ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

তারেক রহমানের মনোনয়ন বাণিজ্য - স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮

 তারেক রহমানের মনোনয়ন বাণিজ্য - স্বদেশ রায়

বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী ফোরামের নেতা সানাউল্লাহ মিয়াকে দেখছি ১/১১ এর পর থেকে নিয়মিতভাবে। এর আগে যে তাকে দেখিনি তা নয়, তবে ১/১১ এর পর থেকে কথাটা উল্লেখ করতে হলো ভিন্ন কারণে। ১/১১ এর পরে ওই সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক শাসনের দুই বছরে বিএনপি ও আওয়ামী ফোরামের অনেক আইনজীবী নেতাকে চুপচাপ থাকতে দেখেছি। আবার উভয় ফোরামের অনেক আইনজীবীকে দেখি নিজের মামলা বা টাকার জন্য নিজ দল থেকে কিছু সময়ের জন্য দূরে থাকেন। আবার সুযোগ বুঝে সামনে চলে আসেন। বিএনপির এই আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়াকে কখনই শেষোক্ত দলের মনে হয়নি। তিনি সব সময়ই তার দলের জন্য নিবেদিত। বেগম জিয়া, তারেক রহমান থেকে শুরু করে বিএনপির অতি সাধারণ কর্মীর মামলায় তাকে সামনের কাতারেই দেখি। এ নিয়ে অনেক সময় টিভিতে তাকে দেখে বলেছি, বিএনপির আইন প্রতিমন্ত্রী। কারণ, ১/১১ এর পরে জজ কোর্টে আওয়ামী লীগের আইনজীবীদের রাজা সৈয়দ রেজাউর রহমানের পাশে সব সময়ই এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে দেখতাম। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে যুদ্ধাপরাধী, ২১ আগস্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলা থাকার কারণে সৈয়দ রেজাউর রহমানকে মন্ত্রী বানাননি। তবে তাকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করেন। অন্যদিকে কামরুল ইসলামকে প্রথমেই আইন প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন। ওই হিসেবে অনেক সাংবাদিক বা অন্যান্য পেশার লোক সানাউল্লাহ মিয়াকে দেখলেই বলেন, বিএনপির ভবিষ্যত আইন প্রতিমন্ত্রী। পার্থক্যটা হলো আইনজীবী কামরুল ইসলামকে মনোনয়ন পেতে কোন বেগ পেতে হয়নি। বেগ পেতে হয়নি প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রী হতে। পর পর তিনবার তিনি বিনা বাধায়, বিনা তদ্বিরে মনোনয়ন পেয়েছেন। শেখ হাসিনা তাকে মনে রেখেছেন। তিনি দুর্দিনের এই কর্মীকে ভোলেননি। অন্যদিকে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য সানাউল্লাহ মিয়া কত চেষ্টা যে করেছেন, লন্ডনে কত লোককে ধরেছেন, তারা যেন তারেক রহমানকে একটু বুঝিয়ে বলেন তাকে মনোনয়ন দেয়ার জন্য। কোন কাজ হয়নি তাতে। লন্ডনে সানাউল্লাহ মিয়া যাদের ফোন করে বার বার অনুরোধ করেছেন, তারাও খুবই ব্যথিত হয়েছেন। তারা কষ্ট পেয়েছেন সানাউল্লাহর মতো একজন নিবেদিত বিএনপির আইনজীবী নেতাকে মনোনয়ন না দেয়ায়। লন্ডনে সানাউল্লাহ মিয়া যাদের ফোন করেছেন, তাদের বক্তব্য হলো, সানাউল্লাহ হেরে গেছেন মূলত অর্থের কাছে। তার নরসিংদী-৩ আসনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে ব্যবসায়ী মঞ্জুর-ই-এলাহীকে। এই ব্যবসায়ীর টাকার কাছে হেরে গেছেন সানাউল্লাহ মিয়া। দলের প্রতি, দলের নেতাদের প্রতি তার দীর্ঘদিনের নিবেদিত পরিশ্রম, মেধা সব কিছু মূল্যহীন হয়ে গেছে টাকার কাছে। সানাউল্লাহ মিয়া লন্ডনে যাদের ফোন করেছিলেন তারা প্রায় সবাই এ বিষয়ে তারেক রহমানকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন তাদের সাধ্যমতো। কারণ, তাদের অনেকেই উপকৃত হয়েছেন সানাউল্লাহ মিয়ার কাছ থেকে। পাশাপাশি তারা দলের প্রতি, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের প্রতি সানাউল্লাহ মিয়ার কর্তব্যনিষ্ঠাও দেখেছেন। তাই লন্ডনের ওই ব্যক্তিদের ভেতর কয়েকজনের বক্তব্য হলো, “তারেক রহমান আসলে মানুষ নয়। সে টাকা ছাড়া কিছু চেনে না। লন্ডনেও ‘হাওয়া ভবন’ খুলেছে তারেক রহমান। এখানেও সে নানান সুযোগে টাকা রোজগার করে। তিনি আরও বলেন, বাস্তবে এত কিছুর পরেও তারেকের কোন পরিবর্তন হয়নি। সে এই নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে লন্ডনে ‘হাওয়া ভবন’ খুলেছে তাহলে দেশে ফিরতে পারলে সে কী করবে? লন্ডনের আরেক জনের বক্তব্য হলো, তারেক রহমান লন্ডনে তার ইনকাম ট্যাক্সের ফাইলে দেখিয়েছে, আয়ের উৎস জুয়া খেলা (লন্ডনে জুয়া খেলা বৈধ)। বাস্তবে সে যে কত কিছু নিয়ে জুয়া খেলতে পারে তার প্রমাণ এবারের মনোনয়ন বাণিজ্য।” সানাউল্লাহ মিয়া, এহসানুল হক মিলন, তৈমুর আলম খোন্দকার সকলেই এই টাকার কাছে হেরে গেছেন। এমনি বিএনপির অনেক নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ও নেতারা হেরে গেছেন টাকার কাছে। এদের ভেতর অনেকেই তাদের কর্মীদের নিয়ে বিএনপি অফিসের সামনে এসেছিলেন। অনেক প্রতিবাদ করেছেন। তোপের মুখে পড়েছেন ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে ডা. জাফরুল্লাহসহ অনেকে। তারা কেউ অবশ্য কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। ডা. জাফরুল্লাহ বলেছেন, দল ক্ষমতায় গেলে এদের পুরস্কৃত করা হবে। দল ক্ষমতায় গেলে পুরস্কৃত করার উদ্দেশ্যে যদি এ কাজ করা হতো তাহলে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছ থেকে টাকা নেয়া কেন? আর যোগ্য প্রার্থী বাদ দিয়ে যখন ব্যবসায়ীকে দেয়া হয় সেটা কি দলকে ক্ষমতায় নেয়ার জন্য? বরং বিএনপির কিছু কিছু হিতাকাক্সক্ষী যা বলছেন সেটাই কি সত্য নয়, তারেক রহমান থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম সকলেই জানেন, তারা নির্বাচন করছেন সংসদের বিরোধীদলীয় মর্যাদাটা পুনরুদ্ধার করার জন্য। তারেক রহমান ভালভাবে জানেন, তিনি দেশে ফিরতে পারবেন না। তাই তিনি কোন মতেই মনোনয়ন উপলক্ষ করে টাকা রোজগারের এই মওকা ছাড়েননি। তা ছাড়া বাস্তবতা বলছে, এসব টাকা যে তারেক রহমান পাবেন তাও কিন্তু নয়। এখান থেকে তাকে একটি অংশ ব্যয় করতে হবে ড. কামাল হোসেনের জন্য। কারণ, ড. কামালকে যারা চেনেন তারা সকলেই ভাল করে জানেন, বড় মাপের ফিস ছাড়া এই আইনজীবী কোন কাজে নামেন না। নিজের অর্থ ব্যয়ে তিনি বাংলাদেশের জন্য মাত্র এক টাকার কাজ করেছেন তা কেউ দেখাতে পারবেন না। আইনজীবী রফিকুল হক ক্যান্সার হাসপাতাল করেছেন। এ ছাড়া অনেক আইনজীবী আছেন তাদের নিজ অর্থে নিজ নিজ এলাকায় স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, হাসপাতাল থেকে অনেক কিছু করেছেন। বাংলাদেশের জন্য ড. কামাল একটি টাকা ব্যয় করেছেন তা কেউ দেখাতে পারবেন না। তাই তিনি যে হঠাৎ শুধু খালেদা জিয়ার দুর্নীতি নয়, তারেক রহমানের দুর্নীতি ও নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন এটা বিনা স্বার্থে তা বাংলাদেশের কোন সুস্থ মানুষ বিশ্বাস করবে না। বরং ভবিষ্যতে একদিন না একদিন এসব ডিলের অর্থের পরিমাণ কত তা জানা যাবে। তবে তারেক রহমানের এই মনোনয়ন বাণিজ্যে তার যোগ্যতার আবারও একটি স্বীকৃতি মিলল। তিনি প্রমাণ করলেন, তার ‘হাওয়া ভবন’ খুলতে বা ঘুষের টাকা যোগাড় করতে বাংলাদেশে থাকার প্রয়োজন পড়ে না। তিনি মূলত সাগরের ঢেউ গুনেও টাকা রোজগার করতে পারেন। আর নিজ দলের মানুষদের কাছ থেকে এই টাকা নিয়ে তারেক রহমান আবারও দেশের মানুষের সামনে প্রমাণ করলেন, তিনি আবার ক্ষমতায় এলে দেশে কত বড় আকারের ‘হাওয়া ভবন’ হবে। অবশ্য দেশের কয়েকটি পত্রিকায় এমন কিছু লেখালেখি হচ্ছে যে- ড. কামাল এসেছেন একটি ব্যালান্স করার জন্য। এখানে দুটি বিষয় কাজ করছে : নির্বাচন শেষে ড. কামালের কতটুকু ক্ষমতা থাকবে আর বাস্তবে কি ড. কামাল কখনই এসব ঢেউ গোনা টাকার বিরুদ্ধে? ড. কামালের ভবিষ্যত সম্পর্কে এক বিএনপি নেতার একটি কথার ভেতর দিয়ে ইঙ্গিত পাই। মহানগর নাট্যমঞ্চে গিয়ে বিএনপি ড. কামালের ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিলে এক বিএনপি নেতাকে বলেছিলাম, আপনারা শেষ পর্যন্ত ড. কামালের কাছে গেলেন? তিনি অকপটে বললেন, দেখেন আমাদের গায়ে পেট্রোলবোমা আর জামায়াতের ছাপ পড়ে গেছে। আপাতত ড. কামালকে দিয়ে বিষয়টা ঢেকে নেই। পরে বোয়াল মাছ কি করে পুঁটি মাছকে? আমরাও তাই করব। দুই. আরেকটি সত্য দেশের মানুষ ভেবে দেখতে পারেন। ড. কামাল হোসেনের মেয়ের স্বামী ডেভিড বার্গম্যান বিবিসির চ্যানেল ফোরে কাজ করেছেন। আইনজীবীও। এসব ছেড়ে তিনি বছরের পর বছর ঢাকার নিউএজে কাজ করলেন আর যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে নিউজ করলেন। আরও অদ্ভুত বিষয় হলো, বার্গম্যান এগুলো তার বিশ্বাস থেকে করেনি। একজন সাংবাদিক বন্ধু হিসেবে তার সঙ্গে যখনই আলাপ করেছিÑ বুঝতে পেরেছি, বাস্তবতা তিনি বোঝেন। তার পরেও কোন একটা উদ্দেশ্য থেকে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের সাহায্য করে যাচ্ছেন। তাদের পক্ষে সাংবাদিকতা করছেন। কেন করছেন? লাভটা কি? এখানে কি তারেক রহমানের মতো ঢেউ গোনার কোন বিষয় আছে! যুদ্ধাপরাধীদের দলটি অর্থের সাগর। যাহোক, ড. কামাল সেটা মেনে নিয়েছেন। এ কথা কেউ বলছেন না যে, তিনি বার্গম্যানের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবেন। তা কেউ আশা করে না। তবে ড. কামালও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সমর্থন করেননি। তার সপক্ষে দাঁড়াননি। অর্থাৎ মৌন থেকে তিনি মূলত বার্গম্যানকেই সমর্থন করে গেছেন। এখানেও সন্দেহ থেকে যায় ‘ঢেউ গোনার’ বিষয়টি। তবে নিজ দলের মনোনয়ন বাণিজ্যের ভেতর দিয়ে তারেক রহমান দেখিয়ে দিলেন, ড. কামাল বলেন, বার্গম্যান বলেন, ঢেউ গুনে অর্থ অর্জনে তারেক রহমানের ধারে কাছে কেউ নয়। হয়ত পৃথিবীতেই তিনি অদ্বিতীয়। তবে ভোটের আগে জনগণের সামনে তারেক রহমানের স্বরূপ প্রকাশ পাওয়ায় অনেক উপকার হলো দেশের। মানুষ আরেক বার সজাগ হতে পারল, তারেক রহমান যেখানেই থাকবে সেখানেই ‘হাওয়া ভবন’ হবে। দেশকে হাওয়া ভবনের হাত থেকে বাঁচাতে হলে যতই ড. কামালের ছদ্মবেশে তারেক রহমান আসুক না কেন, দেশের মানুষকে তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে। নইলে দেশের সব উন্নয়ন হাওয়া হয়ে যাবে। [email protected]
×