ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পবিত্র বিদ্যাপীঠ যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়

প্রকাশিত: ০৭:৩১, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

 পবিত্র বিদ্যাপীঠ যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়

রাজধানী তথা সারাদেশের প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ। যেখানে ভর্তি করানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় অভিভাবকদের। এক সময় তা ছিল না এখন প্রতিনিয়ত এসব ভর্তির ব্যাপারে যা দৃশ্যমান হয়। অভিভাবকরা কচিকাঁচা কোমল শিশুদের নিয়ে নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম একটি নামী-দামী স্কুল-কলেজে ভর্তির প্রত্যাশা নিয়ে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক অনুপ্রবেশটিতেও এসেছে হরেক রকম পরিবর্তন। সেটা আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মেলানো কিনা তার সদুত্তর নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আছে। মেধা ও মনন যাঁচাইয়ের ক্ষেত্রে যেসব নিয়ম কানুন কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করেন সেটাই বা কতখানি যৌক্তিক তাও প্রশ্নবিদ্ধ। তারপরও অভিভাবক এবং ছাত্র-ছাত্রীরা কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত আদেশ কিংবা নির্দেশকে অনুসরণ করে ভর্তির বিবেচনায় যোগ্য হয়ে তবেই নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে প্রবেশের অনুমতি পায়। এটুকু পর্যন্ত পুরো পরিস্থিতি দৃশ্যমান, নজরকাড়া এবং আলোড়িত, আলোচিতও বটে। ভিতরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার পর পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ পর্দার অন্তরালেই থেকে যায়। সাধারণত সামনে আসে না। দুই একটা মারাত্মক দুর্ঘটনায় সারাদেশ যখন চমকে ওঠে তখনই সবার টনক নড়ে। আসলে এইসব নামী-দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ কর্মপ্রক্রিয়া কতখানি মানবিক, সহনশীল, শিক্ষাবান্ধব কিংবা শিক্ষক-ছাত্রের স্বাভাবিক সম্পর্কের অনুকূলে? এই স্বাভাবিক সম্পর্কটি আসলে আপেক্ষিক। কারণ সব কিছু সময়ের গতি প্রবাহে যেভাবে আধুনিকতার বলয়ে পরিবর্তনকে স্বাগত জানাচ্ছে সেটাই বা কি মাত্রায় সংশ্লিষ্টদের প্রভাবিত করছে? শ্রেণী বিভক্ত সমাজে মানুষে-মানুষে প্রভেদ যেমন দৃষ্টিকটুভাবে প্রত্যক্ষতার চেয়েও বেশি নারী-পুরুষের বৈষম্যতায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল অংশটির শোচনীয়তাও মারাত্মক। একজন কন্যা শিশু অতি বাল্যকালে তার শিক্ষা জীবনের সূচনা করে। শুধু তাই নয় মেয়ে হিসেবে তার স্কুলে যাওয়া আসাটাও সেভাবে নিরাপদ নয়। বিদ্যালয়ে ঢোকার পরও হরেক রকম নিয়মের আবর্তে তার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রতিষ্ঠিত স্কুল কলেজগুলোতে নিজস্ব বিধিনিষেধও অনেক সময় সক্রিয় থাকে। আমাদের সময় যা ছিল না তবে এখন শোনা যায় ভর্তি থেকে আরম্ভ করে স্কুলে কোচিং করা সবই কর্তৃপক্ষই নির্ধারণ করে দেয় তাদের নিজেদের মতো করে। সংশ্লিষ্ট ছাত্রীরাই এসব ব্যাপারে অনেক কিছুই জানে তবে নিজেদের ক্ষতি হয় এমন অজানা তথ্য বাইরে প্রকাশ করতে চায় না। তবে সারাদেশের নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার নবতর অভিগমনকে আমরা আসলেই বুঝতে পারি না। আগের মতো মাধ্যমিক পর্যায় উন্নীত হতে গেলে ১টা বোর্ড পরীক্ষার মুখোমুখি হওয়া যায় না। তিনটা বোর্ড পরীক্ষা অতিক্রম করা আবশ্যক যেখানে মাত্র দশ বছর বয়স থেকে একজন বালিকা একটি কঠিন আবর্তে পড়তে হয়। যা আমরা ১৬ বছর মোকাবেলা করেছি। এই যে আগের সব নিয়মের ব্যত্যয় সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কেও এসেছে নতুন মাত্রা। আমরা শিক্ষকদের শুধু ভয়ই করতাম না তার চেয়েও বেশি শ্রদ্ধায়-সম্মানে নিজেদের অর্ঘ্য সমর্পণ করে দিতে কুণ্ঠিত হতাম না কখনই। বিশেষ করে বিদ্যালয়ের শিক্ষক, যারা শিক্ষা জীবনের মূল ভিত্তি গড়ে দিতেন। হৃদয় নিঃসৃত ভালবাসায় আজও তাঁদের স্মরণ করি। এখনও সেই স্বর্ণযুগে ফিরে যেতে চাই। কড়া শাসনের মধ্যেও কি নিরন্তর স্নেহ-মমতা আমাদের প্রতি মুহূর্তে সিক্ত করত তা আজও অবাক বিস্ময়ের ব্যাপার। তখনকার দিনের অভিভাবকরা শুদ্ধ ও সুস্থ পারিবারিক আবহে তাদের সন্তানদের গড়ে তুলতেন যেখানে ন্যায়-অন্যায় বোধ থেকে জ্ঞানের দিগন্তও উন্মোচিত হতো। নির্ধারিত পাঠ্যক্রমে নিজেদের পারদর্শী করে তোলা সে ভারটা তোলা থাকল শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের জন্য। তারা ভুলক্রুটি শুধরে দিতেন, শিক্ষার্জনের সুনির্দিষ্ট পথ পরিক্রমা নির্দেশ করে মানসিক বিকাশকেও নানা মাত্রিকে জাগিয়ে তুলতেন। লঘু কিংবা গুরু যাই শাস্তি হোক না কেন স্কুলে করা অন্যায়গুলো নির্ধারিত বলয়েই সীমাবদ্ধ থাকত। কখনও অভিভাবক পর্যন্ত গড়ায়নি। আজকের বাংলাদেশে বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যারা শিক্ষক তাদের শৈশব এবং শিক্ষা কার্যক্রম তো এমনই স্বচ্ছ আর অবারিত ছিল। বয়ঃসন্ধিকালের উদীয়মান কিশোরীদের দেহ আর মনের দোলাচল কি তাদের অভিজ্ঞতায় নেই? কোনটা ভাল কিংবা মন্দ এই বিচার বুদ্ধি সাময়িক লোপ পাওয়া কি এতটাই ক্ষমার অযোগ্য অন্যায়? অল্প বয়সে ভুল-ভ্রান্তি কিংবা বিধি বহির্ভূত কিছু করে ফেলাটা গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে নেয়া কতখানি সঙ্গত তা মনোবিশ্লেষকরাই সঠিক বলতে পারবেন। আজকের যারা শিক্ষক তাদের স্মরণে থাকা আবশ্যক বিদ্যালয়ের পবিত্র পরিবেশে ছাত্রীরা তাদের মানসিক সমস্যাকেও জয় করতে পারত। কারণ শিক্ষকরা শুধু অভিভাবকই নন একজন শিক্ষার্থীর মনোচিকিৎসকও বটে। নকল করা লঘু অন্যায় এটা কিন্তু কোনভাবেই বলা হচ্ছে না। কিন্তু শাস্তিটা এতটাই গুরুতর পর্যায়ে গেল অরিত্রিকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো? সেদিন শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে অনেক অভিভাবকের কথোপকথনে বুঝাই যায় এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা অনেক অসম্মান আর অপমানকে মেনে নিয়ে একটি ভাল স্কুলে নিজেদের সহনীয় করে তুলছে। উন্নতমানের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি কার্যক্রম তার নির্ধারিত মাত্রা থেকে নেমে যাওয়া কোনভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়। অরিত্রির জীবন প্রদীপ নিভে গেছে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের মাত্রাহীন অবিবেচনায়। আর যেন কোন মূল্যবান জীবনের এমন করুণ পরিণতি না হয়। সুখ্যাতির আবরণে ঢাকা পড়া এমন এক পবিত্র বিদ্যাপীঠের লব্ধ সম্মানের ওপর সুতীব্র আঁচড় সত্যিই বেদনাদায়ক ও মর্মান্তিক। পবিত্র শিক্ষাঙ্গনের অন্তর্নিহিত অসঙ্গতি এবং সাংঘর্ষিকতাকে সবার সামনে উন্মোচন করতে একজন নিরীহ ছাত্রীকে প্রাণ দিতে হলো স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে। এমন অনাকাক্সিক্ষত বিপর্যয় শিক্ষাব্যবস্থার মাহত্মকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যায় সেটাও এখন সংশ্লিষ্টদের বিবেচনায় আনতে হবে। এখন শুধু ছাত্রীরা নয় অভিভাবকরাও সচেতন হবেন যাতে তাদের সন্তানও কোন অসহনীয় দুর্ভোগকে বরণ করতে বাধ্য না হয়। সে ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও প্রয়োজনীয় সতর্কতাকে আমলে নেবেন। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×