ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চোটপাটের বদলে নরম স্বর, দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মহারথীরা

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮

চোটপাটের বদলে নরম স্বর, দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মহারথীরা

মোরসালিন মিজান ॥ অন্য সময় বিরাট নেতা। সদ্য ভাঁজ খোলা পাঞ্জাবি। পুলিশ দারোগার ভারি বুট পরা স্যালুট। লোক তাড়ানোর হুইসেল। দামী জিপের কালো গøাসে মুখ আড়াল করে চলে যাওয়া। কারণে অকারণে চোটপাট। অন্যদিকে ক্ষমতায় এলে দেখে নেয়ার হুমকি। দেশছাড়া করার আগাম ঘোষণা। তবে এখন সবকিছু বদলে যাচ্ছে। উল্টো ছবি। বাঘটি বিড়াল হয়ে মিও মিও করছে। গলায় জোর নেই। বুকে ভালবাসা খুব। যাকে সামনে পাচ্ছেন, জড়িয়ে ধরতে ভুল করছেন না। মুদি দোকানির হাত ধরে বেদম ঝাঁকাচ্ছেন। মাথা নিচু করে ঢুকে পড়ছেন নাপিতের দোকানে। ঝাড়ুদারের বউ বাচ্চার খোঁজ নিচ্ছেন। আহা, কী সময় এসেছে! প্রতি পাঁচ বছর পর পর এমন সময় আসে। এবারও এসেছে। আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে প্রচারে ব্যস্ত এখন প্রার্থীরা। মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়ার কঠিন যুদ্ধ। যুদ্ধে বিজয়ীরা প্রতীক নিয়ে মাঠে নেমেছেন। গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে প্রচার। এখন রাস্তায় নামলেই নৌকা। অলিতে গলিতে ধানের শীষ। লাঙ্গলসহ অন্যান্য প্রতীকও দেখা যাচ্ছে। প্রতীক উর্ধে তুলে ধরে স্লোগান দিচ্ছেন কর্মীরা: আমার ভাই তোমার ভাই...। নেতারা মায়ের পেটের ভাই রূপে আবির্ভূত হয়েছেন! সব নেতারই চরিত্র, কী আশ্চর্য, ফুলের মতো পবিত্র। এলাকাবাসীর ভোট চাইছেন তারা। দোয়া চাইছেন। বুধবার দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টুঙ্গিপাড়ায় যান আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। দলের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের মধ্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেন। একই দিন সিলেটে হযরত শাহজালাল (র) মাজার থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট। এর পর থেকে সারা দেশেই উৎসবের আমেজ। জমে উঠেছে প্রচার। ঢাকার তারকা রাজনীতিবিদরা ঢাকায় ছেড়েছেন আরও আগে। মার্সিডিজে চড়ে অভ্যস্থ নেতারা মোটরসাইকেলে চড়ে গ্রামের পর গ্রাম প্রদক্ষিণ করছেন। ক্লান্তি নেই। নিলফামারী থেকে নির্বাচন করছেন প্রখ্যাত অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। বুধবার রাতে ফোনে আলাপকালে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমি সব সময়ই এলাকায় থাকার চেষ্টা করি। আর এখন তো নির্বাচন। দশ/পনেরো দিন ধরে টানা অবস্থান করছি। নির্বাচনের আগে কয়েক মুহূর্তের জন্য ঢাকায় আসা হতে পারে। বাকি সময় এলাকায় দেবেন বলে জানান তিনি। মোটরসাইকেলে চড়ে প্রচারে অংশ নেয়ার কথা বলা হচ্ছিল। আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর মতো প্রবীণ নেতা অনায়াসে এই বাহনে চড়ছেন। কালিহাতী চষে বেড়াচ্ছেন। ইউটিউভে আপলোড করা ভিডিও দেখে বুঝতে বাকি থাকে না, নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি জনগণের কাছে পৌঁছতেই সমস্ত আরাম আয়েম পরিত্যাগ করেছেন প্রার্থীরা। রাজধানীতে পাশাপাশি বাসা। কেউ কাউকে চেনেন না। কিন্তু ভোটের সময় যেহেতু, প্রার্থীরা বাসায় বাসায় গিয়ে কল বেল বাজাচ্ছেন। ভোট ভিক্ষা করছেন। ঢাকার ১৫টি আসনে এবার বিপুলসংখ্যক প্রার্থী। সবাই এখন মাঠে। ইতোমধ্যে পোস্টারে ছেয়ে গেছে কোন কোন এলাকা। ঢাকা ৯ আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে লড়ছেন সাবের হোসেন চৌধুরী। খিলগাঁও এলাকার অলিতে গলিতে তার পেস্টার। নৌকা প্রতীকে ভোট চাইছেন তিনি। বিকেলে শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে জায়গাটিকে রীতিমতো নতুন মনে হচ্ছিল। খোলা জায়গায় রশি টানিয়ে তাতে পোস্টার ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অসংখ্য পোস্টার। দীর্ঘ সারি। পোস্টারে রাশেদ খান মেননের ছবি। ঢাকা ৮ আসনে মহাজোটের হয়ে লড়ছেন তিনি। ভোট বলে কথা। ওয়ার্কার্স পার্টির প্রধান নেতার পোস্টারের উপরিভাগে দেখা গেল শেখ হাসিনার প্রতিকৃতি। একই আসনে রাশেদ খান মেননের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মির্জা আব্বাস। পোস্টার লাগানোর পাশাপাশি মঙ্গলবার তাকে নিজ হাতে প্রচারপত্র বিলি করতে দেখা যায়। এ সময় যানবাহনের মাঝখান দিয়ে দিব্যি হেঁটে পার হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। পথচারীদের থামিয়ে দিয়ে ভোট চাইছিলেন। গাড়ির জানালার কাছে মাথা নুইয়ে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছিলেন। মাইকের ব্যবহারও শুরু হয়ে গেছে। দূর থেকে অমুক ভাইয়ের পক্ষে সালাম দিয়ে ভোট চাওয়া হচ্ছে। তমুক ভাইয়ের জন্য চাওয়া হচ্ছে দোয়া। ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে বেল চেপে ভোট চাইতেও দ্বিধা নেই। মঙ্গলবার ফজলে নূর তাপসকে ধানমন্ডি এলাকার বসা বাড়িতে গিয়ে ভোট চাইতে দেখা যায়। আলাদা করে বলতে হয় ক্রিকেট মাঠের কথা। বর্তমানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে ওয়ান ডে সিরিজ খেলছে বাংলাদেশ। বরাবরের মতোই টাইগারদের পক্ষে নানা স্লোগান দিচ্ছেন গ্যালারিতে বসা দর্শক। প্রথম দিন মিরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামে শোনা গেল ‘নৌকা’ ‘নৌকা’ ধ্বনি। একই সময়ে কানে এলো ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। কারণটি বুঝতে দেরি হলো না। এবার আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচনে আছেন ওয়ান ডে দলের অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। তিনি বল হাতে নিয়ে দৌড় শুরু করতেই দর্শক তাকে সমর্থন জানিয়ে এসব স্লোগান দিচ্ছিলেন! এদিকে প্রচার অনুষঙ্গ হতে পারে এমন রেডিমেড পণ্যও পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের ফুটপাথে সাজানো আছে লেখার কলম, কফি খাওয়ার মগ, বুকে ধারণ করার নানা ব্যাজ। সবকিছুতেই নৌকা প্রতীক। জাতির জনকের ছবি। শেখ হাসিনা। সীমিত পরিসরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও তুলে ধরা হয়েছে। বিক্রি হচ্ছে প্রচারমূলক অডিও এবং ভিডিও সিডি। বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এসব বেশি বেশি করে কিনে কর্মীদের মধ্যে বিলাচ্ছেন নেতারা। আবার পল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে বিক্রি হচ্ছে ধানের শীষের নানা মডেল। স্মারক উপহার। এখানেও বিক্রি ভাল বলে জানা যায়। সব মিলিয়ে নির্বাচনী আমেজটা টের পাওয়া যাচ্ছে। জনগণের কাছে যাওয়ার এই প্রয়াস দেখে সত্যি ভাল লাগে। আহা, নেতারা যদি এভাবে সারা বছরই মানুষের পাশে থাকতেন!
×