ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ জাভেদ হাকিম

জোছনার আলোয় দামতুয়া

প্রকাশিত: ০৭:৩৬, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮

জোছনার আলোয় দামতুয়া

তুক-অ-দামতুয়া, নামের মাঝেই রয়েছে অদ্ভুদ এক রহস্যময় আকর্ষণ। তার উপর এটি একটি ঝর্ণার নাম। এমনিতেই পাহাড়প্রেমীদের ছোট বড় যে কোন ঝর্ণার প্রতিই রয়েছে বিশেষ দুর্বলতা। আর সেটা যদি হয় দৈত্যাকার আকৃতির তাহলে তো আর কোন কথাই চলে না। বান্দরবানের গহীনে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা তুক-অ-দামতুয়া, বছর তিনেক হলো সাধারণ পর্যটকদের ভ্রমণসূচীর আলোচনায় এসেছে। দক্ষ গাইডের অভাবে এতদিন যাই যাই করেও যাওয়া হয়নি। তাই বলে হাল ছাড়িনি। নানাজনের কাছে খোঁজখবর নিতে নিতে মিলে যায় দক্ষ গাইডের সন্ধান। ব্যস আর পায় কে? দে-ছুট ভ্রমণ সংঘর বন্ধুরা হাঁড়ি-পাতিল আর বোসকা নিয়ে ছুটলাম। রাতের গাড়িতে চরে খুব ভোরে গিয়ে নামলাম চকোরিয়া। তারপর চান্দের গাড়িতে আলীকদম উপজেলার সতেরো কিলো নামক জায়গার পথে। আঁকা-বাঁকা পাহাড়ী পথে ড্রাইভার নাজেমের গাড়ি চলে হেলিকপ্টারের ভাবসাবে। আড়াই ঘণ্টার পথ চলতে, কখনও কখনও মনে হয়েছে এই বুঝি চান্দের গাড়ি উড়াল দিল আকাশে। দশ কিলো থিঙ্কুপাড়া এসেইে কষে একখান ব্রেক। আর্মি চেকপোস্টে সবার নাম ঠিকানা এন্ট্রি করতে গিয়ে বাধল কিছুটা বিপত্তি। অতঃপর নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো গ্রুপের সবার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নেয়ায় যাবার অনুমতি মিলল। আবারও গাড়ি ছুটল, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাই সতেরো কিলো। গাইড মেন্থন আগেই সেখানে হাজির ছিল। পরিচয় পর্ব শেষে তার পিছুপিছু হাঁটি। যাচ্ছি আদুপাড়ার অভিমুখে। পাড়ায় গিয়ে তার ঘরে বাড়তি মালছামানা রেখে, পাহাড়ের পরম বন্ধু সাইজ মতো বাঁশ নিয়ে ছুটি দামতুয়ার সান্নিধ্য পেতে। দেখতে হলে হাঁটতে হবে। যেমনটা জিততে হলে লড়তে হয়। এই লড়াই কিন্তু স্বভাবিক নয়। যা রীতিমতো মনের সঙ্গে দেহের লড়াই। মাথার ওপর ভাদ্রের প্রখর রৌদ্র, দুচোখের সামনে শুধুই উঁচু উঁচু পাহাড়। হাঁটছি, উঠছি, নামছি মাঝে মধ্যে ঝিরির পানি চোখে-মুখে ছিটিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছি। ভাগ্যিস বাতাস ছিল বেশ। সেইসঙ্গে দুষ্ট রাকিব আর মিষ্টি ছেলে মেহেদির বাংলা ছবির প্রয়াত কৌতুক অভিনেতা দিলদার আর রবিউলের মতো অফুরন্ত চুটকির ভিড়ে, দেহের ক্লান্তি পালিয়েছিল পাহাড়ের গভীর খাদে। ট্র্যাকিং করে যাওয়া আর দূর পাহাড়ের নয়ন জুড়ানো সৌন্দর্য মনের শক্তি বাড়িয়েছিল বহুগুণ। নানা হাস্যরস্যের মাঝেই প্রায় তিন ঘণ্টা হাইকিং-ট্র্যাকিং শেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কানে ভেসে আসে ঝর্ণার মাতাল করা রিমঝিম শব্দের ছন্দ। কিন্তু চোখের সামনে চিকন চিকন বাঁশ গাছ ঘেরা খাড়া পিচ্ছিল পথ। নামতে হবে নিচের দিকে। একটু এদিক সেদিক হলেই সুচালু বাঁশ যে দেহের কোথায় গিয়ে সজোরে ঢুকবে তা কে জানে। এতক্ষণ যে ইফতেখার বাহাদুর ছিল সে এখন বাঁশের ভয়ে পুরোই কুকড়ে গেছে। সব মিলিয়ে ধারেকাছে এসে অস্থির সময়। তবুও পেতে হবে দামতুয়ার কোমল পরশ। আমার একশ’ দশ কেজির দেহটা মানিক ও হাসিবের সহযোগিতায় নিচে নামতে থাকল। নেমে তো পুরাই থ’ হয়ে গেলাম। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। বিশালাকৃতির ঝর্ণা। দুই পাশ থেকেই পানি গড়িয়ে পরছে। পুরাই বুনো এক পরিবেশে দামতুয়ার অবস্থান। ঝর্ণার উচ্চতা আনুমানিক প্রায় নব্বই হতে একশ’ ফিট হবে। বর্ষা শেষে শরত-এও তুক-অ-দামতুয়ার যৌবন কমেনি। সারা বছরই এই ঝর্ণায় পানির প্রবাহ থাকে। আশ্চর্যের বিষয় বেশি পানি পরার পাশ হতে অল্প পানি গড়িয়ে পরার অংশের পানি অনেক বেশি ছিল শীতল। বেশ উচ্চতা আর অনেকখানি জায়গাজুড়ে প্রচ- বেগে পানি নেমে আসার কারণে ঝর্ণার সামনে বিশাল জলাশয় তৈরি হয়েছে। যেখানে অনায়াশেই সাতার কেটে জলকেলিতে মাতা যায়। সবাই যখন ডুব সাতারে উৎফুল্ল, তখন ছবির ছৈয়াল তুহিন ক্যামেরা হাতে মহা ব্যতিব্যস্ত। আর না হয়েই বা কি করার আছে। এ রকম নান্দনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সান্নিধ্য আর চাইলেই পাওয়া যায় না। তাই যতটা সম্ভব ভ্রমণ সঙ্গী ও প্রকৃতির বিশেষ মুহূর্তগুলো ফ্রেমবন্দী করে রাখছে। বান্দরবান জেলার অন্যান্য ঝর্ণার চাইতে, দামতুয়ার ভৌগোলিক আকৃতিটা ভিন্ন রকম। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। তুক-অ-দামতুয়া শব্দের অর্থটাও বেশ চমৎকার। এটি একটি মুরং ভাষা।তাদের ভাষায় তুক অর্থ ব্যাঙ,অ’ অর্থ ঝিরি আর দামতুয়া মানে খাড়া। সব মিলিয়ে ব্যাঙ/মাছ এখান হতে উপরে উঠতে পারে না। তাই এর নামকরণ তুক-অ-দামতুয়া। আমাদের গাইডও ছিল একজন মুরং। বেশ সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবাপন্ন মানুষ। যাই এবার দে-ছুট এর চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী ঝর্ণার উৎস দেখতে। আবারও চড়াই-উৎরাই শেষে প্রাকৃতিক সবুজে ঘেরা ঝিরির দেখা পাই। বড় বড় কিছু পাথুরে বোল্ডার পেরিয়ে একেবারে ঝিরির পানিতে পৌঁছাই। বেশ চমৎকার একটা জায়গা। এই ঝিরি থেকেই পানি দামতুয়াতে যায়। নাম হলো ব্যাঙ ঝিরি। সাধারণত ঝিরির নাম অনুসারেই ঝর্ণাগুলোর নাম হয়ে থাকে। যেটা ট্রেকারদের ভাষায় আপার স্ট্রিম। ব্যাঙ ঝিরির নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সময় জ্ঞান ভুলে যাই। টনক নড়ে যখন গাইড হাঁকডাক শুরু করে। কি আর করা, পাহাড়-জঙ্গলের গহীনে একজন গাইডই তখন ক্যাপ্টিন। সুতরাং তার নির্দেশনায় আদুপাড়ার পথ ধরি। ইস আবারও বহু পথ চড়াই-উৎরাই। গাইডের তথ্য মতো প্রায় নয় মাইল। হাঁটতে হাঁটতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। এমনিতেই পাহাড়ে সন্ধ্যা আসে ঝুপ করে। ওদিকে রফিক ভাইর তাড়া। রাতের রান্নার দায়িত্ব তার ঘাড়েই পড়েছে। কারও পেটেই দুপুরে শুকনো দুই-চার পিছ বিস্কুট ছাড়া তেমন কিছুই পড়েনি। তাই বেচারি ছিল বেশ টেনশনে। যদি খিচুড়ি মজা না হয় তাহলে আজ দে-ছুট এর দামালেরা না জানি তার মাথায়ই ঢালে। আমি অভয় দেই। কারণ হাঁটছি তো ধীরে ধীরে আমি অনেকটা ইচ্ছে করেই। কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না। উদ্দেশ্য তো ভিন্ন, আজকের রাত পূর্ণিমা। পাহাড়ের নির্জনতায় ভরা জোছনার আলো সঙ্গী করে হাঁটব। পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই আমি মনে মনে কিছুটা এক্সসাইটেড। এক ঠিলে দুই পাখি। এ রকম সুযোগ সব সময় মিলে না। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। আকাশছোঁয়া পাহাড় টপকিয়ে গোলাকার চাদ যখন উঁকি দিল। ওয়াও! নিঝুম অন্ধকার পাহাড়ের চারপাশ আলোকিত হয়ে পড়ল। গাছের পাতাগুলো সবুজের মাঝে সোনালি বর্ণ ধারণ করল। অসাধারণ এক অনুভূতি। তখন সবার মাঝেই বিস্ময়ের আনন্দর ঢেউ খেলল। এতটাই আপ্লুত যে এখন আর কারও পাড়ায় ফেরার তেমন তাড়াহুরা নেই। তবুও ফিরতে হচ্ছে। পাহাড় ভ্রমণ শুধু যা দেখতে গিয়েছি তা দেখার মাঝেই যেন সীমাবদ্ধ না হয়। ভ্রমণ হলো জীবনের অন্যতম শিক্ষার মাধ্যম। আর তা যদি হয় পাহাড়, তাহলে তো আর কথাই নেই। পাহাড় ভ্রমণে প্রকৃতি হতে শুরু করে বসবাস করা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমাজের মানুষগুলোর যাপিত জীবনযাপন হতেও অনেক নৈতিক শিক্ষা লাভ করার সুযোগ রয়েছে। চাঁদের আলোর অপার্থিব সুখ সঙ্গী করে, রাত প্রায় নয়টায় পাড়াতে ফিরতেই রন্ধন কারিগর ডাল-চাল আর ফুঁকনি দিয়ে মাটির চুলায় শুরু করে মহা কসরত। সেই কসরতের কাহিনী আজ আর নেই লিখলাম, তুলে রাখলাম অন্য আরেকদিনের জন্য। ইনশাআল্লাহ আগামী কোন এক সংখ্যায় খিচুড়ি আর জুম ঘরের গল্প হবে। যাবেন কিভাবে : ঢাকা হতে সরাসরি বান্দরবানের আলিকদম বাস যায়। টিকেট সঙ্কট হলে কক্সবাজারগামী বাসে চড়ে চকোরিয়া। সেখান হতে মোটরবাইক/চান্দের গাড়িতে সরাসরি সতেরো কিলো এলাকায়। গাইড পাবেন কোথায় : সতেরো কিলো এলাকার চায়ের দোকানিদের সাহায্য নেবেন। অথবা গাইড মেন্থনকেও নিতে পারেন। খরচ : সাধারণত জনপ্রতি একদিনে প্রায় ৩ হাজার ৫শ’ টাকা। তবে খরচটা নির্ভর করে অনেকটা নিজের উপর। নির্দেশনা : ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি রাখবেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের বিধিনিষেধ অনুসরণ করুন। পর্যপ্ত পরিমাণ শুকনো খাবার, খেজুর, স্যালাইন ও প্রয়োজনীয় ওষুধ রাখুন। উলঙ্গ/অর্ধউলঙ্গ কারও প্রতি টিপ্পনি কাটবেন না। আবেদন : অনুগ্রহ করে খাবারের অপচনশীল মোড়কগুলো সঙ্গে নেয়া ব্যাগে করে নিয়ে আসুন। সম্ভব হলে অন্যদের ফেলে দেয়া মোড়কগুলোও কুড়িয়ে পরিচ্ছন্ন করুন। মনে রাখবেন এই দেশ আমাদের সুতরাং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব।
×