্ত রাগ একটি মানুসিক অসুস্থ প্রবণতা। আপনার এমন সমস্যা থাকলে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী বা সাইক্লোজিস্ট অথবা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা সাইকিয়াট্রিস্টের সাহায্য নিন। সুস্থ থাকুন। লেখক : সাইকোলজিস্ট, থেরাপিউটিক কাউন্সিলর এ্যাডেকশন প্রফেশনাল (ইউটিসি)
×