ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জামায়াতের নেতারা আছেন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ;###;ভোটের দিন নৌকার ব্যাজ পরে কেন্দ্রে থাকার পরিকল্পনা শিবিরের ;###;মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য ;###;পুলিশের ওপর হামলা চালানোর ছক

বিজয়ের মাসে জামায়াত ॥ গর্ত থেকে বের করে আনলেন ড. কামাল

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ১২ ডিসেম্বর ২০১৮

 বিজয়ের মাসে জামায়াত ॥ গর্ত থেকে বের করে আনলেন ড. কামাল

বিভাষ বাড়ৈ ॥ নিবন্ধন না থাকলেও দলগতভাবে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দল জামায়াতের নির্বাচন নিয়ে এখন দৃশ্যত কোন অনিশ্চয়তা নেই। নিবন্ধন হারানো জামায়াতের প্রতীক পেতেও কোন সমস্যা হয়নি। স্বাধীনতাবিরোধী এ দলটির পাশে যথারীতি আছে বিএনপিসহ ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট। তাদের আশীর্বাদেই ২২ আসনে সমর্থন পেয়ে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রকাশ্যে আসছে জামায়াত। তবে জানা গেছে, কেবল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েই বসে নেই জামায়াত-শিবির। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনের প্রস্তুতির সঙ্গে নাশকতার গোপন রণপ্রস্তুতিও নিয়েছে তারা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর থেকে অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার ভয়ে কোণ্ঠাসা জামায়াতকে আবার প্রকাশ্যে আসার পরিবেশ করে দিয়েছে বিএনপি ও ড. কামালের নেতৃত্বাধীন জোট। এমনকি বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে সব সময়েই জামায়াত থাকে রীতিমতো গর্তে লুকিয়ে। কিন্তু এবার ড. কামাল ও তাদের বন্ধুরা বিজয়ের মাসেই জামায়াত নেতাদের কৌশলে প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ করে দিয়েছে। তবে জামায়াতের সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকলে এক ধরনের চিন্তা, আর নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলনের ডাক দিলে কৌশল কী হবে- তা ঠিক করেছে নিবন্ধনবিহীন এ দলটি। বিএনপির শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকা নিয়ে এখনও সন্দিহান তারা। তাই শিবিরের মতো উগ্রবাদী সংগঠনকে কাজে লগিয়ে নির্বাচনে নাশকতার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। জামায়াত ও বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বও মনে করছেন, সরকার কোন কৌশলে বিএনপিকে কোণ্ঠাসা করে নির্বাচন করে ফেললে সেক্ষেত্রে রাজপথে বাধা দেয়ার মতো শক্তি বিএনপি ও ছাত্রদল বা তাদের সমমনা কারও নেই। এক্ষেত্রে শিবির ছাড়া বিএনপির কোন বিকল্প নেই। তাই যে কোন জটিল পরিস্থিতিতে শিবিরকে কাজে লাগাতে চায় বিএনপির হাইকমান্ড। ২২ আসনে বিএনপি ছাড় দিয়েছে জামায়াতকে। তবে জোটগত মনোনয়নের বাইরে দুটি আসনে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে বিএনপি। এক্ষেত্রে এই দুটি আসনে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীরা পৃথকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। জামায়াতের নেতারা দাবি করছেন, বরাবরই জামায়াতকে ছাড় দিতে হয়। একাদশ নির্বাচনে বেশি ছাড় দিতে হয়েছে। দর কষাকষি করলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিএনপির অটল অবস্থান ও টানা অনুরোধের কারণে রবিউল বাশার (সাতক্ষীরা-৩), ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী (সিলেট-৫), হাবিবুর রহমান (সিলেট-৬) আসনগুলোতে ছাড় দিতে হয়েছে বলে বলছেন জামায়াত নেতারা। জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের ভাষ্য, আমাদের তো বরাবরই কোরবানি হতে হয়। আমাদের তিনটি সিট কম দিয়েছে। তদবির করার পরও তিনটি দিল না, ২২টি পেলাম। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৫ আসনে (চাঁপাই-৩, রাজশাহী-৩, সিরাজগঞ্জ-৪, ঝিনাইদহ-৩, মেহেরপুর-১) এবং ২০০১ সালে একটি আসনে (চট্টগ্রাম-১৫ তৎকালীন ১৪) উন্মুক্ত প্রার্থিতা করেছিল জামায়াত। যদিও একটি আসনেও বিজয়ী হতে পারেননি জামায়াতের প্রার্থীরা। এমনকী ওই আসনগুলোতে বিএনপির প্রার্থীরাও জিতেনি। যেসব আসনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে জামায়াতের প্রার্থীরা লড়বেন সেগুলো হচ্ছেÑ ঠাকুরগাঁও-২ আসনে মাওলানা আবদুল হাকিম, দিনাজপুর-১ আসনে মাওলানা মোহাম্মদ হানিফ, দিনাজপুর-৬ আসনে মোহাম্মদ আনোয়ারুল ইসলাম, নীলফামারী-২ আসনে মুুক্তিযোদ্ধা মনিরুজ্জামান মন্টু, নীলফামারী-৩ আসনে মোহাম্মদ আজিজুল ইসলাম, রংপুর-৫ আসনে অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, গাইবান্ধা-১ আসনে মাজেদুর রহমান সরকার, সিরাজগঞ্জ-৪ আসনে মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, পাবনা-৫ আসনে মাওলানা ইকবাল হুসাইন, ঝিনাইদহ-৩ আসনে অধ্যাপক মতিয়ার রহমান। যশোর-২ আসনে আবু সাঈদ মুহাম্মদ শাহাদাত হোসাইন, বাগেরহাট-৩ আসনে এ্যাডভোকেট আবদুল ওয়াদুদ, বাগেরহাট-৪ আসনে অধ্যাপক আবদুল আলীম, খুলনা-৫ আসনে অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, খুলনা-৬ আসনে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, সাতক্ষীরা-২ আসনে মুহাদ্দিস আবদুল খালেক। সাতক্ষীরা-৪ আসনে গাজী নজরুল ইসলাম, পিরোজপুর-১ আসনে শামীম সাঈদী, ঢাকা-১৫ আসনে ডাঃ শফিকুর রহমান, কুমিল্লা-১১ আসনে ডাঃ সৈয়দ আবদুল্লাহ মোঃ তাহের, চট্টগ্রাম-১৫ আসনে আ ন ম শামসুল ইসলাম ও কক্সবাজার-২ আসনে হামিদুর রহমান আযাদ। বিএনপি ও জামায়াত আলাদাভাবে নির্বাচন করবে সিলেট-৫, সিলেট-৬ এবং সাতক্ষীরা-৩ আসনে। এ তিন আসনে জামায়াত প্রার্থীরা হলেনÑ সিলেট-৫ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী, সিলেট-৬ মাওলানা হাবিবুর রহমান এবং সাতক্ষীরা-৩ আসনে মুফতি রবিউল বাশার। এ ছাড়া চট্টগ্রাম-১৬, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ ও পাবনা-১ তিনটি আসন ওপেন রাখার দাবি এখনও আছে জামায়াতের। এদিকে জামায়াত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, কেবল নির্বাচনের প্রস্তুতিতেই মনোযোগ দিয়ে বসে নেই জামায়াত-শিবির ও তাদের আশীর্বাদপুষ্ট উগ্রবাদীরা। ইতোমধ্যেই নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনর হিজবুত তাহরীর সরকার ও নির্বাচনের বিরুদ্ধে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লিফলেট বিলি করছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পোস্টার লাগিয়ে নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার জন্য উস্কানিমূলত বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতির সঙ্গে লাগাতার নাশকতার গোপন রণপ্রস্তুতি নিয়ে আগানো জামায়াতের কৌশল নিয়ে শতর্ক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও। নির্বাচনে অংশ নিলে গলায় নৌকা প্রতীকের কার্ড ঝুলিয়ে ভোটকেন্দ্রে শক্ত অবস্থান নেয়া এবং সহিংসতার মাধ্যমে ভোটের ফল নিজেদের অনুকূলে নেয়ার প্রস্তুতি আছে উগ্রবাদী দলটির। প্রয়োজনে হামলার মাধ্যমে পুলিশের মনোবল ভেঙে দেয়া এবং অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে নাশকতার টার্গেট নিয়েছে দলটি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের মূল স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে মাঠে জামায়াত-শিবির থাকবে। সম্প্রতি গোয়েন্দা পুলিশ জামায়াতের চট্টগ্রামের শীর্ষ কয়েক নেতাকে আটকের পর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে। এ সব তথ্য এরই মধ্যে প্রতিবেদন আকারে পুলিশ সদর দফতরে পাঠানো হয়েছে। গোয়েন্দা বিভাগ জানিয়েছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াত-শিবির নাশকতার পরিকল্পনার বিষয়ে আমরা জেনেছি। উর্ধতন কর্তৃপক্ষ আমাদের বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। পুলিশ বলছে, জামায়তের পরামর্শে ছাত্রশিবিরের ২০১৮ সালের পুরো সাংগঠনিক পরিকল্পনা আমরা জানতে পেরেছি। এই পরিকল্পনার বড় একটি অংশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। তারা পুলিশের ওপর হামলা করতে চায়। এটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। দ্বিতীয় টার্গেট হচ্ছে অর্থনৈতিক অঞ্চল। ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মুহাম্মদ ইয়াছিন আরাফাত দেশের সব শাখায় দিক নির্দেশনামূলক একটি বক্তব্য পাঠিয়েছে। এতে ২০ দফা দিক নির্দেশনার কথা উল্লেখ রয়েছে। সেই দিক নির্দেশনায় নির্বাচন নিয়ে ছাত্রশিবিরের পরিকল্পনায় সরকার বিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে নিজেদের বড় শক্তি হিসেবে প্রকাশের কথা উল্লেখ আছে। পুলিশের ওপর লাগাতার হামলা চালাতে পারে বলে ইতোমধ্যেই তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এমনকি সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে আগের ধরন পাল্টে বর্তমানে তারা জঙ্গীদের অনুকরণে টেলিগ্রামের মতো নানা ধরনের এ্যাপস ব্যবহার করছে। সাম্প্রতিক সময়ে শিবিরের বিভিন্ন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে এ সংক্রান্ত বেশ কিছু নথিপত্রও জব্দ করেছে পুলিশ প্রশাসন। সরকারের কাছেও এসেছে নির্বাচন কেন্দ্রিক নাশকতার তথ্য। আগামী নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় জেনে বিএনপি-জামায়াত নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে নাশকতার পাঁয়তারা করছে বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক। সোমবার আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানম-ির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নানক এ আহ্বান জানান। জাহাঙ্গীর কবির নানক আরও বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সন্ত্রাসী সংগঠন শিবিরের কয়েকজন নেতা আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। এ থেকে বোঝা যায় বিএনপি এবং জামায়াত নাশকতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবে। তারপরও আমরা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় আছি। তিনি আরও বলেন, জনগণের কাছে ভোট চাওয়ার মতো কোন অর্জন তাদের নেই। জনগণের কাছে ভোট চাওয়ার মতো তাদের কোন নৈতিক ও যৌক্তিক ভিত্তি নেই। তাই নিজেদের নিশ্চিত পরাজয় জেনে তারা ষড়যন্ত্রের পথে, চক্রান্তের মাধ্যমে, নাশকতা ও সন্ত্রাসের পথ ধরে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হচ্ছে। তাদের তথাকথিত ঐক্যফ্রন্টের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন ড. কামাল হোসেনরা।
×