ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প

রোদ বৃষ্টির দিন

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

 রোদ বৃষ্টির দিন

আবু নোমান ॥ বাড়ি থেকে তিন মাইল সাইকেলে, এরপর শ্যামপুরের পাগলা নদী নৌকায় পার হয়ে, আর একটি বাঁক পেরিয়ে, মোড়ের ওপর আহসানের স্কুল। নদী পার হয়ে বাকি পথ আরও মাইল দেড়েক হবে। নদীর এপারে সাইকেল রেখে এটুকু পথ হেঁটেই যেতে হয় তাকে। প্রতিদিন নয়টায় না পৌঁছলে হেড মাস্টার সাহেব উপস্থিতি রেজিস্টারে স্বাক্ষর করতে দেন না। লালকালি দিয়ে অনুপস্থিত লিখে রেখে দেন। তাই সময়মতো বাড়ি থেকে বের হতে হয়, কোনদিন নাস্তা হয়, কোনদিন না খেয়েই যেতে হয়। ঘুমটা তার একটু বেশি বলে মাঝে সাঝে সময়ের একটু হেরফের হয়ে যায়, তখনই বাধে সমস্যা। এমনিতে লাবনি সময়মতোই নাস্তা রেডি করে দেয়। ইদানীং বয়স হচ্ছে, শরীরে অসুখ-বিসুখ বাসা বাঁধছে। সবকিছু কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হয়ে ওঠে না। ভাদ্র মাসের কানসাটের মেলায় আহসান ছেলেকে বন্দুক কিনে দেবে বলেছিল, সে কথা জহির ভুলেনি। মাঝে মাঝেই এ কথা সে কথার মাঝে জিজ্ঞেস করে, বাবা মেলা আর কতদিন পরে? গতবারের বায়না এখনও পূরণ হয়নি জহিরের। আহসান বলেছিল, এবার হাতে খরচ খরচান্তর বেশি, সামনেবার ঠিক কিনে দেব। জহির ধৈর্য ধরে আছে, তবে মাঝে মাঝেই মনে করিয়ে দেয়। এবার কিন্তু দিবা, তাই না বাবা? ‘হ্যাঁ’, বলে আহসান আনমনা হয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। স্কুল থেকে ফেরার পথে একদিন মেলা থেকে আহসান একটি ভুটভুটি কিনে নিয়ে এসে দেয়। পেয়ে খুব খুশি হয় জহির, কিন্তু বন্দুক পেল না বলে ঝিম মেরে থাকে। আহসান হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসে। জহির এসে জিজ্ঞেস করে, বাবা আপুমনিকে মেলায় একটা লিপিস্টিক কিনে দিবা। হ্যাঁ দিব। আর একটা বনশি আর বাঁশের কঞ্চি কিনে দিবা। আহসান বুঝতে না পেরে জহিরের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। জহির বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে হাসে। ও হাসলে গালে টোল পড়ে। চোখ দুটো শান্ত, গভীর, মায়াবি। কেমন মায়া লাগে আহসানের। ছোঁয়াচে, বড্ড ছোঁয়াচে ভালবাসা জেগে ওঠে কলিজায়। ওগুলো দিয়ে কী হবে? আমি আর আপুমনি পুকুরে মাছ ধরব, বলল জহির। আপুমনি কিন্তু আজ আমাকে গল্প শুনিয়েছে। একটা ইয়া বড় রাক্ষসের গল্প। তবে রাক্ষসটা না মানুষ খায় না! খুব ভাল রাক্ষস। সাদিয়াকে আপুমনি ডাকতে ডাকতে ভুটভুটি নিয়ে দৌড়াতে থাকে জহির। ভীষণ ব্যস্ত আজ সে। আহসানদের বাড়ির পেছনে পুকুরটায় মাছ চাষ করে সোলেমান মাতব্বর। পুকুরটার পানি কী কালো আর স্বচ্ছ। আট-দশটি হাঁস সারি বেঁধে সাঁতার কাটে এখানে। পাক পাক শব্দে মাতিয়ে রাখে। চারপাশে নারিকেল গাছ লাগানো। কোন কোনটিতে নারিকেল ধরেছে। নারিকেল গাছের পাতাগুলো কি মিশমিশে সবুজ। বৃষ্টির সময়ে পাতাগুলো যেন সজীব হয়ে ওঠে। চারপাশকে ঘন গাছগুলো কেমন অন্ধকার করে রেখেছে। বৃষ্টির সময় পুকুরের পানি বেড়ে রাস্তায় উঠে আসে। তখন আর পথঘাট চেনা যায় না। দূর দিয়ে সাবধানে হেঁটে হেঁটে পার হতে হয়। একটু এদিক-ওদিক হলে আর রক্ষে নেই। পিছলা পথ দিয়ে সাদিয়া আর জহির পুকুরের ধারে খেলতে আসে। আহসান চিন্তিত হয়। আকাশটা মেঘলা সেদিন। কালো কালো মেঘে ঢেকে ছিল অর্ধেক আকাশ। বৃষ্টি নামলো ঝম ঝম করে। ভেসে গেল পুকুর, ডোবা, নদীনালা আখ আর আউশ-আমনের ক্ষেত। আহসান সাইকেল ঠিকঠাক করে নিচ্ছে। নাস্তা করে বেরুতে হবে। জহির ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা, ও বাবা, আমার ভুটভুটিটা কেমন হয়ে গেছে, আর শব্দ করে না। বেধে বেধে যাচ্ছে। একটু ঠিক করে দাও না বাবা। পেছনে সাদিয়া অপরাধী মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সাদিয়ার দিকে তাকিয়ে জহির বলল, আপুমনিটা খুব বেয়াদব হয়েছে, ওই আমার ভুটভুটিটা নষ্ট করে দিয়েছে। বাবা, তুমি ঠিক করতে না পারলে আরেকটা কিনে দিবা কিন্তু। আহসান সাদিয়ার দিকে তাকাতেই সাদিয়া বলে উঠল, আমার কোন দোষ নেই বাবা। আমি একটু দেখছিলাম, জহিরই আমার কাছ থেকে হ্যাচকা টান দিয়ে নিচ্ছিল। আর তখনই... জহির আরও চিৎকার করে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলল, আমার জিনিস কেন তুই নিবি, শয়তান! সাদিয়া মুখ গম্ভির করে দাঁড়িয়ে রইল। আহসান বললো, তুমি ঠিক করলে না, জহির। বড়বোনকে কেউ শয়তান আর বেয়াদব বলে না। তুমি ভুটভুটিটা শুধু আমার আমার করছ কেন? ওটা তো দুজনেরই। দুজন মিলেমিশে খেলতে পার না? জহির কান্না থামিয়ে আরও চিৎকার করে ভুটভুটিটা বাবার কাছে এনে শব্দ করে রেখে বললো, নাও তোমার ভুটভুটি। তোমার মেয়েকে দাও। আমি তোমার ভুটভুটি নেব না। জহির ফিস ফিস করে কাঁদতে থাকে। আহসান কী করবে ঠিক করতে পারে না। লাবনিকে ডাকে। বলে, আমাকে কাঠের স্কেলটা দাও তো, দুজনকেই সাইজ করা দরকার। লাবনি ঘর থেকে স্কেল এনে দিলে সাদিয়া আর জহির দু’জনেই ঘরে ঢুকে পড়ে। আহসান লাবনিকে বলে, এদেরকে মাঝে মাঝে শাসনের দরকার আছে। লাবনি বললো, তুমি তো আদর করে করে লাই দিয়ে মাথায় তুলেছো ওদের। পড়াশোনা একটুও করে না। শুধু শুধু রোদ বৃষ্টির মধ্যে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। ওদেরকে পড়াশোনা করতে বলো, পড়াশোনা না করলে কিভাবে কী করবে! তুমি যাওয়ার সময় একটু বলে যাও, যেন স্কুল থেকে ফিরে বাড়িতে পড়াশোনা করে। আমার কথা একদম শোনে না। হুঁ! ঠিকই বলেছো। আহসান সাই দেয়। জহির সাদিয়াকে বলে, আপুমনি তুমি কি রাগ করেছো? সাদিয়া কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। আচ্ছা আপুমনি, গুহাতে পড়া বাচ্চাগুলো কি বাঁচতে পেরেছে? কোন গুহা? সাদিয়ার মান সহজেই ভেঙে যায়। ঐ যে থাইল্যান্ডের গুহায় যে শিশু ফুটবল খেলোয়াড়রা তেরোজন পড়ে গেল না? ওরা কি বেঁচেছে আপু? আমি কী জানি? তুই পেপার পড়ে নে। আমি আর ওগুলো তোকে বলবো না। তুই আমাকে বেয়াদব বলিস, শয়তান বলিস। তুই যা আমার সামনে থেকে। আচ্ছা-আচ্ছা আপু আমি আর কখনো ওগুলো বলবো না। আমাকে মাফ করে দাও আপু! জহির সাদিয়ার দুহাত ধরে হাসানোর চেষ্টা করে। সাদিয়া বললো, তবে শোন, ঠিক আছে, ঠিক আছে আর বেশি অনুরোধ করা লাগবে না। শোন, ওরা কিভাবে বের হলো শুনবি? ওরা না সতের দিন পাহাড়ের চুঁইয়ে পড়া পানি খেয়ে বেঁচে ছিল। আর ভেতরে তারা কিং অব দি কেভ খেলছিল। অনেক কষ্টে শেষপর্যন্ত তারা বেঁচেছে। সতের দিন? গুহাতে কোনো বাঘ ভল্লুক ছিল না? আমরা যখন যাব তখন আমি আমার বন্দুকটা নিয়ে যাব। তোর বন্দুকতো কেনাই হয়নি। সাদিয়া হাসতে হাসতে বলে। কেনা হবেই তো। বাবা বলেছেন সামনেবার নিশ্চয় কিনে দেবেন। জহির নিশ্চুপ হয়ে গুহার কথা ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা আপু, ঐ খেলাটা কী রকম? সাদিয়া তার কোলের ওপর রাখা বইটি টেবিলে উল্টো করে রেখে বললো, আরে শোন, ঐ খেলাটা হলো, গুহার ভেতর থেকে যখন ওরা বের হতে পারছিল না, তখন গুহার মধ্যে তারা রাজা রাজা খেলছিল। ওইটার নামই হলো কেভ অব দি কিং। কী মজা তাই না আপু? আমরাও একদিন যাবো। আর ঐ যে কিং কিং খেলবো। আমার সঙ্গে থাকবে বন্ধুক। কোনো বাঘ ভল্লুক, সাপ, চোর ডাকাত, শত্রু সব খতম করে দেবো। বলবো রুখ যা রুখ যা, সিম সিম, জহির অভিনয় করে দেখায়। সাদিয়া জোরে জোরে হাসতে থাকে। জহিরও হাসে। সাদিয়া হাসতে হাসতে বলে, তোর মতো ভীতু যাবে ঐ গুহাতে? তাহলে বাঘ ঢুকতে লজ্জা করবে। খুবজোর ইঁদুর-ছুঁচা-বিড়াল ঢুকতে চাইবে। জহির চেঁচাতে চেঁচাতে বললো, আর ইউ ইনসাল্টিং মি? তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছো আপু! আমি কিন্তু এতটাও ভীতু না বলে দিলাম। সাদিয়া আবারো হাসতে থাকলো। জহিরও হাসিতে যোগ দিল। লাবনি প্লেটে নাস্তা এনে বারান্দায় ডায়নিং টেবিলে রেখে আহসানকে বললো, দেখছো ওরা শুধু হাসাহাসি করে। পড়াশোনায় কোনো মন নেই। রেজাল্টও ভাল হচ্ছে না। একটা টিউশনি দিতে পারলে ভাল হতো। টিউশনির চিন্তা বাদ দাও লাবনি। আমরা কি পড়াশোনা করিনি? আমাদের তো টিউশনির প্রয়োজন হয়নি। এখন যুগ পাল্টেছে বুঝলে! তোমার আগের নিয়ম এখন আর খাটবে না। না হয় তুমি একটা সময় করে ওদের নিয়ে বস। প্লেটে খিচুরি তুলে দিতে দিতে লাবনি বললো। সেটাই ভাল। বসতেই হবে দেখছি। আহসান ঘড়িটা দেখলো। আর লাগবে না। তোমরা খেও। সব তো আমাকেই উঠিয়ে দিচ্ছো। ডিম ভাজিটা ওদেরকে দিও। রেখে দাও রেখে দাও। আহসান দ্রুত উঠে পড়লো। আহসান স্কুলে যখন পৌঁছলো তখন কাঁটায় কাঁটায় নয়টা বাজে। হেড মাস্টার সাহেব স্বাক্ষরের খাতাটা এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, আহসান সাহেব, আপনি খুব পাংচুয়াল মানুষ। এই দেখেন না, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে এই ফরমগুলো দিয়ে গেছে। এগুলো নিয়ে পাড়া থেকে তথ্য কালেকশন করে কালকের মধ্যে পাঠাতে হবে। আপনাকেই যেতে হবে। আর কেউ তো যেতে চাচ্ছে না। কী করা যায় বলুন? এতগুলো ফরম কালকের মধ্যে কিভাবে সম্ভব? আর কেউ না গেলে আমি একা কী করে করবো? তাতো জানি না। এ কাজে কোনো টাকা পয়সাও নেই, তাই কেউ করতে চাচ্ছে না। হেড মাস্টার সাহেব অনুনয় করে বললেন, ভাই আমার, আপনি ছাড়া এ কাজ আর হবে না। ওরা শুধু বকাবকি করবে, কাজ ধরিয়ে দেবে, কিন্তু এ কাজের সব টাকা তারাই খাবে, কিন্তু আমাদের জন্য কিছুই থাকবে না। কী তামাশা বলুন? আমি এতসব পারবো না। আমার ভাগে যে কয়টা হবে সে কয়টা দিন। বাকিগুলো আমি পারবো না। বলে দিলাম। আর অনুরোধ করবেন না দয়া করে। আপনি তো এমনভাবে কথা বলেন না। আজ হঠাৎ? আহসান চুপ করে থাকে। হেড মাস্টার সাহেব সব কাগজগুলোই তাকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, যে কয়টা আপনি পারবেন করেন, বাকিগুলো ওদেরকে দিয়ে দেব। আহসান সব কাগজগুলো গুণে গুণে চারভাগ করে এক ভাগ নিয়ে বাকিগুলো হেড মাস্টার সাহেবকে ফেরত দিল। তার মানে আপনি অনুরোধ শুনলেন না? আপনি কি শুধু আমাকেই অনুরোধ করবেন? ওদেরকে অনুরোধ করতে পারেন না? আমি ওদের চেয়ে কত সিনিয়র অথচ আমাকেই সব করতে হবে, আর ওরা কিছুই করবে না, এ কেমন কথা? আবার এ কাজে টাকা পয়সা থাকলে তখন তো আর আমাকে এ কাজ দিতেন না। তখন ওদেরকেই খুঁজতেন। হেড মাস্টার সাহেব হন হন করে অফিসের বাইরে গিয়ে ছাত্রদের নোংরা ভাষায় গালাগালি করতে লাগলেন। একজনকে লাঠি দিয়ে অহেতুক পিটালেন। আহসান চক ডাস্টার নিয়ে নিজ ক্লাসে গেল। কয়েকজনকে পড়া ধরলো। পড়াতে ভাল লাগছে না। এতগুলো ফরম তাকে পূরণ করতে হবে। একা একা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে হবে এ মারাত্মক কষ্টের কাজ। কখন রোদ আবার কখন বৃষ্টি আসে ঠিক ঠিকানা নেই। কাদা-পানির রাস্তার মধ্যে একা একা। মাঝে মাঝে প্রচ- বিরক্ত লাগে তার। সে তো মাস্টার মশাই। তার কাজ হবে শিক্ষার্থীদের পড়ানো। তা বাদ দিয়ে অহেতুক সব জঞ্জালের মধ্যে আটকে রেখে কী ধরনের শিক্ষার উপকার হচ্ছে আল্লাহ মালুম। বাড়ির পেছনে পুকুর পেরিয়ে আমবাগান। ফজলি আমের বিশাল বিশাল অন্ধকার গাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে কয়েকটি লিচুগাছও রয়েছে। লিচুর সময় শেষ হয়ে গেছে। ফজলির সময়ও প্রায় শেষ। কয়েকটি গাছে এখনো কিছু কিছু আম রয়ে গেছে। সেগুলোও মনু মিঞার বাগান। মনু মিঞার ছেলে টুনটুন প্রায় বাগানে এসে চিল্লাবাল্লা করে যায়। একে ওকে ধমক দিয়ে যায়। ধমকের কোনো কারণ থাকে না। পরবর্তীতে যেন সকলে বাগানে আসতে ভয় পায়, এ কারণেই এই চিল্লানো। মনু মিঞাদের এক শ’ দেড় শ’ বিঘার মতো জায়গার সবগুলোতেই আমবাগান। কোনোগুলোতে ফজলি, কোনোগুলোতে আশ্বিনা, আবার কোনোগুলোতে খিরসাপাত, গোপালভোগ, ল্যাঙড়া বা অন্যান্য মজাদার স্বাদের আম গাছ। প্রতিবছর বিক্রি করে অনেক লাভ নিশ্চয় হয়। টুনটুন ডেকে মাঝে মাঝে একে ওকে দেয়। কাউকে দিয়ে আম পাড়িয়ে নেয়। তাকেও দু-একটা আম দিয়ে দেয়। গাঁয়ের অনেকেই তাই টুনটুনকে ভয় যেমন করে ভালও বাসে। আম বিক্রির সময় হলে অনেক বিদেশী মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ে। বাগানে বাগানে ঘুরে আম দেখে দেখে তারা কিনে। কেউ কেউ আবার গাছে থাকতে থাকতেই আম কিনে নেয়। পরে পাকার সময় হলে ট্রাকে ট্রাকে আম পাঠায় ঢাকায়, চট্টগ্রামে বা অন্যান্য জায়গায়। তাদেরও লাভ ভালই হয় মনে হয়। তা না হলে গাছের উঁচু উঁচু ডালের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে কেউ হাঁটে? জহির আর সাদিয়া মাঝে মাঝে চলে যায় সেদিকে। একদিন জহির একটি গাছের উপর উঠে টুনটুনকে কয়েকটি আম পেড়ে দিয়েছিল। টুনটুন বলেছিল পরের দিন আসলে তাকে পাঁচটি আম দেবে। জহির খুব খুশি হয়। টুনটুন বলেছে, ভাতিজা ভুলিস না। কালই চলে আসবি। তার পর আর যাওয়া হয়নি জহিরের। আহসান বাড়ি ফিরে এসে সন্ধের পর সামান্য একটু শরীরটা এলিয়ে দেয়। খাটাখাটনি তো কম হয়নি। পঞ্চাশ-ষাটজনের বাড়িতে গিয়েছে। কার বাড়িতে কী ধরনের টয়লেট, কয়টি ঘর, কয়জন সদস্য, সবাই স্কুলে যায় কিনা, সবাই ভিটামিন এ খায় কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ ভালমত বলতেই চায় না। কেউ কেউ আবার বলে, বাড়ির মালিক নেই, পরে আসবেন। আহসান তাদের কারো কারো অর্ধেক কথা শুনে বাকিটা নিজের মতো করে লিখে নিয়েছে। চোখে ঘুম চলে আসে। কতজনের বাড়ির খবর নিয়েছে সে, অথচ নিজের ছেলেমেয়েদের খবরই সে ঠিকমত রাখতে পারে না। তারা কোথায় কোথায় যায়, কোথায় ঘুরে বেড়ায়, পড়াশোনার অবস্থা কী, কোনো খবরই সে বলতে পারবে না। লাবনি এ কথাগুলোই যখন বলে তখন তার খুব খারাপ লাগে। কিন্তু কী করবে সে? রাতের খাবার পর আহসান পাঠ পরিকল্পনা লিখতে বসে। কালকের ক্লাসে পাঠপরিকল্পনা লিখিত ছিল না বলে এ.টি.ও. সাহেব ছাত্রছাত্রীদের সামনেই যাচ্ছেতাই অপমান করেছে। বলেছে, এরপর এ রকম দেখলে ক্লাস থেকে বের করে দেবে। অপমানবোধগুলো ধরে রাখলে বেঁচে থাকা যায় না। কেন যে জীবনে শিক্ষক হতে হলো তাকে। বাপদাদাদের আমলে শিক্ষকদের কি এমনই মর্যাদা ছিল? নিশ্চয় নয়। নইলে কাজী কাদের নওয়াজ সাহেব শিক্ষকের মর্যাদার অমন সুন্দর কবিতা কখনই লিখতে যেতেন না। বাইরে বৃষ্টির শব্দ। লাবনি গান ধরেছে... আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে...। আহসান বসে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনছে সে গান। তোমার ভাতিজির বিয়ের জন্য কী দেবার কথা চিন্তা করেছো? লাবনির কথায় মোহভঙ্গ হয় আহসানের। তাই তো কী দেয়া যায়? এখনো ভাবিনি তো! ঈদের বোনাস পেলে না হয় কিছু একটা দিয়ে দেবো। ভাইয়া একটি ফ্রিজের কথা বলেছে। ভাল কোম্পানির একটি বড় ফ্রিজ দিতে হবে তোমাকে। যত খরচ-খরচাই হোক। লাবনি মুচকি মুচকি হাসে। এ কথা কি তুমিই বলছো? না ভাবি এসেছিল। বলেছে, তুমি সরকারি চাকরি-বাকরি করছো। মেলা বেতন সেতন। ভাতিজির বিয়েতে এটা কিনে দেয়া তোমার কোনো ব্যাপারই নয়। আর বিয়ের খরচ বাবদ আরো হাজার দশেক টাকা তোমার কাছ থেকে নিতে চায়। কী বলছো এ সব? আমি এত টাকা কোথায় পাবো? চুরি ডাকাতি করতে যাবো নাকি? তুমি তো ওদের জন্য জানও দিতে পারো, সে আমি জানি। কত কী করে দাও। তবে আমি বলি কী, ওদের চাওয়ারও একটা সীমা থাকা উচিত। ভাবি বললো, বাবা মারা যাবার আগে নাকি বলেছিলেন, আহসানটা গা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলে, তোমার মেয়ের বিয়েতে ওকেই ধরবা। ইস্! তুমি গা বাঁচিয়ে চলো, এটা কী ধরনের কথা? বাবাতো বড় ফজলি আমবাগানটা থেকে তোমাকে বঞ্চিত করলেন। কেন শুধু ওদেরকেই দিতে হবে? তোমার কোনো অধিকার নেই? তোমার বাবা তোমাকে কী দিল সেটি তো কোনোদিনই দেখলাম না। আবার চাওয়ার ব্যালায় ভাল কোম্পানির বড় ফ্রিজ! তখনতো ভাইয়া বলতে পারতো, বাগান শুধু আমাদের নামে কেন? সকল ভাইবোনদের সমান সমান দিন। তখন তো সে কথা বললো না। বোনদেরও বঞ্চিত করলো তোমার ভাইয়েরা। আবার নেয়ার বেলায় ষোলোআনা। আর তোমার মেজ ভাবি তো নিজের প্রশংসা করে বেড়ায় শুধু। মেজ ভাইয়াটা যে কী! ভাবি যা বলে তাই শুনে, ঠিক হোক বেঠিক হোক। তোমরা ছোট থাকা অবস্থায় তোমার বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তোমাদের সব সম্পদ, বাস করার ডিহিটা পর্যন্ত..., থাক আর বললাম না। সবাই যখন ঈদে বাড়ি যায়, তুমি যেতে পারো না, তখন তোমার কেমন লাগে বল? তুমি যদি মেজ ভাবির মতো আমার কথা শুনতে, তবে তোমার অনেক উন্নতি হতো। বুঝলে! কে শুনে কার কথা! লাবনি একদমে কথাগুলো বলে হাঁপাতে লাগলো। দেখ লাবনি, এত কথা বলো না। কে কী বললো আমি জানি না। তবে আমার মনে হয় ওটা বাবার কথা না, ওটা ভাবিরই কথা। ভাবির কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ নেই, বুঝলে। তবে কিছু তো একটা দিতেই হবে। তাই বলে এত টাকা আমি পাবো কোথায়? আমার সামর্থ্য অনুসারেই তো আমাকে চলতে হবে। সেটাই তো কথা! লাবনি জায়নামাজটা নিয়ে অন্য ঘরে গিয়ে নামাজ পড়ে। আহসান টিভির একটির পর একটি চ্যানেল চেঞ্জ করতে থাকে। আহসান সাহেব যে কয়টি ফরম জমা দিয়েছে সেগুলো ছাড়া আর কোনো কাজ হয়নি। হেড মাস্টার সাহেব তবু আহসানের উপরেই বেশি ক্ষুব্ধ। কথায় কথায় বকাবকি। সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও আপনি ওদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করছেন কেন? আপনার পরিচিতি আর ওদের পরিচিতি একরকম? আপনি চাইলে সবগুলোই করতে পারতেন। আপনি খুব বেশি বাড়াবাড়ি করেছেন। আপনাকে খুব বেশি সুযোগ দেই তো, তাই আপনার সাহস বেড়ে গেছে। টি.ও.কে বলে আপনার একমাসের বেতন বন্ধ করে দেবো। তারপর দেখবো, আপনার কত ধানে কত চাল? বকাবকি শুনতে শুনতে আহসানের মাথা বেশ ধরেছে। একজন শিক্ষক এসে আহসানকে বললো, আহসান স্যার, আপনি হেড স্যারের কাছে মাফ চেয়ে নেন। নইলে সত্যি সত্যি একমাসের বেতন বন্ধ করে দেবেন। আহসানও জানে সেটা। আহসান ভেতরে কিছুটা তাগাদা অনুভব করলো। হেড মাস্টার সাহেবের কাছে গিয়ে বললো, সরি স্যার! আমার আর এ রকম ভুল হবে না। দিন আমাকে দিন আমি সবগুলো আজ শেষ করে তবে বাসায় ফিরবো। বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে রাত দশটা। লাবনি মুখ গোমড়া করে শুয়ে আছে। আহসান আসতেই লাবনি বললো, তোমাকে বলি, স্কুলে যাবার সময় তুমি ওদেরকে একটু বাইরে না যেতে বলে যাবা। আজকে আবারও ওরা বাইরে গিয়েছিল। কী কা- করেছে! আহসান সাদিয়া-জহির ডাকতে ডাকতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। একটু আগে দুজনের হাঁসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। এখন একদম শান্ত। আহসান কাঠের স্কেলটা নিয়ে জহিরকে সামনে পেয়ে প্রচ- জোরে এক ঘা বসালো। আচমকা আঘাতে জহির হতভম্ব হয়ে চিৎকার করে মেঝেই লুটিয়ে পড়লো। এরপর আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে ফেললো। জহির কিছু না বুঝেই বলতে লাগলো, বাবা আমি আর বন্দুক নেবো না। বাবা আমাকে আর বন্দুক কিনে দিতে হবে না, ভুটভুটিও কিনে দিতে হবে না। আহসান চিৎকার করে বলতে থাকে, তোদেরকে কত বলি বাইরে যাবি না। তোরা কি আমার কোনো কথাই শুনবি না। পড়াশোনা করবি না তোরা। বল? তোকে আস্ত রাখবো না আজ, মেরেই ফেলবো। সাদিয়া কোথায় গেল কোনদিকে গেল? এদিকে আয় সাদিয়া, তোকেও মারের মজা বুঝাবো আজকে। সাদিয়া খাটের নিচে লুকিয়ে পড়েছে। লাবনি এসে আহসানের কাঠের স্কেলটি ধরে নিয়ে বললো, এ কী করছো তুমি। এদের কে কি মেরেই ফেলবা? থামো এবার। আহসান শান্ত হয়। চোখদুটো থেকে অনবরত অশ্রু বের হতে থাকে। লাবনি বললো, এবার শান্ত হয়ে ফ্রেস হয়ে আসো। তোমার রাতের খাবার দেবো। আহসান দীর্ঘক্ষণ ধরে গোসল করলো। তারপর খাবার টেবিলে এসে দেখলো, খাবারের পাশাপাশি তার জন্য এক পেয়ালা আম। পাকা ফজলি আমের সুমধুর গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ। এ সময়ে আম থাকার কথা নয়। তাদের আম আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন কোথা থেকে আসলো আম? কেনারও কোনো বাড়তি খরচ থাকার কথা নয় লাবনির কাছে। আহসান জিজ্ঞাসু চোখে লাবনির দিকে তাকিয়ে থাকতেই লাবনি বললো, তোমার ছেলের প্রথম আয় এগুলো। কী রকম? আহসান কৌতূহলী হয়। টুনটুনদের বাগানে গিয়ে ও ওদেরকে কয়েকটি আম পেড়ে দিয়েছে বলে টুনটুন তাকে পাঁচটি আম দিয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও পাকা আমটা তোমার জন্য রেখেছে তোমার ছেলে। ও আমগুলো এনেই কাঁচা দুটো রেখে বাকিগুলো ভাগ করলো। সবচেয়ে বড় আর পাকাটা তোমার জন্য রাখলো। প্রথমে হাঁড়িতে রেখেছিল। তারপর তার মনে হলো, নষ্ট হয়ে যেতে পারে, এই ভেবে শিঁকেয় রাখলো। আবার বারবার সেটা নেড়ে আসে সব ঠিকঠাক আছে নাকি দেখতে। তুমি কখন আসবা সেই নিয়ে আমাকে মিনিটের পর মিনিট জালিয়ে মারছে। আজকেই আসতে তোমার দেরি হচ্ছে দেখে সোলেমান মাতবরদের গলিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। আমাকে বারবার বলেছে এখনই কাটা যেন শুরু করি। আবার বলছে এখনই কাটলে যদি স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। একটু দেরি করো। আহসানের বুকের ভেতর থেকে কোনো কথাই বের হতে পারছে না। সে আম খাবার আগেই কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিল। আমগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগলো। বড় এক পাথর এসে কঠিনভাবে বুকের উপর চেপে বসেছে যেন। আহসান চোখের জল আড়াল করতে না পেরে বাথরুমে গেল। সেখানে আর নিজেকে আটকাতে পারলো না। হাউমাউ করে শব্দ করে উঠলো। কিছুক্ষণ কাঁদলো একা একা। তারপর কয়েকটি আমের টুকরো মুখে দিল। ভাত খেতে পারলো না আহসান। আজ আর মুখে কিছু রুচছে না, তুলে নাও এগুলো, লাবনিকে বললো আহসান। তারপর জহিরের বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে জহির। পিঠে প্রচন্ড আঘাতের চিহ্নগুলো স্পষ্ট হয়ে আছে। আমি কী করেছি আমি কী করেছি বলে কয়েকবার ফিস ফিস করলো। মনে হলো স্বগোত্যোক্তি। আঘাতের স্থানে তার হাতের আঙুল ছোঁয়াতেই জহির নড়ে উঠলো। মনে হলো আহসানের এ আঘাত জহিরের শরীরের নয় এ আঘাত আহসানের কলিজাকে দীর্ণবিদীর্ণ করে দিচ্ছে। সকালে উঠে জহির আহসানকে বললো, বাবা, আমি সত্যি কিন্তু আর বন্দুক চাইবো না।
×