ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনীতিতে পিছিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ॥ মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান এখন

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

অর্থনীতিতে পিছিয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ॥ মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান এখন

কাওসার রহমান ॥ বাঙালী জাতি এবার ৪৭তম বিজয় দিবস উদ্যাপন করছে। পাকিস্তানীদের হাত থেকে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বিজয়। যে দেশটিকে শোষণ-নিপীড়নে নিষ্পেষিত করতে চেয়েছিল পাকিস্তান, সেই বাংলাদেশ এখন অনেক কিছুতে পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। এই ৪৭ বছরে বাংলাদেশের অর্জন কম নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানব উন্নয়ন, গড় আয়ু বৃদ্ধি, খাদ্যে উন্নয়ন, মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাসে, সব কিছুতেই পাকিস্তানকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পুরো পাকিস্তান আমলে এ অঞ্চলের মাথাপিছু আয় ছিল ৫০-৬০ ডলারের মতো এবং তা ছিল প্রায় স্থবির। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছরেরও কম। বেকারত্বের হার ছিল ২০-৩০ শতাংশ। শিক্ষার হার ২০ শতাংশ। প্রকৃতি ছিল ভয়ঙ্কর প্রতিকূল। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ নামক দেশটির টিকে থাকাই মুশকিল হবে। প্রায় অভিন্ন সুরে বিশ্বব্যাংকের দুই সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ইউস্ট ফাল্যান্ড ও পার্কিনসন (১৯৭৬) এক বইয়ের শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘বাংলাদেশ: এ্যা টেস্ট কেইস অব ডেভেলপমেন্ট’। এখানে স্বতঃসফূর্তভাবে উদ্যোক্তা শ্রেণীর বিকাশের কোন সম্ভাবনাও তাদের চোখে পড়েনি। কী আশ্চর্য, সেই হতভাগ্য দেশটিই আজ ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে সারাবিশ্বের নজর কাড়ছে। শুধু মাথাপিছু আয় কেন, অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের প্রায় সব ক’টি সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে। মালথাস তত্ত্বে বিশ্বাসীদের অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে ১.০১ শতাংশে। বাংলাদেশের প্রতি দম্পতির সন্তান সংখ্যা দুই। পাকিস্তানের তা সাত। বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ শিশু প্রাথমিক স্কুলে যায়। পাকিস্তানে এ হার ৭০ শতাংশের মতো। আর সার্বিক শিক্ষার হার তো পাকিস্তানে মাত্র ২০ শতাংশ। বিশ্বখ্যাত সাপ্তাহিক দি ইকোনমিস্ট গত বছর (২০১৭) বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় নিয়ে একটি খুদে প্রতিবেদন ছাপে। ছোট্ট ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাথাপিছু আয়ের সূচকে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গেছে। জুন (২০১৭) শেষে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল এক হাজার ৫৩৮ মার্কিন ডলার। পাকিস্তানের ছিল এক হাজার ৪৭০ ডলার। বাংলাদেশের চেয়ে ৬৮ ডলার কম। শুধু এই প্রতিবেদনটি পড়লেই বুঝা যায়, বাংলাদেশ কোথায় ছিল আর এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে। ওই প্রতিবেদনেই বলা হয়, বাংলাদেশ এক দশক ধরে ৬ শতাংশের বেশি হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। গত তিন বছর ধরে ৭ শতাংশেরও বেশি হারে তার অর্থনীতি বাড়ছে। আর এর বিপরীতে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি ঘটেছে ৩-৪ শতাংশ হারে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে যখন বাংলাদেশ নামের স্বাধীন দেশটির জন্ম হয় তখন তার জিডিপির বড়জোর ৬-৭ শতাংশ আসত শিল্প খাত থেকে। তখন পাকিস্তানে শিল্পের অবদান ছিল ২০ শতাংশ। আর বর্তমানে বাংলাদেশের শিল্প খাতের অবদান জিডিপির ২৯ শতাংশের মতো। এই হার দিন দিনই বাড়ছে। তৈরি পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য আসলেই নজরকাড়া। ভারত ও পাকিস্তান মিলে যে পরিমাণ গার্মেন্টসামগ্রী রফতানি করে, বাংলাদেশ একাই তার চেয়ে বেশি রফতানি করে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের চেয়ে বেশি হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে তার দ্রুত হারে কমে যাওয়া জনসংখ্যা। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যেখানে ১.০৪ শতাংশ, সেখানে পাকিস্তানের ওই হার ২.৪ শতাংশ। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য তা হলো, আমরা যখন যুদ্ধ করে পাকিস্তানকে হারিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করি তখন আমাদের জনসংখ্যা ছিল প্রায় আট কোটির মতো। আর আয়তনে আমাদের চেয়ে পাঁচগুণ বড় পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল সাত কোটি। আর আজকে আমাদের জনসংখ্যা যেখানে ১৬ কোটি, পাকিস্তানের তা ২১ কোটি। শুধু কি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেই বাংলাদেশের এমন সাফল্য? মোটেও না। আর্থ-সামাজিক প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। মানব উন্নয়নের অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশ পাকিস্তানকে অনেক দূরে ফেলে এসেছে। বর্তমানে আমাদের জীবনের গড় আয়ু ৭২ বছর, পাকিস্তানের তা ৬৬ বছর। আমাদের চেয়ে গড়ে ছয় বছর কম। শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশে এক হাজারে ৩১, পাকিস্তানে তা ৬৬। আমাদের দ্বিগুণেরও বেশি। আমাদের ছেলে-মেয়েরা গড়ে ১০.২ বছর ধরে লেখাপড়া করে। সেখানে পাকিস্তানের হার ৮.১ বছর। আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষার হার ৪২ শতাংশ। পাকিস্তানে এই হার আমাদের অর্ধেকেরও কম, ২০ শতাংশ। প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের সাফল্য প্রায় শতভাগ। আমাদের মানব উন্নয়ন সূচক ০.৫৮। পাকিস্তানের ০.৫৫। আমাদের জেন্ডার সূচক ০.৯৩। পাকিস্তানের ০.৭৪। আমাদের ১৫ বছরের বেশি জনসংখ্যার ৫৯.৪ শতাংশই কর্মে নিয়োজিত। এর একটা বড় অংশ আবার নারী। পাকিস্তানে তা ৫১ শতাংশ। আমাদের রফতানি ও আমদানি মিলে জিডিপির ৪২.১ শতাংশ। পাকিস্তানের তা ২৮.১ শতাংশ। ২০০০ সালকে ভিত্তি বছর ধরলে আমাদের রফতানির সূচক (২০১৪) ৫০৬.৭৯। আর পাকিস্তানের তা ২৪৫.৭৭। সামন্ততান্ত্রিক পাকিস্তানের কৃষকদের চেয়ে বাংলাদেশের কৃষকদের অবস্থা ঢের ভাল। আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষির পাশাপাশি অকৃষি খাতের অবদানও উল্লেখযোগ্য। গ্রামে অর্থ প্রেরণের সুযোগও বেড়েছে। প্রতিদিন এক হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ যাচ্ছে শহর থেকে গ্রামে শুধু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। অন্য ব্যাংকগুলোর গ্রামীণ শাখাও বেশ সক্রিয়। তাই বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি অনেকটাই চাঙ্গা। সে কারণে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের আয়-বৈষম্যও অনেক কম। এ রকম অসংখ্য সূচক দিয়ে আমরা প্রমাণ করতে পারি যে পাকিস্তানকে আমরা ছুড়ে ফেলে দিয়ে এসেছি, তার চেয়ে কতটাই না এগিয়ে গেছি আমরা। দেশটা স্বাধীন হয়েছে বলেই না আমরা আমাদের ভাগ্য এমন করে পরিবর্তন করতে পারছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। জাতির জনকের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সেই আওয়ামী লীগের কা-ারি এখন বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা। গত ১০ বছর ধরে তারই নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের ১০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি স্থিতিশীল জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এসময়ে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দুটি মাইলফলক অর্জন করেছে। প্রথম দফায় পাঁচ শতাংশের বেড়াজাল ভেঙ্গে ছয় শতাংশের ক্লাবে উঠে প্রবৃদ্ধি। দ্বিতীয় দফায় ছয় শতাংশের বৃত্ত ভেঙ্গে সাত শতাংশের ক্লাবে যোগ দেয় এই প্রবৃদ্ধি। বর্তমানে সাত শতাংশের বৃত্ত ভেঙ্গে আট শতাংশের মাইলফলক অর্জনের পথে রয়েছে দেশের অর্থনীতির এই মাপকাঠিটি। বাংলাদেশের সংরক্ষণবাদী উন্নয়ন সহযোগীরা এই প্রবৃদ্ধির স্বীকৃতি দিতে বেশ বিলম্ব করলেও অবশেষে তারা এদেশের এই অর্জনকে মেনে নিয়েছে। এখন উন্নয়ন সহযোগীরাই বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তথা আর্থিক বৃদ্ধি সাত শতাংশের উপরে অর্জিত হবে। সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) তার ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক ২০১৮’ তে বলেছে, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। স্বাধীনতার পর থেকে শুরু করে দীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৪ শতাংশের বেশি বাড়েনি। এর মধ্যে ১৯৭৩-৭৪ থেকে ১৯৭৯-৮০ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র গড়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। পরের ১০ বছর জিডিপি বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ হারে। এরপর থেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছাড়িয়ে গেছে ৬ শতাংশ। উন্নতি হয়েছে মাথাপিছু আয়েও। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৬৭১ টাকা। বর্তমানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলার। বর্তমানে আর জিডিপির আকার ২৭৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। জিডিপির আকার ১০ হাজার কোটি ডলার ছাড়াতে স্বাধীনতার পর ৩৪ বছর লেগেছে। জিডিপি ছাড়াও বাংলাদেশ এখন গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে (বিশ্ব ক্ষুধাসূচক) পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে। ২০১৭ সালের গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৮; যেখানে পাকিস্তানের ১০৬। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ মানব উন্নয়নের অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়েছে। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের গড় আয়ু ছিল ৬০ বছর। বাংলাদেশের চেয়ে দুই বছর বেশি ছিল তাদের গড় আয়ু। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের গড় আয়ু ৭২ বছর, যা পাকিস্তানের চেয়ে ছয় বছর বেশি। জাতিসংঘের সর্বশেষ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ১৮৮ দেশের মধ্যে ১৩৯তম। পাকিস্তান পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের চেয়ে ৮ ধাপ। ৫ বছরের কম শিশু মৃত্যুহারেও এক সময় বাংলাদেশ পিছিয়ে ছিল। ২০১৬ সালের হিসেবে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণের পর প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে ৩৪ জনের মৃত্যু ঘটে। পাকিস্তানে এ সংখ্যা ৭৯ জন। বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার এক সময় অনেক বেশি ছিল। এক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে। এখানে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ৯৮ ভাগ শিক্ষার্থী। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এ হার ৭২ শতাংশ। ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শুধু পাকিস্তান নয়, ভারতের চেয়েও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার বিদ্যমান মান বিবেচনা করলে বাংলাদেশের শিশুরা ভারত ও পাকিস্তানের শিশুদের চেয়ে বেশি উৎপাদনশীল হবে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের মানবসম্পদ সূচক অনুযায়ী, ১৫৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৬তম। ভারত ও পাকিস্তান যথাক্রমে ১১৫ ও ১৩৪তম। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার, শিশুদের স্কুলে পাঠ গ্রহণের সময়কাল, শিক্ষার মান, প্রাপ্তবয়স্কদের অন্তত ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকা এবং শিশুদের সঠিক আকারে বেড়ে ওঠাসহ বেশ কয়েকটি সূচক দিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। আদর্শ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধা পেলে একটি শিশু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে শতভাগ উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারে। কিন্তু নিজ নিজ দেশে ভিন্ন ভিন্ন মানের সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী বেড়ে ওঠে শিশুরা। তাই সবাই সমানভাবে শতভাগ উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারে না। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের একজন শিশু বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা পেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গড়ে ৪৮ শতাংশ উৎপাদনশীলতা দেখাতে পারবে। আদর্শ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসুবিধা পেলে তারা শতভাগ কর্মদক্ষতা দেখাতে পারত। অন্যদিকে ভারত ও পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে আরও পিছিয়ে। ভারতের শিশুরা ৪৪ শতাংশ ও পাকিস্তানের শিশুরা ৩৯ শতাংশ কর্মদক্ষতা দেখাতে পারবে। স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে শিশুদের সুরক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ এগিয়ে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে যত শিশু জন্ম নেয় এবং পাঁচ বছর বয়স হওয়ার পর ৯৭ শতাংশ শিশুই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বা উপযোগী থাকে। নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভারতে এমন প্রতি ১০০ শিশুর মধ্যে ৯৬ শিশু বেঁচে থাকে। পাকিস্তানে এই হার ৯৩ শতাংশ। বাংলাদেশের একটি শিশু ৪ বছর বয়সে পড়াশোনা শুরু করে ১৮ বছর পার হওয়ার আগে গড়ে ১১ বছর শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় থাকে। অন্যদিকে ভারতের শিশু ১০ দশমিক ২ বছর ও পাকিস্তানের শিশু ৮ দশমিক ৮ বছর স্কুলশিক্ষা পায়। বাংলাদেশের ১৫ বছরের বেশি বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে গড়ে ৮৭ শতাংশ কমপক্ষে ৬০ বছর বেঁচে থাকবে। ভারতের ৮৩ শতাংশ শিশু-কিশোর কমপক্ষে ৬০ বছর বেঁচে থাকবে। আর পাকিস্তানের ৮৪ শতাংশ শিশু-কিশোররা এই বয়সসীমা পার করবে। ১০০ বাংলাদেশী শিশুর মধ্যে ৬৪ জন যথাযথ উচ্চতা নিয়ে বেড়ে ওঠে। প্রতি ১০০ জনে ভারতে তা ৬২ জন ও পাকিস্তানে ৫৫ জন। বিশ্বব্যাংক বলছে, এই ধরনের খর্বাকৃতি জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত বয়ে বেড়াতে হয়। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, অন্তর্ভুতিমূলক উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ অনেকটাই পেছনে ফেলেছে ভারত ও পাকিস্তানকে। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থনীতিগুলোর মধ্যে ভারতের অবস্থান ৬২, পাকিস্তানের ৫২ ও শ্রীলঙ্কার ৪০। সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ৩ দশমিক ৯৮, পাকিস্তানের ৩ দশমিক ৫৫ ও ভারতের ৩ দশমিক ৯। শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বীদের অনেকের চেয়েও ভাল করেছে বাংলাদেশ। পেছনে ফেলেছে ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্সকেও। তবে খুব কাছাকাছি আছে ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া। শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায়ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে বাংলাদেশ। এ তালিকায় ১৬৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৩তম। পাকিস্তানের অবস্থান ১৫৩তম আর ভারতের অবস্থান ১৪১তম। স্বাধীনতার পর বিগত ৪৭ বছরে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তিগুলো পাল্টেছে। ক্রমে শিল্প ও সেবা খাতের বিকাশ হয়েছে, যা অর্থনীতির মৌলিক কাঠামো বদলে দিয়েছে। তবে এত বছর পরও বাংলাদেশের রফতানি খাত এক পণ্যনির্ভর। পাটের বদলে তৈরি পোশাক এসেছে। তবে রফতানি পণ্যে বৈচিত্র্য খুব বেশি আনা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতা যুদ্ধের ঠিক আগেই বাংলাদেশকে আরেকটি বড় দুর্যোগ মোকাবেলা করতে হয়েছিল। ১৯৭০ সালে এক ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়। দেশটির স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে সময় অভিযোগ করেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে গমের বাম্পার ফলন হলেও সামান্য পরিমাণও দেয়নি পূর্ব পাকিস্তানকে পাশাপাশি এক টুকরো কাপড়ও পাঠানো হয়নি। এ রকম দৈন্যদশা থেকে স্বাধীনতার ৪৭ বছরে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সব সূচকে অনেক অগ্রগতি হয়েছে দেশটির। এ কারণে এখন পাকিস্তানের উন্নয়ন কর্মীরা দেশের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। এক সময়ের খ্যাতিমান ক্রিকেটার ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এক টেলিভিশন টকশো অনুষ্ঠানে দেশটির এক উন্নয়ন কর্মী জাইঘাম খান তাকে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের উন্নয়ন যদি ঘটতে চান, সুইডেনকে না দেখে বাংলাদেশের দিকে তাকান। পাকিস্তানকে বাংলাদেশের মতো বানান।’ পরে তিনি তার বক্তব্যের বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে পাকিস্তানের ‘দ্য নেশন’ পত্রিকায় ‘দ্য বাংলাদেশ মডেল’ শিরোনামে একটি লেখাও প্রকাশ করেন। জাইঘাম খান মনে করেন, ‘বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের এক দারুণ মুহূর্তের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।’ তার মতে, ‘বাংলাদেশ পাকিস্তানের মতোই একটা দেশ। দুই দেশের চিন্তাভাবনা, জীবনাচরণে অনেক মিল। তাহলে পাকিস্তান কেন এখানে আটকে আছে, আর বাংলাদেশ এতদূর এগিয়ে গেছে। এজন্যেই আমি মনে করি, আমাদের যদি শেখার কিছু থাকে, সেটা বাংলাদেশের কাছে।’ বাংলাদেশের জনসংখ্যা কর্মসূচীর সাফল্যের উদাহরণ দিয়ে তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশ তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এক দশমিক এক শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে। যেটা একটা বিরাট সাফল্য। এর বিপরীতে পাকিস্তানে আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখনও দুই দশমিক চার। সেখানেই আমরা আটকে আছি।’ শুধু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নয়- অর্থনীতি, মানবিক উন্নয়ন সূচক, সামাজিক উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন- ইত্যাদি সবক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে জাইঘাম খান বলছেন, ‘বাংলাদেশই হওয়া উচিত পাকিস্তানের উন্নয়নের মডেল। আমার মতে পাকিস্তানের সামনে শেখার জন্য উদাহারণ হিসেবে যে কয়েকটি দেশ আছে, তার একটি বাংলাদেশ।’ তবে তিনি মনে করেন, ‘পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের সামনে কিন্তু চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। বাংলাদেশের আয়তন অনেক কম। প্রাকৃতিক সম্পদ অনেক কম। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশ অনেক বেশি নাজুক অবস্থানে। কিন্তু এসব অতিক্রম করে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।’
×