ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

গোপালগঞ্জে সরকারি স্কুলের শিক্ষকের দৌরাত্মে বেপরোয়া অবৈধ কোচিং-বাণিজ্য

প্রকাশিত: ২২:২১, ১১ ডিসেম্বর ২০১৮

গোপালগঞ্জে সরকারি স্কুলের শিক্ষকের দৌরাত্মে বেপরোয়া অবৈধ কোচিং-বাণিজ্য

নীতিশ চন্দ্র বিশ্বাস, গোপালগঞ্জ ॥ রাত তখন ৮ টা। গোপালগঞ্জ শহরের একটি কোচিং-সেন্টারের ভিতরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কয়েক শিক্ষক হুড়মুড়িয়ে পিছন দরজা দিয়ে দৌড়ে পালান। তাদের দেখাদেখি অপেক্ষমান কয়েকজন অভিভাবকও দৌড়ে যান পিছন দরজার দিকে। খানিকটা বেসামাল অবস্থা। সেখানে অবস্থানরত ছোট ছোট শিক্ষার্থীরাও হকচকিয়ে ভীত হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে গোপালগঞ্জ শহরের বেশ কয়েকজন সাংবাদিক নিজেরাও খানিকটা বিব্রত অবস্থায় পড়ে। এরপর আরও কয়েকটি কোচিং-সেন্টারে গিয়ে প্রায় একই অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। জানা গেল, সাংবাদিকদের দেখে জেলা প্রশাসন বা পুলিশ প্রশাসনের লোক মনে করে ওই শিক্ষকরা দৌড় শুরু করেন। সম্প্রতি অবৈধ কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ করতে জেলা প্রশাসন শহরের বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে একদিন অভিযান চালায়। সেদিন অনেকেই পিছন-দরজা দিয়ে পালালেও ১৮ জন শিক্ষককে আটক করা হয়। নানা নিষেধাজ্ঞা ও নির্দেশনা দিয়ে মুচলেকা রেখে অনেক রাতে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়। সেই থেকে অবৈধ কোচিং-বাণিজ্যে জড়িত বিশেষকরে সরকারি ও আধা-সরকারি শিক্ষকরা প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ সম্মুখ দরজায় তালা লাগিয়ে ভিতরে কোচিং-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, গোপালগঞ্জে উচ্চমূল্যের এসব অবৈধ কোচিং-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন সরকারি স্কুলের বিভিন্ন শিক্ষক। তাদের দৌরাত্মেই শহরের কোচিং-সেন্টারগুলো দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা স্কুলে ঠিকমতো সময় দেন না, দায়সারাভাবে ক্লাশে হাজির থাকেন, গল্প আর নিজ কোচিং-্এর মার্কেটিং করেই যেন ক্লাশ শেষ। স্কুলটাকে রিক্রিয়েশনের জায়গা মনে করেন; আর পেশাগত সময়টুকু দেন কোচিং-সেন্টারে। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সকাল দুপুর বিকেল ও রাত মিলিয়ে ৩ থেকে ৫টি দু’ঘন্টার ব্যাচে তারা শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। একদিকে তারা স্কুলের দায়িত্বে অবহেলার পাশাপাশি সরকারি সুবিধা ভোগ করছেন ১০০%; অন্যদিকে সরকারি বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে অবৈধভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন কোচিং-বাণিজ্য। আগামী ১৮ ডিসেম্বর একযোগে অনুষ্ঠিত হবে গোপালগঞ্জ শহরের স্বনামধন্য এস এম মডেল গভ: হাই স্কুল, বীণাপানি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও শেখ হাসিনা হাই স্কুলসহ বেশ কয়েকটি স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি-পরীক্ষা। এ পরীক্ষার শিক্ষার্থীদের জন্যও ফাঁদ পেতেছেন ওইসব সুযোগ-সন্ধানী শিক্ষকরা। এজন্য গত ২৬ নবেম্বর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিন থেকেই তারা শুরু করেন ৬ষ্ঠ শ্রেণীর বিশেষ ভর্তি-কোচিং। স্কুলে সারা বছর না পড়ালেও তারা মাত্র দু’তিন সপ্তাহের বিশেষ কোচিং করিয়ে স্বনামধন্য স্কুলে ভর্তির নিশ্চয়তাও দিচ্ছেন। এজন্য অভিভাবকদের কাছ থেকে তারা অগ্রীম নিয়ে নিয়েছেন ব্যাচের ধরণ অনুযায়ী শিক্ষার্থীপ্রতি ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা। সন্তানের ভাল ফলের আশায় অভিভাবকরাও বাধ্য হয়ে উচ্চমূল্য নিয়ে ধাবিত হচ্ছেন ওইসব কোচিং সেন্টারের দিকে। প্রশাসন ও স্থানীয় প্রভাবশালী অনেকের সন্তানরাও এসব উচ্চমূল্যের কোচিংমুখী হওয়ায় ওইসব সরকারি শিক্ষকরা কোন বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা করেন না। আর এই কোচিং প্রতিযোগিতার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে সাধারণ পরিবারের অভিভাবক ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা। তাদের এ ধরণের অনেক অভিযোগ রয়েছে ওইসব শিক্ষক ও কোচিং-সেন্টারের বিরুদ্ধে। সিটি, জাগরণ, রাইজ, মডেল ছায়াশিক্ষা ও টিচিং নেট সহ গোপালগঞ্জ শহরে বেশ কয়েকটি উচ্চমূল্যের কোচিং-সেন্টার রয়েছে। মডেল ও বীণাপানি স্কুলসহ বিভিন্ন সরকারি স্কুলের অনেক শিক্ষক এসব কোচিং-সেন্টারের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছেন। এছাড়াও অনেকে কোন সাইনবোর্ড ব্যবহার না করে প্রাইভেট পড়ানোর নামে ২০ থেকে ৪০ জনের ব্যাচ করে উচ্চমূল্য নিয়ে কোচিং-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। রাতারাতি বনে যাচ্ছেন অঢেল অর্থ-সম্পদের মালিক। আর এসব শিক্ষকদের মদদেই কোচিং-সেন্টারগুলোও হয়ে উঠছে বেপরোয়া। এস এম মডেল গভ: হাই স্কুলের শিক্ষক মোহম্মদ আবু হানিফ, জাহিদুল ইসলাম ও সিকদার জাহিদ, উত্তর গোপালঞ্জ সরকারি প্রা: বিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুল ইসলাম, বীণাপানি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সালমা আক্তার ও মোঃ মোজাম্মেল হোসেন, ডালনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বিলাস বাড়ৈ, হরিদাসপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহাবুব হোসেন, এস এম মডেল গভ: প্রা: স্কুলের শিক্ষক মোঃ ইদ্রিস আলী ও পপি ম্যাডাম, বীণাপানি সরকারি বালিকা প্রা: বিদ্যালয়ের শিক্ষক মনিমুল হক ও রইসুল ইসলাম সহ অনেকের নাম গোপালগঞ্জ শহরে অতি পরিচিত; যারা নামে-বেনামে কোচিং-সেন্টারের মাধ্যমে অথবা প্রাইভেট পড়ানোর নামে কোচিং-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। কোন কোন শিক্ষক সুকৌশলে প্রভাবশালী অভিভাকদের অনুরোধপত্র বানিয়ে বা কেউ কেউ নিজেকে আড়াল করে কোচিং-সেন্টারের সম্মুখ দরজায় তালা লাগিয়ে পিছন দরজা ব্যবহার করে কোচিং-বাণিজ্য চালাচ্ছেন। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ আকরাম হোসেন ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আনন্দ কিশোর সাহা পৃথকভাবে জনকণ্ঠকে একই কথা বলেছেন, সরকারি ও আধা-সরকারি কোন স্কুলের শিক্ষক কোচিং-বাণিজ্যের সঙ্গে থাকতে পারবেন না। অভিভাবকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে প্রধানশিক্ষক স্কুলের নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে নির্ধারিত ফিস্্ নিয়ে অতিরিক্ত ক্লাশের ব্যবস্থা করতে পারেন। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’তে এসব ব্যাপারে সুস্পষ্ট সরকারি নির্দেশণা রয়েছে। গোপালগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) আব্দুল্লাহ আল বাকী বলেছেন, এ ব্যাপারে বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ের যে নির্দেশণা রয়েছে তার ব্যাতিক্রম ঘটলে সেইসব শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, আগামী ১৮ ডিসেম্বর অনু্িষ্ঠতব্য ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ভর্তি-পরীক্ষার প্রশ্ন সম্পূর্ণই বই থেকে করা হবে। বইয়ের প্রতি ধারণা যাদের আছে, তাদেরই স্থান হবে। সেজন্য বাচ্চাদের দিকে একটু নজর রাখলেই যথেষ্ঠ।
×