ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আর বাকি ১৫ দিন

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ইসির বৈঠক

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

 আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর  সঙ্গে ইসির বৈঠক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ২০১৪ সালের সহিংস অবস্থার কথা মাথায় রেখেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনের নিরাপত্তার ছক তৈরি করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি নির্দেশ দিয়েছে ইসি। তাদের উদ্দেশে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে পেছনের একটা ঘটনার রেশ টানা প্রয়োজন। সেটি হলো ২০১৪ সালের নির্বাচন। ওই সময়ের নির্বাচনের অবস্থা ভুলে গেলে চলবে না। ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সে অবস্থার আলোকে আমাদের এ বছরের নির্বাচনের প্রস্তুতির রূপরেখা অবলম্বন করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন। এ সময় তিনি প্রচারের শুরুতে সহিংসতার ঘটনায় তৃতীয় কোন পক্ষ জড়িত কিনা তাও খতিয়ে দেখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি নির্দেশ দেন। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে আরও বলেন, নির্বাচন নিয়ে যখন স্বতঃস্ফূর্ত জনজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তখনই খুনের ঘটনা ঘটল। এসব খুন ও হামলার ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে করার কোন কারণ নেই। দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হোক, তা না চাওয়ার দলে প্রভাবশালী মহল সক্রিয় থাকতে পারে। তাদের বিষয়ে নির্বাচন কর্তৃপক্ষ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, সমাজের সচেতন মহল ও জনগণের সচেতন থাকা প্রয়োজন। বৃহস্পতিবার নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচন কমিশন। বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি ছাড়াও রিটার্নিং কর্মকর্তা এবং জেলা ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তারা অংশ নেন। সকাল সাড়ে ১০টায় আগারগাঁও নির্বাচন ভবনের অডিটরিয়ামে সিইসির সভাপতিত্বে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর কমিশনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্লোজডোর আলোচনা হয়েছে নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে। তবে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে তিন বিশেষ নির্দেশনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রার্থীরা যাতে নির্ভয়ে কোন বাধাবিঘ্ন ছাড়াই প্রচারে অংশ নিতে পারেন সেই পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানানো হয়েছে। পাশাপাশি নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন ভোটাররা যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে সে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানানো হয়। এছাড়া নির্বাচন আইনানুগ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আলোচনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। ইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে নির্বাচন সামনে রেখে কেউ যেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়াতে না পারে। এই মাধ্যমের প্রতি কঠোর নজরদারি করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া নির্বাচনে কবে থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে সে বিষয়ে সঠিক কোন সিদ্ধান্ত না নেয়া হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ১০ দিন আগে সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বাচন ঘিরে জঙ্গী তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে টার্গেট কিলিংয়ের শঙ্কা রয়েছে। বিষয়টি মোকাবেলায় এখনই প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। এছাড়া নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব রোধে মোবাইল ব্যাংকিং নির্বাচনের তিন দিন আগে থেকে বন্ধ রাখার জন্য বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়। ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কাউকে মোবাইল নিয়ে প্রবেশের অনুমতি না দেয়ার প্রস্তাবও করা হয়। ভোটের দিন ইন্টারনেটে গতি কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এদিকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনেও মাঠে সব বাহিনী ছিল। সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ছিল। তবুও আমরা দেখেছি পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন, প্রিসাইডিং অফিসার নিহত হয়েছেন, ম্যাজিস্ট্রেট নিহত হয়েছেন, শত শত মানুষ নিহত হয়েছেন, শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভস্মীভূত হয়েছে। সেটার কী পরিপ্রেক্ষিত ছিল, আমরা কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি, সে প্রসঙ্গে আলোচনা করার সুযোগও প্রয়োজন। সে অবস্থা থেকে কীভাবে উত্তরণ করা যায়, ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সে পরিবেশ-পরিস্থিতির সৃষ্টি যাতে না হয়, সেদিকে সতর্কতার সঙ্গে দৃষ্টি রাখতে হবে। এবারের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি দায়িত্ব জনগণের জীবন রক্ষা, মালামাল রক্ষা, দেশের পরিবেশ- পরিস্থিতি শান্ত রাখা। তিনি বলেন, এবারও এমন কিছু ঘটার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। যেদিন প্রতীক বরাদ্দ হলো, তার পরের দিনই দুর্ঘটনা। সে ঘটনা যত ছোটই হোক না কেন, দুটো জীবন চলে গেল। সে দুটো জীবনের মূল্য অনেক। কিন্তু কেন হলো? তারপর এখানে ওখানে ভা্চংুর প্রতিহত করা। এগুলোর পেছনে কি রাজনৈতিক, সামাজিক কারণ? নাকি সেই ২০১৪ সালের মতো ভয়াবহ পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে? এগুলো ভালভাবে নজরে নিতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সতর্ক নজরদারি থাকতে হবে। কোন ঘটনা ঘটে গেলে একজনের দোষ আরেকজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হালকাভাবে নিলে হবে না। রাজনৈতিক নেতাদের সতর্ক অবস্থান নেয়ার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে তৃতীয় কোন শক্তির ষড়যন্ত্র আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতি সতর্ক নজরদারি রাখার অনুরোধ করব উল্লেখ করেন। তিনি বলেন নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে হলে, প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকার মস্তান ও গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের তালিকা তৈরি করতে হবে। ভোটের ভাগ্য সন্ত্রাসীদের হাতে দেয়া যাবে না। সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজন হলে তাদের আটক করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিনা কারণে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না। কারও বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা যাবে না। সংঘবদ্ধভাবে প্রজাতন্ত্রের সব বিভাগ নির্বাচনের দায়িত্বে সম্পৃক্ত হয়েছে। সংবিধান ও আরপিওর বলে এখন সব দায়িত্ব আপনাদের কাছে। নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করেন- নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি সম্পন্ন হয়েছে। ব্যালট পেপার ছাপানোর মতো টুকিটাকি কাজ বাকি আছে। ভোটকেন্দ্র নির্ধারিত হয়েছে, ভোটারদের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রত্যাশা করব, পেশাদারি ও নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা ও মানসিকতা নিয়ে এবারের নির্বাচন মোকাবেলা করতে পারব। এবারে যেন সেবারের মতো তান্ডব না ঘটে সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে। আশঙ্কাগুলো একেবারে অবহেলা করতে পারি না। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সতর্ক নজরদারি রাখতে হবে। একটা ঘটনা হালকাভাবে দেখলে চলবে না। ইভিএম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ইভিএম ব্যবহার করতে চাই। বাক্স ছিনতাইকারীর হাত থেকে ভোটারদের মুক্তি দিতে হবে। তার প্রধান ও প্রথম উপায় যে পদ্ধতিতে ভোট চলছে, তার পরিবর্তে আরেকটি পদ্ধতি আনতে হবে। কমিশন বিশ্বাস করে ইভিএমের বিকল্প পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ভোটারদের নিশ্চয়তা প্রদান সম্ভব হবে। ইভিএম সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হলে শতকরা ৮০ ভাগ অনিয়ম দূর করা সম্ভব হবে। সমগ্র নির্বাচন ইভিএমের অধীনে নিয়ে আসার লক্ষ্য নিয়ে ইসি অগ্রসর হচ্ছে। এটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কারণ বর্তমান পদ্ধতিতে নির্বাচনের অনিয়ম দূর করতে এটাই একমাত্র নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। নির্বাচন কমিশন মনে করে, ইভিএম সে রকম একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে ভোটারদের ভোটের নিশ্চয়তা প্রদান করা সম্ভব হবে। আমরা ছয়টি এলাকায় ইভিএম ব্যবহার করতে যাচ্ছি। সে ছয়টি এলাকায় যার যার দায়িত্ব তাদের অনুরোধ করব আলাদাভাবে দৃষ্টি দিতে, সতর্কতামূলক ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে উল্লেখ করেন। বলেন, পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করতে হবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে। স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে সব বাহিনীর কৌশল অবলম্বন করতে হবে। সব গোয়েন্দা সংস্থার সতর্ক নজরদারি বাড়াতে হবে। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিজিবিকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজন হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিশ্চয়তা, তাদের দিকে নজর দিতে হবে। মহিলাদের দিকে নজর দিতে হবে। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি আলাদাভাবে দেখতে হবে। যেন তারা ভোট দিয়ে নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারে। প্রত্যেক এলাকার মস্তান ও গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের তালিকা তৈরি করতে হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার, ইসি মাহবুব তালুকদার, মোঃ রফিকুল ইসলাম, শাহাদত হোসেন চৌধুরী, কবিতা খানম ছাড়াও ইসি সচিব হেলালুদ্দিন আহমদ, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দিন, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে.জে. মাহফুজুর রহমান, মহাপুলিশ পরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, মে. জে কাজী শরীফ কায়কোবাদ, মহাপরিচালক আনসার ভিডিপি, মে.জে. সাফিনুল ইসলাম মহাপরিচালক বিজিবি, মে. জে এটিএম জোবায়ের মহাপরিচালক এনএসআই, মে. জে মোঃ সাইফুল আবেদীন মহাপরিচালক ডিজিএফআই, রিয়ার এ্যাডমিরাল এএমএমএম আওরঙ্গজেব মহাপরিচালক কোস্টগার্ড, র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ডিএমপির পুলিশ কমিশনার মোঃ আসাদুজ্জামান মিয়া, স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক মীর শহিদুল ইসলাম, কমিশনের অতিরিক্ত সচিব মোঃ মোখলেসুর রহমান এবং জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনু বিভাগের বি. জে সাইদুল ইসলাম বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
×