ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

আসন্ন নির্বাচন এবং সৎ সাংবাদিকতার দায়িত্ব

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ১২ ডিসেম্বর ২০১৮

আসন্ন নির্বাচন এবং সৎ সাংবাদিকতার দায়িত্ব

আজকাল হাজার হাজার খবরের ভিড়ে কোন্ খবরটি বিশ্বাস করব আর কোন্টি করব না তা বাছাই করা খড়ের গাদায় একটা সুচ খুঁজে বেড়ানোর চাইতেও কষ্টকর। আগে খবর এবং গুজবের মধ্যে একটা পার্থক্য ছিল। এখন তা আর নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুজবই খবর বলে প্রচারিত হয়। আগে খবর বলতে বোঝাত সত্যের কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত হয়ে যা প্রচারিত হয়। আর গুজব ছিল কানকথা। যা সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। এখন গুজব মানেই বিশ্বাসযোগ্য তথ্য। হোক না তা কানকথা। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এত বেশি কানকথা ও গুজব খবরের মর্যাদায় প্রচারিত হয় এবং এমন কৌশলে প্রচারিত হয় যে, তা অবিশ্বাস করা কঠিন। আগে তবু জার্নালিজম ও ইয়েলো জার্নালিজমের মধ্যে পার্থক্যটা বোঝা যেত। এখন বোঝার উপায় নেই। লন্ডনের ‘সান’ আর ‘সানডে টাইমস’-এর মধ্যে পার্থক্য খুব কম। আগে টাইমস, গার্ডিয়ান প্রভৃতি ব্রডশীট কাগজগুলো (গার্ডিয়ানও এখন ট্যাবলয়েড হয়ে গেছে) সিরিয়াস পলিটিক্যাল ডিবেটের কাগজ ছিল। মতামত যাই হোক। এখন টাইমস, গার্ডিয়ান প্রভৃতি কাগজও সান, মিররের মতো রং-চঙে ভরা সেক্স, গসিপ ও ফুড নিয়ে লেখায় ভর্তি কাগজ। ধনতন্ত্রের অবক্ষয় পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতেও সমাজ জীবনে এমন পচন ধরিয়েছে যে, সংবাদপত্র ও অন্যান্য মিডিয়াতেও তার ছাপ দেখা যায়। গসিপ ও অর্ধসত্য খবরকে সত্য বলে প্রকাশ করা হয় এবং প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের চরিত্র হননে অভিজাত কাগজগুলোও এখন ব্যস্ত। টাইমস ও সানডে টাইমসের পাতা ভর্তি এখন থাকে ব্রিটিশ রাজপরিবারের নববধূ প্রিন্স হ্যারির স্ত্রীর নান রকম পোজের আকর্ষণীয় ছবি। সঙ্গে লেবার পার্টির জনপ্রিয় বামপন্থী নেতা করবিনের নিত্য চরিত্র হনন এবং তার বিরুদ্ধে অনবরত অসত্য ও অর্ধসত্য খবর প্রচার। এগুলো মিথ্যা বলে ধরা পড়লে ছোট একটা কারেকশন ছেপেই দায়িত্ব শেষ। আমেরিকার এক জাঁদরেল সাংবাদিক সম্প্রতি লিখেছেন, ‘আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য চেঁচাই। কিন্তু এই স্বাধীনতা এখন এমনই ভয়ঙ্কর যে, তা অনেক মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন এমনকি সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক জীবন ধ্বংস করে দিচ্ছে।’ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার এই করাল গ্রাস থেকে বহু দেশে নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবনের প্রাইভেসি, পারিবারিক জীবনের পবিত্রতা ও রাজনৈতিক জীবনের সম্ভাবনা রক্ষা করা দুরূহ হয়ে উঠেছে। হলিউডের এক অভিনেত্রী বলেছেন, ‘অভিনেতা স্বামীর সঙ্গে আমার দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল। কিন্তু কয়েকটি সংবাদপত্র তাদের গসিপ কলামে অন্য এক অভিনেতার সঙ্গে আমার রগরগে রোমাঞ্চের এমন সব বানানো খবর ছাপতে শুরু করে যে, আমাদের দাম্পত্য জীবন ভেঙ্গে যায়।’ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সকলের কাম্য। কিন্তু তার আধিক্য ও অপব্যবহার একটা দেশ ও জাতির জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অনেকটা আণবিক শক্তির মতো। আণবিক শক্তি যেমন মানব সমাজের অসীম উন্নতি ঘটাতে পারে, আবার তেমনি গোটা মানবসভ্যতা ধ্বংস করতে পারে। তেমনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তথা বাকস্বাধীনতা একটি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য, আবার সেই স্বাধীনতার আধিক্য ও অপব্যবহার একটি ধ্বংসাত্মক শক্তি। আমরা সংবাদপত্রের এই ধ্বংসাত্মক শক্তির প্রমাণ পাই ইরাক যুদ্ধে। সাদ্দাম হোসেনের হাতে ‘বিশ্ব ধ্বংসের মারণাস্ত্র’ আছে এই জঘন্য মিথ্যা কথাটি বলেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়র। কিন্তু এই সর্বৈব মিথ্যাটি সারাবিশ্বে প্রচার করে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিল পাশ্চাত্যের তথাকথিত ‘স্বাধীন সংবাদপত্র।’ আর এই মিথ্যা ধরা পড়ার পরও নিজ দেশ রক্ষায় যুদ্ধ করে আত্মদানকারী সাদ্দাম হোসেনকে পাশ্চাত্য মিডিয়া তুলনা করছে হিটলারের সঙ্গে। আর হিটলারের চাইতেও বর্বর অত্যাচারী বুশ ও ব্লেয়ার যারা মিথ্যা অজুহাতে একটি দেশের বিরুদ্ধে অবৈধ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে দেশটি ধ্বংস করেছে এবং লাখ লাখ নারী, শিশু, পুরুষ হত্যা করেছে তারা হলেন গণতন্ত্র উদ্ধারের নেতা। বাংলাদেশের দিকে তাকালে আমরা কি দেখি। যে দলটি দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, দেশকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙ্গে উদ্ধার করেছে, যে দলের বর্তমান নেত্রী একুশ বছর নিজের জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করে দেশটিকে স্বৈরাচারের কবল থেকে মুক্ত করেছেন, এখনও পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে নানা ভুল-ত্রুটির মধ্যেও লড়াই করে চলেছেন, দেশের একটি সুশীল সমাজ এবং তাদের সহযোগী মিডিয়ার প্রচার হচ্ছে, এই দল ও তার নেত্রী হচ্ছেন স্বৈরাচারী। আর যারা বন্দুকের সাহায্যে ক্ষমতায় এসে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি ধ্বংস করা শুরু করে, স্বাধীনতার স্থপতিদের নাম-নিশানা মুছে ফেলার চেষ্টা চালায়, দেশে পাকিস্তানী কায়দায় গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে স্বৈরাচারী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেকুলারিজমকে উচ্ছেদ করে দেশের গোটা রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের পশ্চাৎমুখী ধর্মীয়করণ ঘটায় এবং একটানা সন্ত্রাস দ্বারা অসংখ্য নিরীহ নর-নারীকে হত্যা করে, দুর্নীতির হাওয়া ভবনের যারা প্রতিষ্ঠাতা, তাদের নিয়ে কতিপয় রাজনৈতিক দল ও নেতা বিশেষ করে একটি সুশীল সমাজ গণতন্ত্র উদ্ধারের নামে ফ্রন্ট গঠন করেছে এবং দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। বিভ্রান্তি সৃষ্টির কাজে এই অপশক্তির সবচাইতে সহায়ক শক্তি নিরপেক্ষতার ভেকধারী একটি মিডিয়া গ্রুপ। দেশে ফ্যাসিবাদীদের ষড়যন্ত্র রোখার জন্য এদের অতি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হলে মাতম শুরু হবে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে, আর করা না হলে দেশে কি ঘটতে পারে, তা আমরা ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় দেখেছি। আমি নিজে সাংবাদিক এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। কিন্তু অতি স্বাধীনতায় নয়। অতি স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচার। বার্নার্ড শ’ একদিন লন্ডনের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন, তার বিপরীত দিক থেকে আসছিলেন এইচজি ওয়েলস। তিনিও বিখ্যাত সাহিত্যিক। তিনি হাতের লাঠিটা ঘোরাতে ঘোরাতে হাঁটছিলেন এবং বার্নার্ড শ’য়ের একেবারে সামনে এসে পড়লেন। বার্নার্ড শ’ বললেন, ‘ওহে ওয়েলস, তোমার লাঠি ঘোরানো থামাও। নইলে আমার নাকে আঘাত লাগবে যে। ওয়েলস্্ বললেন, আমি একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। লাঠি ঘুরিয়ে হাঁটা আমার নাগরিক অধিকার। আমার স্বাধীনতা। বার্নার্ড শ’ হেসে বলেছেন, তোমার কথার কোন ভুল ধরছি না। কেবল তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আমার নাকের ডগার যেখানে শেষ, সেখান থেকে তোমার অধিকার ও স্বাধীনতা শুরু।’ বাংলাদেশে আমরা বাকস্বাধীনতা চাই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই এবং এই চাওয়াটা ন্যায্য। মুশকিল হচ্ছে, একশ্রেণীর সংবাদ, টিভি এই স্বাধীনতার সঙ্গে তার দায়িত্বটা পালন করতে চায় না। এই স্বাধীনতা যে কারও নাকের ডগা অতিক্রম করতে পারে না, সে কথাটা আমরা বুঝতে চাই না। একটি অভিজাত দৈনিকের সম্পাদক নিজেই স্বীকার করেছেন, তিনি জেনেশুনে দেশের এক রাজনৈতিক নেত্রী সম্পর্কে অসত্য খবর প্রকাশ করেছেন। তাতে যে সাংবাদিকতার দায়িত্ববোধ ক্ষুণœ করেছেন সে সম্পর্কে কিছু বলেননি। কিন্তু যখনই তার অসাধুতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তখনই চিৎকার উঠেছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের বা এক-এগারোর শাসনামলে যখন প্রকৃত সাংবাদিকদের ওপর অত্যাচার চলেছে, তখন তার বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ প্রতিবাদ শোনা যায়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগের শাসনামলে যখন কিছু ভুয়া সম্পাদকের দেশের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর প্রচারণা বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তখন জোটবেঁধে সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে বলে বিশ্ববাসীকে জানানো হয়েছে। এখন সামাজিক মিডিয়া, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদির কল্যাণে তথ্যপ্রবাহ অবাধ হয়েছে একথা সত্য। এটা ভাল। কিন্তু সেই সঙ্গে খবর ও মতপ্রচারের স্বাধীনতাও যে স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়েছে এবং দেশের ও সমাজের অনেক অকল্যাণও করছে সে দিকে নজর দেয়ার দায়িত্ব কাদের? মিডিয়া এবং তার সম্পাদকদেরই নয়কি? সে দায়িত্ব কি তারা পালন করছেন? দেশে আরেকটি সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের মতোই ২০১৮ সালের এই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। সত্তরের নির্বাচন ছিল স্বাধীনতা অর্জনের। এ বছরের নির্বাচন সেই স্বাধীনতা রক্ষণের। নির্বাচনে দুই বড় প্রতিদ্বন্দ্বী দল সেই সত্তরের প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলই। একটু চেহারা বদল হয়েছে মাত্র। এই নির্বাচনে স্থির হবে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে, না পাকিস্তানের মতো একটি মধ্যযুগীয় ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত হবে? এই নির্বাচনে দল বা ব্যক্তির গুণাগুণ বিচারের অবকাশ খুব কম। কিন্তু এই সত্যটি কি আমাদের একশ্রেণীর মিডিয়া জনগণকে বুঝতে দিচ্ছে, নাকি স্বাধীনতার পক্ষের আর বিপক্ষের শক্তিকে একই পাল্লায় তুলে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। দেশের অসাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে আখ্যা দিচ্ছে স্বৈরাচারী; আর জন্মাবধি যে শিবির সাম্প্রদায়িক এবং স্বৈরাচারী, তাদের তুলে ধরছে গণতন্ত্র উদ্ধারের সংগ্রামী জোট হিসেবে। দেশের যারা সৎ এবং দেশপ্রেমিক সাংবাদিক, তাদের এখন তথাকথিত নিরপেক্ষ সাজার সুযোগ নেই। কবির ভাষায় তাদের উদ্দেশে বলিÑ‘সর্বশেষের এই সংগ্রামের মাসে/নিজ নিজ অধিকার জুড়ে দাঁড়া আজ’। লন্ডন, ১১ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ২০১৮
×