ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বোমাবাজরা ছাড়া পেয়ে ফের সক্রিয়, ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা তালিকা করছে গোয়েন্দারা

প্রকাশিত: ০৫:০২, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮

 বোমাবাজরা ছাড়া পেয়ে ফের সক্রিয়, ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা তালিকা করছে গোয়েন্দারা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ২০১৫ সালে বোমাবাজির মাধ্যমে নৃশংস হত্যাকা-ে জড়িত বিএনপি-জামায়াত শিবিরের অধিকাংশ বোমাবাজই জামিনে ছাড়া পেয়ে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠছে। ছাড়া পাওয়াদের মধ্যে পুরস্কার ঘোষিত বোমাবাজারাও রয়েছে। তারা সক্রিয় হয়ে ওঠায় বোমাবাজির মাধ্যমে আবারও ব্যাপক প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। জামিনে ছাড়া পাওয়া বোমাবাজদের একটি বিশেষ তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে গোয়েন্দারা। কারাবন্দী বোমাবাজদের ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। জামিনে থাকা বোমাবাজদের গ্রেফতার করতে প্রয়োজনে ২০১৫ সালের মতো আবারও পুরস্কার ঘোষণা করা হবে। বোমাবাজদের সক্রিয় করার নেপথ্য কারিগর হিসেবে পলাতক বিএনপি নেতা কাজী আতাউর রহমান লিটু ও তার ছেলে এবং জামায়াতের সাবেক এমপি অধ্যাপক মজিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন বিএনপি-জামায়াত শিবিরের নেতাকে চিহ্নিত করেছে গোয়েন্দারা। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, এখন পর্যন্ত নির্বাচন উপলক্ষে ব্যাপক বোমাবাজির ঘটনা ঘটেনি। তবে বোমাবাজরা প্রস্তুতি নিচ্ছে। দু’একটি টেস্ট কেসও তারা চালিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে গত ১১ ডিসেম্বর রাতে শ্যামপুরে মহাজোটের ঢাকা-৪ আসনের প্রার্থী সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার প্রচার মিছিলে বোমা হামলা। নেত্রকোনায় পেট্রোলবোমা হামলার ঘটনা। আগামী দিনগুলোতে বোমা হামলার পরিমাণ আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ ২০১৫ সালে যেসব বোমাবাজ গ্রেফতার হয়েছিল তাদের অধিকাংশই জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছে। ছাড়া পাওয়াদের মধ্যে বিএনপির অঙ্গসংগঠন ছাত্রদল আর জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ছাত্রশিবিরের বোমাবাজের সংখ্যা বেশি। এসব বোমাবাজরা আবার পেশাদার কিছু বোমাবাজকে চুক্তিভিত্তিতে জামিনে ছাড় করিয়ে নিয়েছে। পেশাদার বোমাবাজদের কাজই হচ্ছে, বোমা তৈরি, মজুদ, সরবরাহ ও বোমাবাজি করা। আবারও বোমাবাজদের সংগঠিত করার কাজ চলছে। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১৫ সালে ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপক বোমাবাজির ঘটনায় অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল। বোমাবাজির সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের অধিকাংশই গ্রেফতার হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীদের তাদের অনেকেই জামিনে ছাড়া পেয়ে যান। ছাড়া পেয়েই তারা আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই বোমাবাজির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এজন্য বোমাবাজদের গ্রেফতার করতে নতুন করে একটি বিশেষ তালিকা তৈরির কাজ চলছে। আর কারাবন্দী বোমাবাজদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। জামিনপ্রাপ্ত বোমাবাজদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। প্রয়োজনে তাদের ছবি প্রকাশ করে তাদের ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হতে পারে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, নতুন তালিকায় যারা বোমাবাজ হিসেবে স্থান পেয়েছে তাদের মধ্যে বিএনপি-জামায়াত-শিবির ও ছাত্রদলের বোমাবাজের সংখ্যাই বেশি। বোমাবাজদের সংগঠিত করার নেপথ্যে কাজ করছেন রাজশাহী-১ আসনের জামায়াতের এমপি ও জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মজিবুর রহমান, খুলনা মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমীর শফিকুল আলম এবং বেসরকারী নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কন্ট্রোলার জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাহফুজুর রহমান। এই তিনজনসহ শিবিরের ২০ জন বোমাবাজ ২০১৩ সালের ২৭ অক্টোবর মিরপুর-১ নম্বরের একটি বাড়ি থেকে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। বোমাবাজদের সংগঠিত করার নেপথ্যে আরও রয়েছেন বিএনপি নেতা কাজী আতাউর রহমান লিটু। যিনি ইতোমধ্যেই বোমা লিটু হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেছেন। ২০১০ ও ২০১১ সালে দুদফায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন মিরহাজীরবাগের ৩৬৪ নম্বর পাঁচতলা লিটুর বাড়ি থেকে শতাধিক শক্তিশালী বোমা উদ্ধার হয়েছিল। বাড়ির কেয়ারটেকার বেলায়েত হোসেন ১৬৪ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতে জানান, রাজনৈতিক সন্ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যেই বোমাগুলো তৈরি করে মজুদ করা হয়েছিল। বাড়িটির ওপরের তলায় থাকা একাধিক বিশেষ কক্ষগুলো মূলত বোমাবাজদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, জামায়াত-শিবির ও বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের ক্যাডাররা রাতভর বোমা তৈরি করে মজুদ করত। লিটু ও তার ছেলে কাজী আনিসুর রহমান বোমা তৈরির কর্মকান্ড তদারকি করতেন। বহু বছর ধরেই ওই বাড়িতে তৈরি বোমা দিয়ে অনেক সভা, সমাবেশ, মিছিল মিটিংয়ে বোমাবাজি হয়েছে। বেশ কয়েকবার গ্রেফতারও হতে হয়েছেন লিটুকে। জামিনে বার বার ছাড়াও পেয়ে গেছেন। তালিকায় রয়েছেন বরিশাল জেলার হিজলা থানা বিএনপির একটি ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক খালেক মাঝি (৪৫) ও তার দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিজলা থানা ছাত্রদল নেতা রাসেল (২৫) এবং আরাফাত (২৪)। এরা ২০১৩ সালের গত ৫ জানুয়ারি রাজধানীর সবুজবাগ থানাধীন রাজারবাগ বাগবাড়ির একটি পাঁচতলা বাড়িতে বোমা তৈরির সময় ভয়াবহ বিস্ফোরণে আহত হয়েছিল। বাড়িটির মালিক খালেক মাঝি। তিনি নিজেই বোমা তৈরির প্রশিক্ষক। উদ্ধার হয়েছিল এক কেজি গানপাউডার ও প্রায় ২ কেজি বিস্ফোরকসহ বোমা তৈরির নানা সরঞ্জাম। ২০১৫ সালের ১৯ মার্চ লালবাগ থানার ৬২ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার ও বিএনপি নেতা মীর আশরাফ আলী আজম ও বিএনপি নেতা মীর শরাফত আলী সপুর ভাই যুবদলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মীর নেওয়াজ আলীর লালবাগের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার হয়। তারাও আছেন তালিকায়। ওই সময় গ্রেফতার হওয়া ছাত্রদল নেতা বেলাল হোসেন খান (২২) ও আল রিসালাত (২৪)। এ দু’জনও গ্রেফতার হয়েছিল। অন্য বোমাবাজদের মধ্যে আছে ২০১৫ সালের ২০ জানুয়ারি রাজধানীর বনানী থেকে গ্রেফতারকৃত বনানী থানা শাখার সভাপতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মোস্তাফিজুর রহমান, প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবির ছাত্র জয়নাল আবেদিন, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের আর্কিটেকচার বিভাগের ছাত্র আরিফুজ্জামান আরিফ, মহাখালী সরকারী তিতুমীর কলেজের ইংরেজী বিভাগের সাবেক ছাত্র আতিয়ার রহমান ও খালিদ সাইফুল্লাহ। হাজারীবাগ থানা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু হোসেন ও তার ভাই জিসান। ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি সবুজবাগ থানাধীন রাজারবাগের একটি বাড়িতে বোমা তৈরির সময় ভয়াবহ বিস্ফোরণে আহত বরিশাল জেলার হিজলা থানা বিএনপি শাখার একটি ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক খালেক মাঝি (৪৫) ও তার দুই সহযোগী হিজলা থানা ছাত্রদলের নেতা রাসেল (২৯) ও আরাফাত (৩০)। ঢাকার ১৫ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মহীউদ্দিন আহমেদ রাজিব। গ্রেফতার এড়াতে ঢাকার মোহাম্মদপুরের এশিয়ান হাসপাতালে চাকরি করতেন। সেই হাসপাতালেই বিস্ফোরক জমাতেন।
×