ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইয়াসির শাহর অনন্য কীর্তি

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ১২ ডিসেম্বর ২০১৮

 ইয়াসির শাহর অনন্য কীর্তি

মাঠের ক্রিকেটে সময়টা খুব একটা ভাল যাচ্ছে না পাকিস্তানের। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিজয়ের পর এশিয়ার পরাশক্তিদের পারফর্মেন্স কেমন এলমেলো। এশিয়া কাপে চরম ভরাডুবি। টেস্টে হোম ভেন্যুতে (আমিরাতও) নিজেদের টেস্ট ইতিহাসের প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডের কাছে সিরিজ খুইয়েছে সরফরাজ আহমেদের দল। তবে এরই মাঝে নিজের জাত চিনিয়ে চলেছেন ইয়াসির শাহ। সাদা পোশাকের ক্রিকেটে দ্রুততম ২০০ উইকেট শিকারে ৮২ বছরের পুরনো রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন ৩২ বছর বয়সী লেগস্পিনার। আবুধাবিতে সিরিজ নির্ধারণী তৃতীয় ও শেষ টেস্টের চতুর্থ দিন সকালে উইলিয়াম সমারভিলকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলে এ মাইলফলক ছুঁয়েছেন তিনি। এজন্য তাকে খেলতে হয়েছে ৩৩ টেস্ট। ৩৬ টেস্টে ২০০ উইকেট নিয়ে এতদিন যেটি ছিল অস্ট্রেলিয়ান লেগস্পিনার ক্ল্যারি গ্রিমেটের দখলে, ১৯৩৬ সালে। পাকিস্তানের হয়ে ৫০তম টেস্ট উইকেট পেয়েছিলেন সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে। আর ১০০তম উইকেট পান টেস্ট ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম সময়ে। ২০০ শিকারের পথে বিশ্বরেকর্ডটাই গড়ে ফেললেন ঘূর্ণিবলের মায়াবি জাদুকর। ইয়াসির মাত্র চার বছর আগে সাদা পোশাকের ক্যারিয়ার শুরু করেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। আবুধাবি টেস্ট খেলতে নামার আগে ৩২ টেস্টে ১৯৫ উইকেট ছিল তার শিকারের ঝুলিতে। নিউজিল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে মাত্র ৩ উইকেট নিয়ে কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন রেকর্ডের। আর দ্বিতীয় ইনিংসে তৃতীয় দিন শেষেই তুলে নিয়েছিলেন ওপেনার টম লাথামের উইকেট। কিন্তু চতুর্থ দিন আর বেশি সময় নেননি ইতিহাস গড়তে। দিনের সপ্তম ওভারের প্রথম বলেই শিকার করেন সোমারভিলকে। আর এতেই অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে যান তিনি। ক্যারিয়ারের ৩৩তম টেস্টের শেষ ইনিংসে এসে এই বিশ্বরেকর্ড গড়েন। মজার বিষয়, তার আগেও দ্রুততম ২০০ টেস্ট উইকেটের গ্রিমেটও ছিলেন একজন লেগস্পিনার। গ্রিমেট তার ক্যারিয়ারের ৩৬তম টেস্টে ওই মাইলফলক ছুঁয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জোহানেসবার্গে ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এই ৮২ বছরের মধ্যে শেন ওয়ার্ন, অনিল কুম্বলে, স্টুয়ার্ট ম্যাকগিল ও ইমরান তাহিরের মতো লেগস্পিনাররা দীর্ঘ সময় টেস্ট খেলেছেন। অসংখ্য রেকর্ডও গড়েছেন। কিন্তু তারা কেউ এত দ্রুত সময়ে ২০০ উইকেট দখল করতে পারেননি। ইয়াসির ৩২ বছর বয়সেই তা ছুঁয়ে ফেললেন। এর আগে ক্যারিয়ারের ৫০তম টেস্ট উইকেট নিতে তার সময় লেগেছিল ৯ ম্যাচ। সেটি ছিল পাকিস্তানের পক্ষে দ্রুততম। পাকিদের হয়ে আগের সেরা ছিল পেসার ওয়াকার ইউনূসের ১০ টেস্টে ৫০ উইকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ফয়সালাবাদে ১৯৯০ সালে সেই রেকর্ড গড়েছিলেন ওয়াকার ১৯৫৬ সালে করা খান মোহাম্মদের রেকর্ড ভেঙ্গে। পরের ৫০ উইকেট নিতে মাত্র ৮ টেস্ট খেলতে হয়েছে ইয়াসিরকে। এবার তিনি পাকিস্তানের তো বটেই, টেস্ট ইতিহাসেই দ্রুততম ১০০ উইকেট শিকারে দুই নম্বরে উঠে আসেন। ওই রেকর্ডটা ভাগাভাগি করতে হয় গ্রিমেট, সিডনি বার্নস ও চার্লি টার্নারের সঙ্গে। ইয়াসিরসহ এরা সবাই ১৭ টেস্টে ১০০ উইকেট ছুঁয়েছেন। আর ১৬ টেস্টে ১৮৯৬ সালে ইংলিশ পেসার জর্জ লোহম্যান ওই মাইলফলক ছুঁয়ে এখন পর্যন্ত বিশ্বরেকর্ড দখলে রেখেছেন। কিন্তু বাকি ১০০ উইকেট শিকার করতে সবারই সময় বেশি লাগলেও ধীরে ধীরে যেন আরও ভয়ানক হয়ে উঠছেন ইয়াসির। পরের ১৬ টেস্ট খেলেই বাকি ১০০ উইকট তুলে নিয়েছেন। পেছনে ফেলেছেন সবাইকে। গ্রিমেটের পেছনে আছেন ভারতের অফস্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন (৩৭ টেস্ট) ও অস্ট্রেলিয়ার পেসার ডেনিস লিলি (৩৮ টেস্ট)। পাকিস্তানের পক্ষে আগে এই রেকর্ডটি ছিল ওয়াকারেরই দখলে। টেস্ট ইতিহাসে রেকর্ডের সেই তালিকায় বর্তমানে ৫ নম্বরে নেমে যাওয়া এ সাবেক পাক পেসার ৩৮ টেস্টে ২০০ উইকেট ছুঁয়েছিলেন। ইয়াসির এ বছর মাত্র ৫ টেস্ট খেলে নিয়েছেন ৩৫ উইকেট। চলতি বছরের নৈপুণ্যে তার অবস্থান আট নম্বরে হলেও সবচেয়ে কম টেস্ট খেলেছেন তিনি। ৯ টেস্টের ১৮ ইনিংস বোলিং করে দক্ষিণ আফ্রিকার পেসার কাগিসো রাবাদা ৪৬ উইকেট নিয়ে এখন সবার ওপর এ বছরের নৈপুণ্যে। শ্রীলঙ্কার স্পিনার দিলরুয়ান পেরেরাও সমান ম্যাচ ও ইনিংসে সমানসংখ্যক উইকেট নিয়েছেন। এ বছর আর টেস্ট খেলার সুযোগ নেই ইয়াসিরের, নয়তো সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার হয়তো সম্ভাবনাটা উজ্জ্বল ছিল। কারণ, ফর্মের তুঙ্গে আছেন তিনি সেটা তার নৈপুণ্যই বলে দেয়। কিইউদের বিপক্ষে তিন টেস্টের সিরিজে ২৭ উইকেট নিয়েছেন ইয়াসির। দুবাইয়ে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে নিজের সবচেয়ে ভয়ানক রূপটা দেখিয়েছিলেন ইয়াসির, দুই ইনিংসে তুলে নিয়েছিলেন ১৪ উইকেট। কোন পাকিস্তানী বোলারের এক টেস্টে এটিই সর্বাধিক উইকেট শিকারের যৌথ রেকর্ড। গ্রেট ইমরান খানও ১৪ উইকেট নিয়েছিলেন এক টেস্টে। তার আগে দুবাইয়ে সিরিজে সমতা ফেরানোর টেস্টে প্রথম ইনিংসে ইনিংসে ৪১ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ৮ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংস ৬। অর্থাৎ ১৮৪ রানের বিনিময়ে ম্যাচে ১৪ উইকেট ইয়াসিরের। ১৯৮২ সালে লাহোরে শ্রীলঙ্কার বিপেক্ষ ১৪ উইকেট নিয়েছিলেন ইমরান, ১১৬ রান খরচায়। বর্তমান পাকিস্তান প্রধাণমন্ত্রীর সেই কীর্তি ছোঁয়ার ম্যাচে দলকে সিরিজে সমতা ফেরানো দারুণ এক জয় এনে দেন তুখোড় এ লেগস্পিনার। প্রথম ইনিংসে একটুর জন্য আক্ষেপে পুড়তে হয়েছিল। ৮ উইকেট পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষে ইনিংসে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডটা যে গড়া হয়নি! সেরা ১৯৮৭ সালে লাহোরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আব্দুল কাদিরের ৫৬ রানে ৯ উইকেট। আর ১৯৭৯ সালে মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৮৬ রানে ৯ উইকেট নিয়েছিলেন সরফরাজ নওয়াজ। ৩২ বছর বয়সী ঘূর্ণিবোলারকে শেষ পর্যন্ত গ্রেটের পাশে নাম লিখিয়ে যৌথরেকর্ডেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তবে সিরিজ নির্ধারনী শেষ ম্যাচে দল হারলেও দ্রুততম ২০০ শিকারে ইতিহাস সৃষ্টি করেন ইয়াসির। তুখোড় এ লেগস্পিনার ক্রমেই নিজেকে যে উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে করে বোলিংয়ে এক সময় পাকিস্তান ক্রিকেটের সব রেকর্ডই হয়ত তার দখলেই চলে যাবে। ৩২ বছর- স্পিনার হিসেবে বয়সটাও তার অনুকূলে।
×