ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোয়াজ্জেমুল হক

তিনি চট্টলবীর, কিংবদন্তি রাজনীতিক

প্রকাশিত: ০৪:১৬, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮

তিনি চট্টলবীর, কিংবদন্তি রাজনীতিক

আজ ১৫ ডিসেম্বর। চট্টলবীর আলহাজ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর তিরোধানের প্রথম বার্ষিকী। গেল বছরের এ দিনে পর্বতসম জনপ্রিয় এই রাজনীতিবিদ চট্টগ্রামসহ দেশের পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনকে বিদায় দিয়ে চলে গেছেন। তার দেহঘড়ি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় আজকের এই দিনে। মাসটি ছিল বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ডিসেম্বর বাঙালী জাতির জীবনে বহুল তাৎপর্যবহ। এ মাসেই বাঙালী জাতি মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের স্বাদ নিয়েছে। মহিউদ্দিন চৌধুরীও ছিলেন রণাঙ্গনের সম্মুখ সমরের লড়াকু এক মুক্তিযোদ্ধা। শুধু মুক্তিযুদ্ধ করেননি মুক্তিযুদ্ধকে নেতৃত্বও দিয়েছেন। ডিসেম্বর মাসেই তার জন্ম। ডিসেম্বর মাসেই তার মৃত্যু। ছাত্র জীবনেই তিনি জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। এরপর শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে রাজনীতির মূলধারায় থেকে চট্টগ্রামবাসীকে তিনি দিয়ে গেছেন তার নতুন নতুন কর্মের স্বাদ। ফলে চট্টলবাসীর হৃদয় মন জয় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। আপাদমস্তক এই রাজনীতিবিদ জীবদ্দশায় চট্টলবীর উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। বহু বিশেষণে তিনি বিশেষিত ছিলেন। রাজনীতির মধ্যেই তার সামগ্রিক জীবন আবদ্ধ থাকলেও জীবন চলায় ছিল বহুমাত্রিকতা। এই বহুমাত্রিকতা নিয়ে তিনি সুন্দর এই পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন। একজন প্রকৃত রাজনীতিকের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যতা জনগণ আশা করে তার সবই ছিল তাঁর মাঝে। ১৯৪৪ সালের ১ ডিসেম্বর রাউজানের একদা ‘শান্তির দ্বীপ’খ্যাত গহিরার বক্স আলী চৌধুরী পরিবারে মহিউদ্দিন চৌধুরীর জন্ম। শিশুকাল ও কৈশোর কেটেছে গ্রামেই। দুরন্তপনা নিয়েই তার বেড়ে ওঠা। স্কুল জীবনে আন্দোলন সংগ্রাম তাকে আকর্ষণ করেছে। কলেজ জীবনে ছাত্র রাজনীতি দিয়েই মূলত রাজনীতির সূচনা। কলেজ জীবনের পাঠ না চুকিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জীবনে গিয়ে পুনরায় কলেজে ফিরে আসেন। অতীতে আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে চিহ্নিত সেই চট্টগ্রাম সিটি কলেজে ফিরে এসে তিনি স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। এর পরে আইন বিষয়ে পড়ালেখা করতে চেয়েছেন। কিন্তু গণটুকাটুকির কর্মকান্ড দেখে তিনি মন ফিরিয়ে নেন। এভাবেই তিনি তার শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটান। এরই মধ্যে তিনি শ্রমিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে শেষতক রাজনীতির মূল ধারায় যুক্ত হন। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের একজন লড়াকু সৈনিক হিসেবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। ফলে তাকে আর কেউ দমিয়ে রাখতে পারেননি। একপর্যায়ে এ দলের সাধারণ সম্পাদক পদে অভিষিক্ত হন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে প্রথম নির্বাচনে প্রার্থী হন। বিপুল ভোটে তিনি বিজয়ী হয়ে চট্টগ্রামের নগর পিতার আসনে আসীন হন। এরপর তাকে আর রাজনৈতিক কর্মকান্ডে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পর পর টানা তিনবার মেয়র পদে নির্বাচিত হয়ে মেয়রের মর্যাদার পাশাপাশি চট্টগ্রাম মহানগরীর সার্বিক কর্মকান্ডে তার চিন্তা-ভাবনার ছোঁয়া লাগে। যা ছিল একবারে ঈর্ষণীয়। এই ঈর্ষণীয় কর্মকান্ড নিয়ে তিনি চলে যান জনপ্রিয়তার একেবারে শীর্ষে। বিপ্লবের তীর্থ এই চট্টগ্রাম। বহু বিপ্লবী ও ক্ষণজন্মা পুরুষের জন্ম এই চট্টগ্রামে। দেশের প্রধান সামুদ্রিক বন্দরটি এই চট্টগ্রামে। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা এই সমুদ্র বন্দরটি দেশের অর্থনীতির হৃৎপিন্ড ও প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত। দেশের আমদানি-রফতানির আশি ভাগেরও বেশি এই বন্দর দিয়ে পরিচালিত হওয়ার কারণে জাতীয় কোষাগারের উল্লেখযোগ্য রাজস্ব এই চট্টগ্রাম থেকে যোগান হয় সরকারী কোষাগারে। পাহাড়, নদী ও সমুদ্র ঘেরা এক অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই চট্টগ্রামের ভৌগোলিকগত অবস্থান। একদিকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, অপরদিকে পর্যটনের বহুমাত্রিক সুবিধায় এই নগরীর অবস্থান। মহিউদ্দিন চৌধুরী তার রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ও কর্মকান্ডে এসব নিয়ে আবদ্ধ ছিলেন। তার কর্মকান্ড প্রমাণ করেছে রাজনীতির বাইরে বহুমাত্রিকতা। একজন রাজনীতিবিদ রাজনীতির গন্ডি পেরিয়ে যে অভাবিত বহু কর্মকান্ড করতে পারেন তা তিনি প্রমাণ করে গেছেন। পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ হিসেবে জীবদ্দশায় তার যে জনপ্রিয়তা ছিল মৃত্যুতে ছিল তা আরও বহুগুণ বেশি। চট্টলবীরের প্রয়াণের প্রথম বার্ষিকীতে চট্টগ্রামবাসী তাঁকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে স্মরণ করবে নিঃসন্দেহে। দলমত নির্বিশেষে সকলের উর্ধে তিনি ঠাঁই করে নিয়েছেন। এটাই তার সবচেয়ে বড় অর্জন। অসাম্প্রদায়িক মনোভাব তার অসাধারণ একটি গুণ হিসেবে চিহ্নিত। তার চলে যাওয়া চট্টগ্রামের আপামর মানুষের জন্য একটি বড় ধরনের ক্ষতি। একজন মহিউদ্দিন চৌধুরী আবার কখন জন্ম নেবে তা মানুষের হিসাবের সমীকরণে আসে না। চট্টগ্রামের স্বার্থের পরিপন্থী যে কোন কর্মকা-ের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছেন শক্তভাবে। এ প্রক্রিয়ায় তিনি বার বার জিতেছেন। যেমনি রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও তার জয়ের পাল্লাই ছিল ভারি। তিনি এমন এক জনপ্রিয় রাজনীতিক ছিলেন যাকে গ্রেফতারের পর এই চট্টগ্রামের আনাচ-কানাচও প্রতিবাদের আলোয় জ্বলেছে। সরকারী প্রশাসন পুরো তিন দিন ছিল অচল। চট্টগ্রামবাসী দেখেছে বিভিন্ন সময়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে। তার রাজনীতির বহ্নিশিখা দেদীপ্যমান। যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্মে মহিউদ্দিন চৌধুরী নামটি আলোচিত হতে থাকবে শ্রদ্ধা ও ভালবাসায়। তিনি থাকবেন চট্টগ্রামবাসীর হৃদয়ে চির অম্লান, যা সকল রাজনীতিবিদের ভাগ্যে জোটে না। তার কর্মই তাকে নিয়ে গেছে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠার গহীনে। যেখানে মহিউদ্দিন চৌধুরী নামটি বারে বারেই উচ্চারিত হতে থাকবে তার রাজনৈতিক আদর্শের বিপরীতে থাকা জনমানুষের মনেও। কিংবদন্তি এ রাজনীতিকের জীবনাচার সহজ কোন পথপরিক্রমায় উঠে আসেনি। জীবন-যৌবন, ঘর-সংসার তার জন্য সবই ছিল নামে। মূলত একজন বীরযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ও আদর্শে তার জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন জনমানুষের কল্যাণে। তাঁর হাতের পরশে গড়া এই চট্টগ্রামের বহু স্থাপনা তাঁকে বাঁচিয়ে রাখবে এই নগরীর ইতিহাসে এবং জনগণের হৃদয়ে। আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনকে ঘিরে চট্টলবীরের ম্যাজিক আর প্রত্যক্ষ করা যাবে না। এরপরও সময় ও স্রোত যেহেতু কারও জন্য অপেক্ষা করে না, সে হিসেবে দিন বদলের পালায় চট্টগ্রামের রাজনীতিও এগিয়ে যাবে। তবে এ কথা সত্য যে, এ নগরীর রাজনীতিতে মহিউদ্দিন চৌধুরীর শূন্যতা নগরীর সচেতন সকলকে ভিন্ন আঙ্গিকে বিমুক্ত ভাবনার অতল গহ্বরে ডুবিয়ে রাখবে। কর্ম ও ভালবাসা দিয়ে রাজনীতির তৃণমূল পর্যায়কে তিনি আলিঙ্গন করেছিলেন। তাঁর শরীরের রক্তের ফোটায় ফোটায় ছিল রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা। রাজনীতির অঙ্গনে জনকল্যাণে কোন মহল তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। টানা সতেরো বছর নগর পিতার আসনে থেকে তাঁর মহুমাত্রিক কর্মকান্ড ছিল বিস্ময়ের। রাজনীতির পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে স্বাবলম্বী করতে তিনি ছিলেন সফল এবং তা ছিল ঈর্ষণীয়। যেখানে অপতৎপরতা লক্ষ্য করেছেন সেখানেই দাঁড়িয়ে গেছেন। রুখে দিয়েছেন সব ষড়যন্ত্র। তাই তো তিনি চট্টলবাসীর হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে নিতে সক্ষম হন। আজ তার প্রয়াণের প্রথম বার্ষিকীতে চট্টগ্রামের আপামর জনতা এই ক্ষণজন্মা বীরকে স্মরণ করবে শ্রদ্ধা ও অফুরান ভালবাসা। রাজনীতিতে ম্যাজিক দেখিয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা ও আমৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন, ধারণ ও সবকিছুর উর্ধে রাখা এই বীরের চির বিদায় এ নগরীর জন্য অপূরণীয় যে ক্ষতি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি ছিলেন ‘হ্যাভনটস’দের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের অগ্রসৈনিক। তার জীবদ্দশায় তাকে নিয়ে রচিত হয়েছে দুটি জীবনীগ্রন্থ আর মৃত্যুর পর হয়েছে একটি স্মারকগ্রন্থ। এসব গ্রন্থের মর্মকথা আলো ছড়াতে থাকবে নবপ্রজন্মের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। যেখানেই থাকবেন, ভাল থাকবেন চট্টগ্রামের বীর মহিউদ্দিন চৌধুরী। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×