ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মূকাভিনয়ের ইতিকথা

প্রকাশিত: ০৭:০০, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮

 মূকাভিনয়ের ইতিকথা

সৃষ্টির প্রারম্ভ থেকেই মূকাভিনয়ের উৎপত্তি। কারণ পৃথিবীতে মানুষ যখন প্রথম ভূমিষ্ট হলো, তখন মানুষের কোন ভাষা ছিল না। হয়ত শব্দ উচ্চারণের ক্ষমতা তার ছিল, কিন্তু সেই শব্দ ভাষায় প্রয়োগ করার ক্ষমতা মোটেই ছিল না। মানুষ তখন নানা রকম অঙ্গভঙ্গির দ্বারা একের ভাষা অপরকে বোঝাতে চেষ্টা করত। মনের ভাব প্রকাশ করত হাত নেড়ে ও চোখের ইশারায়। তখন নানা মানসিক ভাবাবেগ বা অবস্থা যথা- ভয়, আনন্দ, উত্তেজনা, আবেগ, যন্ত্রণা, উল্লাস, ব্যঙ্গ, রাগ, ঘৃণা ইত্যাদি পূর্বে মানুষ চোখের ভাষায় প্রকাশ করত। এই ভাষাটা হলো মূক ভাষা। খ্রিস্টীয় সপ্তম ও অষ্টম শতকে ‘বুদ্ধের নাটক’ নামে এক প্রকার নাটক প্রচলিত ছিল, যাতে বৌদ্ধ ভিক্ষুকরা বিভিন্ন ভঙ্গিতে বুদ্ধের নীতি, রীতি এবং আদর্শ দর্শকদের সামনে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে প্রচার করত। দক্ষিণ ভারতে ছিল লোকগাথা। এতে প্রথমে দু’কলি গেয়ে দেয়া হতো প্রারম্ভিক হিসেবে। তারপর বিভিন্ন চরিত্র এসে তাদের সেই গানের ভাবার্থটি মূকাভিনয়ের সাহায্যে বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। মূকাভিনয় শিল্পকলারই একটি অঙ্গ, সৃজনীমূলক অভিনয় যদি সত্যি আমাদের আবেগ প্রকাশ করে এবং অপরকে সেই বোধগম্যতায় সাহায্য করে, তাহলে এ কথা নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে, মূকাভিনয় বাস্তবিকই শিল্পকলারই একটি অঙ্গ। কারণ অভিনয়ের বিশেষ বিশেষ মুহূর্ত ও ভাব প্রকাশের জন্য মূকাভিনয় একান্ত অপরিহার্য, কখনও কখনও বা একমাত্র উপজীব্য। এও দেখা যায় যে, বিশেষ বিশেষ ভাব বা রসের শৈল্পিক রূপায়ণে মূকাভিনয়ই একমাত্র বা অমর হয়ে ওঠে। যে কথ্য ভাষার প্রয়োগে নাটক ও অভিনয় জীবন্ত হয়ে ওঠে, কোন কোন মুহূর্তে সেই ভাষার ভাব প্রকাশের অপ্রতুলতা ধরা পড়ে। তখন দেখা যায় সামান্য কোন নীরব ভঙ্গিমার মাধ্যমেই হয়ত ভাষার চেয়েও বেশি ভাব প্রকাশ সম্ভব হয়। বস্তুত অভিনয় ও শিল্পকলায় বিভিন্ন নিয়মকানুন প্রবর্তন করেছেন যিনি সেই মহর্ষি ভরতমুনির ‘নাট্যশাস্ত্র’ পড়লে বোঝা যায়, অভিনয় শিল্পকলায় মূকাভিনয় এর স্থান কত বেশি। পাশ্চাত্য দেশসমূহে মূকাভিনয় সম্মানীয় স্নেহচ্ছায়ায় তার নিজের আসন প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এই শিল্পের উৎকর্ষ সাধনের জন্য এখনও এই সমস্ত দেশে চেষ্টার অন্ত নেই। কিন্ত আমাদের দেশ সনাতন এই শিল্পকলার যথেষ্ট সমাদর হয়নি। যদিও মূকাভিনয় আমাদের দেশের অতি প্রাচীন ও ঐতিহ্যমন্ডিত এক শিল্প মাধ্যম। এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে, অভিনয় শিল্পের অন্যতম অঙ্গ হলো নিখুঁত অভিব্যক্তি কারণ সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনাকে বিশেষ বিশেষ অভিব্যক্তির মাধ্যমে যতখানি প্রকাশ করা সম্ভব, ততখানি প্রকাশ আর কোন কিছুর মাধ্যমেই সম্ভব নয়। তাই সব অভিনেতাকে শিক্ষা নিতে হয়, কেমন করে মঞ্চে চলতে হবে, কথা বলতে হবে, অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে হবে। অভিনেতার নিজস্ব কাজটুকু ছাড়াও মঞ্চের অন্যান্য চরিত্র, দৃশ্যপট, সঙ্গীত, আলো প্রভৃতি সাহায্য করে অভিনয়ের সমগ্রতাকে। এই ঊনবিংশ শতকেরই প্রথম দিকে মূকাভিনয়ের শ্রেষ্ঠ শিল্পী ছিলেন ‘দেবুরো’ নামক ফরাসী অভিনেতা। পরবর্তীকালে বিশেষ করে ফ্রান্সেই এই শিল্পকৌশল আরও পরিণতি লাভ করে। এই ফ্রান্সেই বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে জন্মগ্রহণ করেন প্রখ্যাত ‘এতিয়েন দ্যক্র’ এবং আরো পরে ‘জ্যালুই বারো’ ও মার্সে মার্সো। মার্সোই হলেন বর্তমান পৃথিবীর সর্বাগ্রগণ্য মূকাভিনেতা। ফরাসী বিপ্লবের কালে যখন মানুষের মুখ বন্ধ করে দেয়া হলো, তখন মূকাভিনয়ের প্রচলন খুব বেশি হয়েছিল, কারণ মুখের কথা বন্ধ করলেও মূকাভিনয় বন্ধ করা যায়নি। এই মূকাভিনয়ের মাধ্যমেই গ্রামে-গঞ্জে, শহরে ফরাসী দেশের বিক্ষোভকে জাগিয়ে তোলা হয়েছিল, বিক্ষোভকারী জনসাধারণ এই ‘গরসব’-এর মাধ্যমে বিক্ষুব্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়ে ফরাসী বিপ্লবকে সাফল্যের পথে নিয়ে গিয়েছিল। আমাদের দেশে মূকাভিনয় একক শিল্প মাধ্যম হিসেবে খুব প্রচলিত ছিল না। ভারতবর্ষে প্রথম একক মূকাভিনয়ের চেষ্টা চলে ১৯৫৬ সালে। ১৯৫৮ সালে ‘থিয়েলো সুলরা’, ইনি ওয়েস্টবেঙ্গল একাডেমি অব ডান্সড্রামাতে (জোড়াসাকুর ঠাকুরবাড়ি) প্রথম একক মূকাভিনয় পরিবেশন করেন। তারপর ১৯৬০ সালে নিউ এম্পায়ারে ‘মার্সে মার্সোর’ ঐতিহাসিক আবির্ভাব ঘটে। তারপর এলেন জার্মানির ‘রলফ শার’ ও রাশিয়ার ‘ইউএনজুরী’। এসব শিল্পীর অপূর্ব অভিনয়নৈপুণ্যে এবং সর্বসঞ্চারী এই অদ্ভুত নিঃশব্দ ভাষায়, আর আবেগ প্রকাশের আশ্চর্য শক্তিতে অভিভূত হয়ে গেল সমস্ত দর্শক সমাজ। হৃদয়স্পর্শী এই নীরব ভাষা দর্শকরা দেখল, বিশ্বের সমস্ত সাধারণ মানুষ এক। তারা সকলেই একইভাবে আনন্দ বেদনায় আন্দোলিত হয়। ইদানীং ভারতবর্ষে, ইংল্যান্ডে, আমেরিকায়, রাশিয়াতে, জার্মানিতে, অস্ট্রিয়া ও ফ্রান্সে মূকাভিনয় চর্চা বেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। মানুষের গতি বা চলা, হাঁটা, বলা সবটাই তার প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হয়। আমি পোশাকের আলমারি খুলতে যাচ্ছি কিংবা রান্নাঘরের মিট্সেফ্্ খুলতে যাচ্ছি, এ যাওয়ার উদ্দেশ্য দু’রকম-তাই যাওয়াটাও আলাদা হবে। ক্ষুধার্ত ছেলেটি মিট্সেফ্্ খুলতে পারে আবার এক লোভী ছেলে মিট্সেফ্্ খুলতে পারে- দুক্ষেত্রে মূক নাট্যায়ন দু’রকম হবে। দর্শক যেন বুঝতে পারে এই দুই ভিন্ন উদ্দেশ্য। সাধারণ নাচে যে মুদ্রা ব্যবহার হয় সেই মুদ্রার ভাব ও ভঙ্গি বুঝতে হলে সেই মুদ্রার আলফা-বিটা জানা প্রয়োজন। তা না হলে মুদ্রার অর্থ বোঝা যায় না। কিন্তু মূকাভিনয়ে যে মুদ্রা ব্যবহার হয় সাধারনত দৈনন্দিন জীবনে ও সচরাচর আমরা যেভাবে বাস্তবে হাত পা সঞ্চালন করি ঠিক সেভাবেই করা হয়। বিশেষ করে ইলিউসানের দিকে নজর রাখা হয় যাতে করে সমস্ত ব্যাপারটা জীবন্ত হয়ে ওঠে। মনে রাখতে হবে Illusion না আসা পর্যন্ত মূকাভিনয় শিল্পের সৃষ্টি হয় না।
×