ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সাজ সাজ রব সর্বত্র

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ লড়াই, জয়ের আনন্দ

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ লড়াই, জয়ের আনন্দ

মোরসালিন মিজান ॥ বাঙালীর বহু বছরের সংগ্রাম। এই সংগ্রাম চূড়ান্ত পরিণতি পায় একাত্তরে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সবাই এগিয়ে এসেছিলেনÑ তা বলা যাবে না। পাকিস্তানীদের পা চাটা গোলামদের কথা সবার জানা। পাশাপাশি অনেক শিক্ষিত ব্যক্তি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করার সাহস দেখাননি। সুবিধাবাদীরা যথারীতি নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এ অবস্থায় সরলপ্রাণ খাঁটি দেশপ্রেমিকরাই শুধু এগিয়ে এসেছিলেন। পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন প্রাণপণ। মামুলি অস্ত্র। তা-ও দুর্লভ। গোলাবারুদ সহজে মেলে না। এরপরও পিছু পা হননি। বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের দেয়া ট্রেনিং আর মনের বল কাজে লাগিয়ে দুর্দান্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। আহারে, কত মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে শত্রুর মোকাবেলা করতে করতে মাটির সঙ্গে মিশে গেছেন! কত সবুজ ধানক্ষেত শহীদের রক্তে লাল হয়েছে! তার পর ১৬ ডিসেম্বর। আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় বর্বর পাকিস্তান আর্মি। আমরা গাইবো গাইবো বিজয়েরই গান...। সেই দিন থেকে শুরু হয় বাঙালীর বিজয়ের গান। আজ ৪৭তম বার্ষিকী। প্রতিবারের মতো এবারও বিপুল আয়োজনে উদ্যাপন করা হবে মহান বিজয় দিবস। সে লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে নানা প্রস্তুতি। ইতোমধ্যে ঢাকার রাস্তার ধারের বড় বড় ভবনে আলোক সজ্জা করা হয়েছে। জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ রং দৃশ্যমান করা হয়েছে ভবনের গায়ে। সন্ধ্যা হতেই সব বাতি একসঙ্গে জ্বলে উঠছে। তাতেই শিল্পীত একটা রূপ। একাত্তর ঘিরে যে আবেগ, যে আনন্দ দারুণভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। মতিঝিল, কাওরান বাজার, আগারগাঁওসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এমন উৎসব প্রস্তুতি। আর জাতীয় পতাকার কথা তো না বললেই নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের অসীম সাহস আর বীরত্বে পাওয়া পতাকা বাঙালীর শৌর্য বীর্যের প্রতীক হয়ে উড়ছে। বাসার ছাদে, হাতে, গাড়িতে পতাকা। পতাকার রঙে বানানো হয়েছে পোশাকও। এই পোশাকে সেজে আজ সকালে ঘর থেকে বের হবেন সব বয়সী মানুষ। জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন। অংশ নেবেন ঢাকার বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজিত উৎসব অনুষ্ঠানে। শাহবাগ টিএসসি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানসহ আশপাশের এলাকায় আজ থাকছে বহুবিধ আয়োজন। সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে বর্ণাঢ্য বিজয় শোভাযাত্রা বের করবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সংস্কৃতিকর্মী ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে সকাল ১০টায় এই শোভাযাত্রা বের করা হবে। শোভাযাত্রা উদ্বোধন করবেন নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার। বক্তব্য রাখবেন জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ, সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ প্রমুখ। জাতীয় ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা বর্ণিল সাজে সজ্জিত হয়ে শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন। এছাড়াও জোট আয়োজিত বিজয় উৎসবের শেষ দিনে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে থাকবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। এবারের আয়োজনের স্লোগানÑ স্বাধীনতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের দিন শেষ/মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাবেই বাংলাদেশ। বিজয় দিবসের অন্যতম প্রধান আয়োজন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে থাকবে ছায়ানট। গত তিন বছরের ধারাবাহিকতায় এবারও এখানে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। যথারীতি বিকেল পৌনে চারটায় শুরু। শেষ হবে ৪টা ৩১ মিনিটে। ইতোমধ্যে গ্যালারি সংলগ্ন অংশে সুউচ্চ মঞ্চ গড়া হয়েছে। জাতীয় পতাকার রঙে গড়া মঞ্চের চারপাশ ঘিরে বসার ব্যবস্থা। লাল-সবুজ পোশাক পরে আসা সাধারণ মানুষ মেঝেতে বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবেন। সাধারণ পোশাকে আসবেন যারা তাদের জন্য গ্যালারিতে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে ছায়ানটের শিল্পীরা ৮টি সম্মেলক গান পরিবেশন করবেন। সেইসঙ্গে সঙ্গে থাকবে সম্মেলক নৃত্য। একক গান পরিবেশন করবেন ডালিয়া নওশিন ও সেমন্তি মঞ্জরী। কবি তারিক সুজাতের কবিতা থেকে আবৃত্তি করবেন আব্দুস সবুর খান। আবৃত্তির সঙ্গেও থাকবে নৃত্যায়োজন। ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুন বিজয় দিবসের এই আয়োজনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বাঙালী সংস্কৃতির চর্চা ও প্রসারে নিয়োজিত ছায়ানট বরাবরের মতো এবারও সকলকে সহযাত্রী হিসেবে পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও বর্ণাঢ্য কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। দুই দিনের কর্মসূচী হাতে নিয়েছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। দ্বিতীয় দিনে আজ রবিবার বিকেল ৫টায় একাডেমির নন্দন মঞ্চে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। আলোকচিত্র ও নিদর্শন নিয়ে নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে প্রদর্শনীর আয়োজন করবে জাতীয় জাদুঘর। ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবর, উত্তরা, পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কসহ বিভিন্ন স্থানে বিজয় উৎসবের আয়োজন করা হবে। সাজ সাজ রব এখন সর্বত্র। তবে এসব আয়োজনের দুর্বলতার দিকটিও বলা চাই। তৃণমূলের সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে রাখার কোন প্র্যাকটিস আজও করতে পারেননি শহুরে আয়োজকরা। ‘হয়তবা ইতিহাসে তোমাদের নাম লেখা রবে না/বড় বড় লোকেদের ভিড়ে জ্ঞানী আর গুণীদের আসরে/তোমাদের কথা কেউ কবে না...।’ সত্যিই তো কেউ বলে না একাত্তরের বীরদের কথা। রণাঙ্গনের ইতিহাস গৌরবগাঁথা সম্পর্কে আজকের প্রজন্ম তাই সামান্য জানে। বিজয়ের আনন্দটাও পুরোপুরি উপভোগ করতে পারে না তারা। এই সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে। দায় আমাদের।
×