ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ সাইদুজ্জামান

বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনী

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

 বেগম রোকেয়ার অবরোধবাসিনী

বাঙালী নারী মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। সাহিত্যকর্ম ও সমাজসেবার মধ্য দিয়ে তিনি পশ্চাৎপদ মুসলিম নারী সমাজের জাগরণের ডাক দিয়েছেন। তিনি বেড়ে উঠেছেন অন্ধকার অবরোধের মধ্যে যেখানে মেয়েদের পড়াশোনা ছিল নিষিদ্ধ। তবে বড় ভাইয়ের কাছে গোপনে শিখেছেন বাংলা ও ইংরেজী। তার অবরোধবাসিনী (১৯৩১) সেই মুসলিম নারীদেরই এক করুণ চিত্র। এই গ্রন্থের মধ্য দিয়ে তিনি সে সময়ের ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। অবরোধবাসিনীর ভূমিকা রচনা করতে গিয়ে আবদুল করিম বিএ,এমএল.সি. উল্লেখ করেন- “পাক-ভারতের অবরোধবাসিনীদের লাঞ্ছনার ইতিহাস ইতোপূর্র্বে আর কেহ লিখেন নাই। পুস্তকখানি পাঠ করিয়া বারংবার এ কথাই মনে পড়ে- আমরা কোথা হইতে আসিয়া কোথায় গিয়া পড়িয়াছি! যে মুসলিম সমাজ এককালে সমস্ত জগতের আদর্শ ছিল, সেই সমাজের এক বিরাট অংশ এখন প্রায় সমস্ত জগতের নিকট হাস্যাস্পদ হইয়া দাঁড়াইয়াছে, এ কথা বলিলে, বোধ হয়, অত্যুক্তি হইবে না। কোথায় বীর-বালা খাওলা ও রাজিয়া অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণপূর্বক পুরুষ যোদ্ধাদের সহিত যুদ্ধ করিয়াছেন, আর কোথায় বঙ্গীয় মুসলিম নারী চোরের হস্তে সর্বস্ব সমর্পণ করিয়া নীরবে অশ্রু বিসর্জন করিতেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অবরোধবাসিনী পাঠে ঘুমন্ত জাতির চিন্তা-চক্ষু উন্মীলিত হইবে।” তিনি তার সময়ের মুসলমান ও হিন্দু সমস্ত পুরুষ, নারী ও মহাপুরুষদের থেকে চেতনায় অনেকটা এগিয়ে ছিলেন; তার ছিল সরাসরি মত প্রকাশের চমৎকার স্বভাব এবং ছিল প্রখর পরিহাসের শক্তি। তার অবরোধবাসিনীতে মোট ৪৭টি ঘটনা স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনা লেখিকার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাজাত। তৎকালীন সময় মাত্রাতিরিক্ত পর্দা প্রথার উল্লেখ করেতে গিয়ে অবরোধবাসিনীর শুরুতেই লেখিকা বলেন- “কুলবালাদের অবরোধ কেবল পুরুষদের বিরুদ্ধে নহে, মেয়ে মানুষদের বিরুদ্ধেও। অবিবাহিতা বালিকাদিগকে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া এবং বাড়ির চাকরাণী ব্যতীত অপর কোন স্ত্রীলোক দেখিতে পায় না। বিবাহিত নারীগণও বাজিকর-ভানুমতী ইত্যাদি তামাশাওয়ালী স্ত্রীলোকদের বিরুদ্ধে পর্দা করিয়া থাকেন। যিনি যত বেশি পর্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশি পেঁচকের মতো লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশি শরীফ।” নারীর কথা ও নারীর ব্যথা রোকেয়ার লেখনীতে যেমন ফুটে উঠেছে তা সব সময় দেখা যায় না। বিশ শতকের একজন মুসলিম বাঙালী লেখিকার পক্ষে এটি কম গৌরবের নয়। তিনি জানেন অবরোধ ক্ষতিকর। তিনি বলেছেন “আমাদের অবরোধ প্রথাটা বেশি কঠোর হইয়া পড়িয়াছে। ওই সকল কৃত্রিম পর্দা কম করিতে হইবে। আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব।” তিনি এমন এক পিতৃতন্ত্রের সদস্য ছিলেন, যেখানে পুত্র মাকে শেখায় পর্দা। তার ভাগনে আব্দুল করিম গজনভি স্যার উপাধি পেয়েছেন; মন্ত্রী হয়েছেন কিন্তু মধ্যযুগ থেকে বেরোতে পারেননি। তাই খালা রোকেয়াকে তিনি পর্দা শেখাতে দ্বিধা করেননি। খালাকে তিনি শর্ত দিয়েছিলেন যদি খালা পর্দা মানেন, (কারণ তার মতে খালা পর্দানশিন ছিলেন না) তবে তিনি রোকেয়ার স্কুলটি সরকারী করে দেবেন। রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামের জমিদার বাড়ির কন্যাগণ ওযু করার শেষ পর্যায়ে এক কাবুলি স্ত্রীলোক আঙিনায় উপস্থিত হলে এক কন্যা (‘আ’ নামের সাহেবজাদি) প্রাণপণে হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে চাচিকে বলে, ‘চাচি আম্মা! পায়জামা পরা একটা মেয়ে মানুষ আসিয়াছে’ (ঘটনা- এক)। পরবর্তীতে ওই কাবুলি স্ত্রীলোক যাতে কুমারী কন্যাদের দেখতে না পায় সেজন্য দরজায় কপাট দিয়ে দেয়া হয়। ২০ (বিশ) নং ঘটনার জনৈক পাঞ্জাবী বেগম সাহেবা পর্দা সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন- “একজন দয়াবতী বিবি আমাদের প্রতি কৃপাপরবশ হইয়া বলিলেন, ‘তোমরা সাবধানে লুকাইয়া উপরে চলিয়া যাও’। আমি মনে করিলাম, সম্ভবত পুরুষ মানুষদের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা আছে, তাই সাবধানে লুকাইয়া যাইতে বলিলেন। কিন্তু পরে জানিলাম, এ পর্দা সাধারণ অভ্যাগতা মহিলাদের বিরুদ্ধে ছিল। উক্ত বিবি সাহেবার হুকুমে দুজন মেয়ে মানুষ মোটা চাদর ধরিয়া পর্দা করিল, আমরা সেই চাদরের অন্তরাল হইতে উপরে চলিয়া গেলাম।” বেগম রোকেয়া নিজেই বলেছেন, এসব পর্দানশিন রমণী বা শরিফ ঘরানার বিবিদের ঘটনা পড়লে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাঠকগণ হাসবেন; তবে কোন কোন ক্ষেত্রে ওই সব নারীর প্রতি সমবেদনার সৃষ্টি হবে এবং মাঝেমাঝে পাঠক দু’বিন্দু অশ্রু বিসর্জন না করেও পারবেন না। সে সময়ে সম্ভ্রান্ত মুসলমান ঘরের মেয়ের বয়স আট বছর অতিক্রম করলেই উচ্চৈঃস্বরে কথা বলা কিংবা হাসা নিষেধ করা হতো। এমনকি বেগানা পুরুষ যাতে নারীদের কণ্ঠস্বরও না শুনতে পায়; সে শিক্ষাও দেয়া হতো। পাটনায় (ঘটনা-দুই) বড়লোকের বিয়ে বাড়িতে নিমন্ত্রিত এক মহিলা পালকির বেহারার ও নিমন্ত্রণকারীর বাড়ির মামার (গৃহপরিচারিকার) পালকি থেকে মহিলা সওয়ারি নামানোর সমন্বয়ের অভাবে পৌষ মাসের শীতে ছয় মাসের ছেলেকে নিয়ে পালকিতে বসে সারারাত নিঃশব্দে বাইরে কাটিয়ে দিয়েছেন। তিনি নিজে তো শব্দ করেননি- যদি তার কণ্ঠস্বর বেহারা শুনতে পায়; এমনকি শিশুকে পর্যন্ত কাঁদতে দেননি, পাছে কান্নার শব্দ শুনে কেউ পালকির দরজা খুলে দেখে। ধন্য অবরোধবাসিনী! ৭ (সাত) নং ঘটনায় দেখা যায়, ঘরের ভেতর চোর ঢুকলে ‘বেগানা মরদটা’ (চোর) যাতে তাদের (বিবিদের) কণ্ঠস্বর শুনতে না পায় এ জন্য বিবিরা হাত, পা, নাক, কান ও গলার গয়না খুলে শিয়রে রেখে দিলেন এবং চোর সবকিছু নিয়ে নিরাপদে বের হয়ে গেলে তখন বিবিরা হাঁউমাউ আরম্ভ করলেন। বিহার অঞ্চলে শরিফ ঘরানার মেয়েরা সাধারণত রেলপথে ভ্রমণের সময় ট্রেনে ওঠেন না; তাদের বনাতের পর্দা ঢাকা পালকিতে পুরে সেই পালকি ট্রেনের মালগাড়িতে তুলে দেয়া হয়। এ জন্য তাদের (বিবিদের) পালকিতে বিছানা করে, তালপাতার হাতপাখা, এক কুজো পানি ও গ্লাসসহ বন্ধ করে সেই পালকিগুলো পিতা বা পুত্রের সামনে চাকরেরা প্রথমে বনাতের পর্দা দ্বারা প্যাক করে মোম-জমা কাপড় দ্বারা সেলাই করে, তারপর খারুয়ার কাপড়ে ঘিরে সেলাই করে এর ওপর বোম্বাই চাদর দিয়ে সেলাই করে এবং সবশেষে চট মোড়াই করে সেলাই করে ব্রেকভ্যান কিংবা মালগাড়িতে তুলে দেয়া হয়। গন্তব্যস্থলে পৌঁছার পর দেখা যায় অধিকাংশ বন্দিনী বিবিদের অবস্থায়ই থাকে মুমূর্ষু। দুই ঘণ্টা বা ততোধিক সময় ধরে শুশ্রুষার পরে বিবিরা সুস্থ হয়ে ওঠেন (ঘটনা-২৪)। হায়রে পর্দা প্রথা! শিয়ালদহ স্টেশনের প্লাটফর্মে ভরা সন্ধ্যায় ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ এক ভদ্রলোক ক্লান্ত হয়ে এক গাদা বিছানার ওপর বসতে গেলে বিছানা নড়ে ওঠে। পরে জানা গেল তিনি বিছানা নয় বরং গাদা বিছানা পরিবেষ্টিত নারীদের ওপর বসতে গিয়েছিলেন (ঘটনা-২২)। বঙ্গীয় সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারের মাতা, স্ত্রী, কন্যাগণ হজ উপলক্ষে কলকাতা স্টেশনে পৌঁছলে হাজী সাহেবের উপদেশে বিবি সাহেবেরা প্রত্যেকে মোটা মোটা কাপড়ের বোরকা পরে প্লাটফর্মে উবু (squat) হয়ে বসলে হাজি সাহেব মস্ত একটা মোটা ভারি শতরঞ্জি দিয়ে তাদের ঢেকে দিলেন। ফলে বেচারিগণকে বোচ্কা বা বস্তার মতো দেখাচ্ছিল। স্টেশনে ট্রেন আসার পূর্বে প্লাটফর্মের ইংরেজ কর্মচারী ঐসব মাল বা বস্তা সরিয়ে প্লাটফর্ম খালি করতে বললে হাজী সাহেবের উত্তর- “হুজুর, ওই সব আসবাব নাহি- আওরত হায়” (ঘটনা-৩)। ৮ (আট) নং ঘটনায় দেখা যায় বাড়িতে আগুন লাগার পর গৃহিণী বুদ্ধি করে তাড়াতাড়ি সমস্ত অলঙ্কার একটা বাক্সে ভরে নিয়ে দরজার কাছে এসে আগুন নেভাতে ব্যস্ত পুরুষদের দেখে জীবন বাঁচানোর পরিবর্তে পর্দা রক্ষা করতে অলঙ্কারের বাক্স নিয়ে আবার ঘরের ভেতরে খাটের নিচে বসে আগুনে পুড়ে মরলেন। ধন্য! কুল-কামিনীর অবরোধ। আগুনে পুড়ে মরবেন তবুও পুরুষের সামনে বের হবেন না। অবরোধবাসিনীতে ‘মাইয়া খানা’র যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, তা রীতিমতো ভয়ানক এবং আতঙ্কজনক। কলকাতা অঞ্চলে ‘মাইয়া খানা’ নামক বন্দীখানায় মেয়েকে বিবাহের পূর্বে ৫/৬ দিন অবস্থান করতে হতো। বিহার অঞ্চলে বিয়ের তিন মাস আগে ‘মাইয়া খানায়’ বন্দী করে মেয়েদের আধমরা করা হয়। কখনও কখনও এই মেয়াদ ৬/৭ মাস এমনকি এক বছরও হয়। ওই সময়ে মেয়েরা মাটিতে পা রাখে না; তাদের স্নান, আহারেও বিশেষ যত্ন নেয়া হতো না। সারাদিন মাথা গুঁজে একটি খাটের ওপর বসে থাকতে হতো এবং রাতে সেখানেই ঘুমাতে হতো। এভাবে দেখা যেত কেউ কেউ হিস্টিরিয়ার আক্রান্ত হতো, কেউ অন্ধত্বের শিকার হতো। লেখিকা বেগম রোকেয়ার নাতনি ‘সবু’ এরূপ ‘মাইয়া খানা’য় থেকে হিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত হয় (ঘটনা-২৭)। ২৬ (ছাব্বিশ) নং ঘটনায় দেখা যায় সেকালে মেয়েদের নামগুলো পর্যন্ত পর্দানশিন ছিল। আসল নাম লেখা হতো কেবল বিয়ের কাবিন লেখার সময়। এক মস্ত জমিদারের তিন মেয়ের ডাকনাম ছিল ‘বড় গেন্দলা’, ‘মেজো গেন্দলা’ ও ‘ছোট গেন্দলা’। তিন মেয়ের সঙ্গে বর তিনজনের বিয়ের সময় তাদের নামের তালিকা মৌলভীর কাছে দেয়া হলো। বর তিনজনই বিয়ের সময় অনুপস্থিত ছিলেন। যথাসময়ে বিয়ের মন্ত্র পড়তে গিয়ে মৌলভী সাহেব ভুলবশত ১নং বরের সঙ্গে ছোট গেন্দলার, ২নং বরের সঙ্গে বড় গেন্দলার এবং ৩নং বরের সঙ্গে মেজ গেন্দলার বিয়ে দিলেন। এরপরে যে ঘটনা ঘটল তা নিম্নরূপ- “এদিকে যথাসময়ে টেলিগ্রাফযোগে ৩০ বছর বয়স্ক ১নং বর যখন জানিলেন যে, তাহার বিবাহ হইয়াছে, (১৯ বছর বয়স্কা বড় গেন্দলার পরিবর্তে) সর্বকনিষ্ঠা ৭ম বর্ষীয়া ছোট গেন্দলার সহিত, তখন তিনি চটিয়া লাল হইলেন, -শাশুড়িকে লিখিলেন কন্যা বদল করিয়া দিতে; নচেৎ তিনি তাঁহার বিরুদ্ধে জুয়াচুরির মোকদ্দমা আনিবেন।” বেগম রোকেয়াকেও পাঁচ বছর বয়স হতে পাড়ার স্ত্রীলোক হতে পর্দা করতে হয়েছে। পড়ার কোন মহিলা হঠাৎ বেড়াতে এলে বাড়ির লোক চোখ ইশারা করতো আর অমনি ‘প্রাণভয়ে যত্রতত্র কখনও রান্নাঘরের ঝাঁপের অন্তরালে, কখনও কোন চাকরাণীর গোল করিয়া জড়াইয়া রাখা পাটির অভ্যন্তরে, কখনও তক্তপোষের নিচে’ তাকে লুকাতে হতো। বাড়ির লোকের চোখের ইশারা বুঝতে না পেরে তিনি যদি লুকাতে না পারতেন তাহলে মুরব্বিরা ‘বেহায়া’ ‘বেগয়রৎ’ বলে গঞ্জনা দিত। চোখের ইশারা না বোঝার ব্যাপারে শিশু রোকেয়ার যুক্তি ছিল- ‘মুরগির ছানার তো মায়ের বুক স্বরূপ একটা নির্দিষ্ট আশ্রয় থাকে, তাহারা সেইখানেই পলাইয়া থাকে; আমার জন্য সেরূপ কোন নির্দিষ্ট নিরাপদ স্থান ছিল না। আর মুরগির ছানা স্বভাবতই মায়ের ইঙ্গিত বুঝে- আমার তো সেরূপ কোন স্বাভাবিক ধর্ম (instinct) ছিল না’ (ঘটনা-২৩)। পর্দার জন্য তাঁকে লুকাতে হবে এটাই মূল কথা। তা সে ঘরের কোণায়, বাক্স পেটরার আড়ালে, খাট বা চৌকির নিচেই হোক না কেন। প্রয়োজনে দম বন্ধ করেও থাকতে হতো। নিশ্বাসের শব্দ শুনে কেউ যদি উঁকি দিয়ে দেখে সেই ভয়ও ছিল। এ রকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা তিনি কখনও ভোলেননি। ভুলতেও দিতে চাননি ভবিষ্যত প্রজন্মকে। তাই তো তিনি রচনা করেছেন অবরোধবাসিনীদের লাঞ্ছনার ইতিহাস এবং চেষ্টাও করেছেন অবরোধ ভাঙ্গার। ‘মশারির যাত্রা’(ঘটনা-৪১) নামক এক অভিনব পর্দা প্রথা সে সময়ে দেখা যেত। তবে সেটি বড় জমিদার কিংবা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের গৃহিণীর ক্ষেত্রে ঘটত। রায় শ্রীযুক্ত জলধর সেন বাহাদুর নামক এক ব্যক্তি লেখেছেন- একদিন তিনি হাবড়া স্টেশনের প্লাটফর্মে দেখেন একটি মশারি আসছে। মশারির চার কোণা চারজন সিপাহি ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছেন। পরবর্তীতে জিজ্ঞেস করে তিনি জানতে পারলেন বিহার অঞ্চলের এক রাজা কিংবা জমিদারের গৃহিণী ওই মশারির মধ্যে আব্রু রক্ষা করে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছেন। বড় মানুষের বউ-ঝিরা আর দশজনের সামনে দিয়ে বেআব্রু হয়ে যাবেন এটা তো ভাবাই যায় না; কারণ তারা যে অসূর্যস্পর্শা। অবরোধবাসিনীতে বেগম রোকেয়া অবরুদ্ধ নারীর কষ্ট, বেদনা, হতাশা এবং অমানবিক জীবনের করুণ কাহিনী তুলে ধরেছেন। এর ফলে অন্তঃপুরবাসী রমণী তিলে তিলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এ সম্পর্কে বেগম রোকেয়ার মতো হলো- “অবরোধ প্রথাকে প্রাণঘাতক কার্বনিক এ্যাসিড গ্যাসের সহিত তুলনা করা যায়। যেহেতু তাহাতে বিনা যন্ত্রণায় মৃত্যু হয় বলিয়া লোক কার্বনিক গ্যাসের বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বন করিয়া অবসর পায় না। অন্তঃপুরবাসী নারী এই অবরোধ গ্যাসে বিনা ক্লেশে তিল তিল করিয়া নীরবে মরিতেছে।” বেগম রোকেয়ার সাহিত্য ও সমাজসেবার মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজের ক্ষরণযুক্ত ক্ষতকে উন্মোচন করে প্রতিকারের পথ নির্দেশ করা; সমাজের দোষত্রুটি ধরা নয়। বরং তথাকথিত সমাজপতিরাই বেগম রোকেয়াকে বিভিন্নভাবে দোষারোপ করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন- “আমি কারসিয়ং ও মধুপুর বেড়াইতে গিয়া সুন্দর সুদর্শন পাথর কুড়াইয়াছি; উড়িষ্যা ও মাদ্রাজে সাগরতীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি। আর জীবনের ২৫ বছর ধরিয়া সমাজসেবা করিয়া কাঠমোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইতেছি।” (নিবেদন- অবরোধবাসিনী) ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ শ্রাবণের মাসিক মোহাম্মদীতে জনৈক সমালোচক তাঁর অবরোধবাসিনী সম্পর্কে বলেন ‘অবরোধ-প্রথার নিন্দা করিতে যাইয়া মাননীয় লেখিকা কতকগুলি উপকথার অবতারণা না করিলেই বোধহয় পাঠকগণ বেশি সুখী হইতেন।’ রোকেয়া ছিলেন স্বাধীন চিন্তা ও মুক্তবুদ্ধির অনুসারী এবং নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। বিংশ শতাব্দীর খ্যাতিমান বাঙালী এই সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারকের সাহিত্যকর্মে তার চরিত্রের এসব গুণাবলী প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর রচনায় দেখা যায় পর্দা প্রথার নামে নারীর প্রতি সেকালের সমাজের কঠোর রক্ষণশীল আচারণ ও অসহিঞ্চুতার হৃদয় বিদারক চিত্র। নারীর শিক্ষা, সামাজিক মর্যাদা, কর্মসংস্থান ও আইনগত অধিকারের বিষয়ে তাঁর প্রগতিশীল ও জনকল্যাণমূলক বক্তব্য একালের পাঠককেও আলোড়িত করে। তিনি অবরোধ-প্রথার উচ্ছেদ চেয়েছিলেন; কিন্তু নারীরা পর্দা অর্থাৎ সুরুচি ও শালীনতা বিসর্জন দিবে, এটা তিনি কোন দিনই কাম্য মনে করেননি। অতি আধুনিক রীতির বেলাল্লাপনা তাঁর কাছে কীরূপ শ্লেষের বিষয় ছিল তাঁর উন্নতির পথে শীর্ষক রম্যরচনাটিতেও তার অভিব্যক্তি ইঙ্গিতবহ ও তাৎপর্য। তাঁর অবরোধবাসিনী গ্রন্থে অবরোধ সম্পর্কিত যে ৪৭টি কাহিনী আছেÑ অতুলনীয় শ্লেষ ও লিপিকুশলতার সঙ্গে তিনি সেগুলো বর্ণনা করেছেন। বিশ্বসাহিত্য ইতিহাসে নারী humourist বিরল সেদিক দিয়ে অবরোধবাসিনী উল্লেখযোগ্য। তিনি পর্দা চেয়েছেন; কিন্তু তার বাড়াবাড়ি পছন্দ করেননি। বলেছেন - ‘ঐ সব কৃত্রিম পর্দা কম করিতে হইবে।’
×