ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আমি গাইবো গাইবো বিজয়েরই গান...

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১২ ডিসেম্বর ২০১৮

 আমি গাইবো গাইবো বিজয়েরই গান...

মোরসালিন মিজান ॥ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ সংগ্রাম। এক নদী রক্ত। তারপর বাংলাদেশ। গীতিকবির ভাষায়- রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি বাংলাদেশের নাম। ১৯৭১ সালে নয় মাসের লড়াই। ব্যাপক প্রতিরোধ। সে ধারাবাহিকতায় ডিসেম্বরে অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বছর ঘুরে আবারও এসেছে সেই গৌরবের মাস। এই মাস আনন্দের। উৎসবের। এবং শপথের। এবারও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন করে নিজেকে রাঙাবে বাঙালী। ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা গ্রহণ করবে। ডিসেম্বর বাঙালীর জন্য চির আবেগের। আবেদনের। কত কত স্মৃতি মনে উঁকি দিয়ে যায়! অনেক বেদনার ইতিহাস মাসটির সঙ্গে জুড়ে আছে। ত্রিশ লক্ষ প্রাণ বলি দিতে হয়েছিল। নির্বিচারে হত্যা করেছে পাকিস্তান বাহিনী। মায়েদের মেয়েদের ওপর চালানো হয়েছে নির্মম নির্যাতন। ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে সারা বাংলা পেয়েছিল শ্মশানের চেহারা। বাঙালী তবু মাথা নোয়াবার নয়। বিজয়ী হয়ে তবেই ফিরেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। ডিসেম্বর এলে সেইসব স্মৃতি সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রিয়জন হারানোর শোক নতুন করে বুক বিদীর্ণ করে বটে। ততধিক সত্য হয়ে ধরা দেয় বিজয়ের আনন্দ। এবারও নানা আয়োজনে উদ্যাপন করা হবে বিজয় দিবস। সারা দেশেই চলছে উৎসব অনুষ্ঠানের প্রস্ততি। রাজধানী ঢাকার সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিজয় দিবসের উৎসব আয়োজনে ব্যস্ত এখন। আছে রাষ্ট্রীয় নানা কর্মসূচী। সব মঞ্চ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের কথা। এখন কথায় গানে কবিতায় সর্বত্র উচ্চারিত হচ্ছে বাঙালীর আত্মদানের ইতিহাস। পূর্ব পুরুষের বীরত্বগাঁথা নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করছে। আলাদা করে বলতে হয় জাতীয় পতাকার কথা। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে পাওয়া পতাকাটি এখন উড়ছে সর্বত্র। লাল-সবুজের পতাকা বহন করছে একেবারে সাধারণ রিক্সা চালকও। বাচ্চারা পতাকার জন্য হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। হকাররা ঢাকার অলি গলি ঘুরে পতাকা বিক্রি করছে। দেখে মন গুনগুন করে গেয়ে ওঠে: বিজয় নিশান উড়ছে ঐ/ খুশির হাওয়ায় ঐ উড়ছে/ বাংলার ঘরে ঘরে/ মুক্তির আলো ঐ ঝরছে...। সত্যি অপরূপ দৃশ্য! পোশাকের রংও ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। মার্কেটে শপিংমলে পতাকার রঙে তৈরি করা পোশাক। দেশীয় ডিজাইন আর আধুনিক রুচি। সঙ্গে অদ্ভুত এক আবেগ। পোশাকগুলো তাই দারুণ আকর্ষণ করে। বিক্রিও হচ্ছে প্রচুর। লাল-সবুজ রংকে প্রাধান্য দেয়ায় শোরুমগুলো অভিন্ন চেহারা পেয়েছে। গত কয়েকদিন বসুন্ধরা সিটি শপিংমল ও আজিজ সুপার মার্কেট ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। বসুন্ধরা শপিং মলের ‘দেশী দশ’ মানেই নিজেদের পোশাক। এখানে বাঙালী সংস্কৃতির উৎসবগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়। একই চেতনা থেকে লাল-সবুজের পোশাকে ভরে উঠেছে শোরুম। ক্রেতারাও ব্যস্ত কেনাকাটায়। হামিদ ও নাবিলা নামের দুই বন্ধু মঙ্গলবার বিজয় দিবসের পোশাক কিনতে এসেছিলেন। হামিদ বললেন, বিজয় দিবস অন্য অনেক দিবসের মতো নয়। পহেলা ফাল্গুন বা পহেলা বৈশাখের মতোও নয়। বিজয় দিবস মানে বাঙালীর মুক্তির সংগ্রাম। নয় মাস লড়াই করে একটি বাংলাদেশ পাওয়া। লাল-সবুজ রংটা গায়ে জড়ালে অনুভূতিটা আরও গাঢ় হয়। এ কারণেই বিজয় দিবসের জন্য আলাদা করে পোশাক কিনতে আসা বলে জানান সঙ্গে থাকা নাবিলা। এদিকে, কয়েক দিন বাকি থাকলেও বিজয় দিবসের উৎসব অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। বরাবরের মতো ‘মানবাধিকার দিবস থেকে বিজয় দিবস’ শীর্ষক উৎসবের আয়োজন করেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। জাদুঘর মিলনায়তনে গত ১০ ডিসেম্বর উৎসবের সূচনা করা হয়। এবারের স্লোগান-‘তারুণ্যের হাতে মুক্তির দায়ভার : স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী হোক স্বদেশের সুবর্ণ সময়।’ সপ্তাহব্যাপী আয়োজনের প্রতিদিনই থাকছে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সপ্তাহব্যপী অনুষ্ঠানমালার তৃতীয় দিনে আজ বুধবার ‘এসডিজি এবং অর্থনৈতিক বিকাশ ও সাম্যের পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করবেন সাবেক অর্থমন্ত্রী অর্থনীতিবিদ এম সাইদুজ্জামান। তরুণ আলোচক হিসেবে থাকবেন সিপিডি’র গবেষণা সহযোগী কাজী গোলাম তাস্ফিক। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করবে স্রোত আবৃত্তি সংসদ। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করবে ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী। এছাড়াও থাকবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমি স্কুল এন্ড কলেজ ও ক্যামব্রিয়ান স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনা। ১৬ ডিসেম্বর সকালে শিশু-কিশোরদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হবে। সন্ধ্যায় পরিবেশিত হবে যাত্রাপালা। মিরপুরে অবস্থিত জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ প্রাঙ্গণেও আয়োজন করা হবে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা। প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এনেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। জোটের উদ্যোগে এবারও বিস্তৃত পরিসরে বিজয় দিবস উদ্যাপন করা হবে। উৎসবের স্লোগান ‘স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের দিন শেষ/মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাবেই বাংলাদেশ।’ রাজধানী ও আশপাশের মোট ৭ মঞ্চ থেকে বিজয় দিবসের হাসি আনন্দ ছড়িয়ে দেয়া হবে। সে লক্ষ্যে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। আয়োজকদের পক্ষে জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানান, আগামী কাল ১৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হবে অনুষ্ঠানমালা। এদিন বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে উৎসবের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। এখানে অনুষ্ঠানমালা চলবে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এছাড়া প্রতি বছরের মতোই ১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে বের করা হবে বর্ণাঢ্য বিজয় শোভাযাত্রা। উত্তরা মঞ্চের আয়োজন শুরু হবে ১৫ ডিসেম্বর। চলবে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। রবীন্দ্র সরোবর মুক্ত মঞ্চে অনুষ্ঠান চলবে ১৪ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। একই সময় অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হবে রায়েরবাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে। মিরপুরের মঞ্চেও অনুষ্ঠান চলবে ১৪, ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর। দনিয়া মঞ্চের ২ দিনের আয়োজন ১৫ ডিসেম্বর শুরু হয়ে চলবে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক মঞ্চে ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর উৎসবের আয়োজন করা হবে। প্রতিটি মঞ্চের অনুষ্ঠান বিকেল ৪টা থেকে শুরু হবে। উৎসব আয়োজকদের পক্ষে জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানান, এসব অনুষ্ঠানে দেড় শতাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের আড়াই হাজার শিল্পী অংশগ্রহণ করবেন। সঙ্গীত নৃত্য কবিতা ও পথনাটক ও চলচ্চিত্রের ভাষায় তুলে ধরা হবে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হবে। ছায়ানট, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘরসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকেও বিজয় দিবসের নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হবে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। সব ঠিক থাকলে দারুণ উৎসবমুখর হয়ে ওঠবে গোটা ঢাকা। আমি গাইবো গাইবো বিজয়েরই গান...। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিজয়ের গান গাইবে বাঙালী। নতুন করে জেগে ওঠবে। আপাত সেই অপেক্ষা।
×