ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সূর্য রাঙা ভোর ॥ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস

প্রকাশিত: ০৭:১১, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

সূর্য রাঙা ভোর ॥ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস

সূর্য রাঙা ভোর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর সেনানীর জীবন সংগ্রামের গল্প। যার সংগ্রাম দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অব্যাহত ছিল। পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করে দেশ ত্যাগ করলেও এ দেশের সার্বিক অবকাঠামো ভঙ্গুর অবস্থায় রেখে যায়। তোফায়েল হোসেন সূর্য রাঙা ভোর বইটিতে এক সৎ দেশপ্রেমিক ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধা আকবরকে সামনে এনে সেই নাজুক পরিস্থিতির চিত্র দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে এসেছে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রেম, যুদ্ধ এবং টিকে থাকার সংগ্রামের বাস্তব চিত্র। সূর্য রাঙা ভোর রচয়িতা তোফায়েল হোসেনের জন্ম কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের পদ্মাচরের এক নিভৃত পল্লীতে। পিতার কর্মসূত্রে দেশের নানা প্রান্তে বেড়ে উঠেছেন তিনি। লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন)- এ যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বিভিন্ন জেলায় চাকরি করে বর্তমানে তোফায়েল হোসেন পাবনা জেলার ফরিদপুরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদে কর্মরত আছেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী বাঙালী জনসাধারণ যুদ্ধের ভয়াবহতা চোখে দেখেনি। দেখেনি পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা, খাদ্যদ্রব্যের অপর্যাপ্ততা, দেশীয় সুবিধাভোগী বাহিনীর অপতৎপরতা। সব মিলিয়ে দেশে তখন এক সঙ্কটাপন্ন অবস্থা বিরাজ করছিল। বিভীষিকাময় সেই দিনগুলোর কাহিনী পরবর্তী প্রজন্মের কাছে দ্ব্যার্থকভাবে তুলে ধরার অন্যতম একটি মাধ্যম হলো সাহিত্য। সময়ের গর্ভে অনেক কিছু বিলীন হয়ে গেলেও কালের সাক্ষী হিসেবে যুগ-যুগান্তর বেঁচে থাকে সুসাহিত্য। সাহিত্য দর্পণ স্বরূপ। এর মাধ্যমে সহজেই অবলোকন করা যায় একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের, নিপীড়িত নারী-পুরুষদের, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়ার ভয়াবহ চিত্র। বরেণ্য সাহিত্যিকগণ মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে সাহিত্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের সাঠিক ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। তোফায়েল হোসেন বিরচিত সূর্য রাঙা ভোর তেমনই একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। সাধারণত সমসাময়িক দুটি ঘটনা সমান্তরালভাবে বর্ণিত হলেও লেখক তোফায়েল হোসেন এখানে দুটি ভিন্ন সময়ের কাহিনীচিত্র সমান্তরালে এগিয়ে নিয়েছেন পরিণতির দিকে। প্রথমার্ধে বর্ণিত হয়েছে একাত্তরের বিশ বছরের যুবক আকবরের জীবনালেখ্য। পরের গল্পটা বিশ শতকের শেষের দিকে, আকবরের পুত্র পিন্টুর। যা শুরু হয়েছে একটি শিশুর বৈচিত্র্যময় ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার গল্প দিয়ে। আকবরের বাবা আবদুল হক নৌকার মাঝি। খেয়া ঘাটের লোক পারাপার, কখনও পদ্মায় ইলিশ ধরে কিংবা দিনমজুরি করে সংসার চলত তার। এমতাবস্থায় বালক আকবর স্কুলে যেতে চাইলে যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে হক মাঝি। মাঝির ছেলে মাঝিই হবে, এই ছিল তার মনোবাসনা। গরিব মানুষের আবার পড়াশোনা কিসের। অবশেষে মায়ের কাছে বায়না ধরে স্কুলে ভর্তি হয় আকবর। দস্যিপনায় দুরন্ত হলেও আকবর ছিল ভাবুক প্রকৃতির। পূর্ব বাংলার মানুষ এত খাটাখাঁটুনি করেও আর্থিকভাবে কেন অসচ্ছল, কেন শিক্ষিত হয়েও তারা প্রশাসনিক চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়- এসব খুব ভাবাত আকবরকে। আবার প্রকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রদেয় রিলিফের মালামাল খুব কম লোকই পায়। গ্রামের বিচার-সালিশগুলোতে গরিবরা ন্যায্য বিচার পায় না বললেই চলে। এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করে আকবর এক প্রতিবাদী চরিত্রে আবির্ভূত হয়। আকবরের বেড়ে ওঠা পদ্মা নদীর গহ্বরের ওপর জেগে ওঠা বিশাল এক চরগ্রাম জোতাশাহি গ্রামে। এক সময় আকবরের প্রতিবাদী মনোভাব দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাশের গ্রামের রাজনীতিবিদ কফিলউদ্দিন দেওয়ানের। জেলা সদরে আসা-যাওয়া আছে দেওয়ান সাহেবের। শেখ মুজিবের সভায় দেওয়ান সাহেব আকবরকে সঙ্গে নিয়ে যায়। শেখ সাহেবের বজ্রকণ্ঠের ভাষণ আকবরকে মোহাচ্ছন্ন করে তোলে। শেখ মুজিব যখন বলেন, ‘বায়ান্নর ভাষা শহীদদের চেয়েও বেশি রক্ত দিয়ে আমাদের অধিকার অর্জন করতে হবে। তোমরা কি সেই সংগ্রামে আমাদের সঙ্গে শরিক হবে?’ তখন স্থান-কাল ভুলে আকবর চিৎকার করে বলে ওঠে, আই এ্যাম রেডি। মার্চ মাসে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অত্যধিক নাজুক হয়ে পড়ে। মূলত ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুনে সবার মধ্যেই এক ধরনের চাপা প্রতিবাদী স্বভাব তৈরি হয়। মার্চের শেষ সপ্তাহে দেখা দেয় রাজনৈতিক অচলাবস্থা। ২৫ মার্চ রাতে শুরু হওয়া গণহত্যা বাকরুদ্ধ করে দেয় বাঙালী মুক্তিপাগল জনতাকে। মে মাসের কাঠফাটা গরমের এক সকাল বেলা দেওয়ান সাহেবের সহযোগিতায় আকবর তার চার বন্ধুসহ ভারতে পাড়ি জমায়। উদ্দেশ্য যুদ্ধের ট্রেনিং সম্পন্ন করে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করা। জুলাই মাসে আকবররা স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ শেষ করে দেশে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। শুরু হয় প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ। বাঙালীদের স্বাধীনতা যুদ্ধ অন্য যে কোন যুদ্ধের চেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল কারণ মুক্তিবাহিনীর একদিকে যেমন অপরিচিত পাকিস্তানী মিলিটারিদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে অপরদিকে পূর্ব পরিচিত দেশীয় মানুষ নামের পশুদের বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছে। যারা রাজাকার আর পিস কমিটি গঠন করে যুবতী মেয়েদের তুলে দিত হানাদারদের হাতে, খুঁজে খুঁজে ধরিয়ে দিত মুক্তি সেনাদের। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা হওয়াতে লেখক তোফায়েল হোসেনের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি ছিল অগাধ শ্রদ্ধা এবং সীমাহীন ভালবাসা। হৃদয় নিংড়ানো সেই ভালবাসা ঢেলে সাজিয়েছেন তার সূর্য রাঙা ভোর গ্রন্থটিতে। যুদ্ধের কৌশল বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক তার গল্পের নায়ক আকবরসহ মুক্তিযুদ্ধের কয়েক কমান্ডারের যুদ্ধের ছক তুলে ধরেছেন। এক পর্যায়ে লেখক এক কঠিন বাস্তবতার অবতারণা করেছেন। পাক আর্মিদের খায়েশ মেটাতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় রাজাকার তালুকদারদের । এলাকা যখন প্রায় নারী শূন্য তখন পাক আর্মিদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তালুকদারের পুত্রবধূর ওপর। পাকভৃত্য তালুকদারের আকুতি মিনতিও তাদের কুৎসিত কমনাবৃত্তি দমন করতে পারে না। পাকিস্তানী সেপাই তালুকদারের পুত্রবধূকে ধরে নিয়ে গেলে কান্নার রোল পড়ে তালুকদার বাড়িতে। এমতাবস্থায় নিরুপায় হয়ে তালুকদারের স্ত্রী লোক পাঠিয়ে মুক্তি সেনাদের বিস্তারিত ঘটনা অবহিত করে সাহায্যের অনুরোধ জানায়। আকবররা জোতাশাহি গ্রাম আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। তালুকদার বাড়ির রাখালের সহায়তায় তাদের অপারেশন সফল হয়। বেশিরভাগ পাক আর্মি নিহত ও বাকিরা আত্মসমর্পণ করে। ক্যাম্প থেকে তালুকদারের পুত্রবধূসহ ছয়জন বীরাঙ্গনাকে উদ্ধার করা হয়। তালুকদারের সহযোগী ভাতিজা আব্বাস এবং আর্মি অফিসার শাহনেওয়াজের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। জোতাশাহি অপারেশনের পরে আকবর তারাগুনিয়া এবং ভেড়ামারার যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করে। সামান্য ক্ষয়ক্ষতি হলেও তারাই জয়লাভ করতে সমর্থ হয়। পাক আর্মি তল্পিতল্পা গুছিয়ে জেলা সদরে আশ্রয় নেয়। আকবরদের এলাকা মূলত অক্টোবর মাসেই শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস একজন মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর মাঝে ছিল হাসি-ঠাট্টা, সুখ-দুঃখ সবই। একদিন হঠাৎ রাহেলা নামের এক কিশোরীর সঙ্গে দেখা হয় আকবরের। রাহেলা এক চঞ্চল কিশোরী, আকবর ইতোপূর্বে যুদ্ধরত অবস্থায় যাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে ঘটে যাওয়া হাসি-ঠাট্টার ঘটনাপ্রবাহ ভেসে ওঠে আকবরের মানসপটে। পরবর্তী ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। সারাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাকিস্তানী আর্মি পেছাতে জেলা সদরগুলোতে অবস্থান করে। ডিসেম্বর মাসে ভারত সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানী বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। যুদ্ধে যখন বিজয় আসন্ন তখন চারদিকে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বলে আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করেছে, কেউ বলে চীন থেকে সাহায্যকারী সৈন্য আসছে, কেউ বলে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের কারাগারে হত্যা করা হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে। তবে জোতাশাহি গ্রামে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার কারণে সে খবর পৌঁছায় একদিন পরে। দেশ স্বাধীন হওয়ার খবরে সকলের খুশির বাঁধ যেন ভেঙ্গে যায়। মুক্তি সেনারা ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনন্দ প্রকাশ করে। শেষার্ধে লেখক এক নির্মম বাস্তবতার সম্মুখীন করেছেন। দেশ স্বাধীন হলেও জীবন যোদ্ধা আকবরের যুদ্ধ কখনও শেষ হয় না। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হলে দেশ অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। দেশে তখন চরম অরাজকতা বিরাজ করছিল। সত্তর দশকের শেষে এবং আশির দশকের অস্থির সেই সময়ে আকবরকে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বীর যোদ্ধা আকবরকে বরাবরই প্রতিবাদী চরিত্রে উপস্থাপন করেছেন লেখক। দুষ্কৃতকারীদের সহায়তা না করায় আকবরকে কর্মস্থলে হেনস্তা হতে হয়। আকবর ভেঙে পড়ে না। অল্পতেই তুষ্ট থেকে দেশকে সর্বাত্মক সেবা দিতে চেষ্টা করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঋদ্ধ লেখক তোফায়েল হোসেন তার সূর্য রাঙা ভোর উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছেন। এর মাধ্যমে জানা যায় সেই সিংহ পুরুষদের সম্পর্কে, যারা দেশের প্রয়োজনে ব্যক্তি স্বার্থকে সব সময় তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। লেখক তার লেখনি সত্তা দিয়ে বাঙালীর মন-মননে স্থান করে নেবেন এই আমার প্রত্যাশা।
×