ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

এমন ‘বীভৎস’ জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন ওরা, ঘুমের মধ্যে এখনও আঁতকে ওঠেন

জামায়াত-বিএনপির অগ্নিসন্ত্রাসে ক্ষতবিক্ষত ওরা

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

জামায়াত-বিএনপির অগ্নিসন্ত্রাসে ক্ষতবিক্ষত ওরা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যশোরের ঝিকরগাছার নার্গিস আক্তারের চার/ সাড়ে চার বছরের ছেলে নীরব। শিশু নীরব অন্য শিশুর বাবাকে দেখে জানতে চায় তার বাবা কোথায়? নীরবের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার বদলে নীরব থাকতে হয় নার্গিসকে। ‘বাবা নেই-আর কোনদিন আসবেও না,’ তা এই শিশুকে বোঝানো কঠিন। মৃত্যু কী, মরে যাওয়া কি, তা এখনও ঠিকঠাক বুঝে ওঠেনি নীরব। ট্রাকচালক খন্দকার শরিফুল-নার্গিস দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে নীরব সবার ছোট। বিএনপি-জামায়াতের লেলিয়ে দেয়া ভয়ঙ্কর পেট্রোলবোমায় ’১৪ সালে নীরবের বাবা চলে গেছেন পরপারে। তখন নীরব মাত্র আট মাসের। ওই আট মাসের শিশু এখন বাবা ডাকতে শিখেছে, বাবা কি বুঝতেও শিখেছে। কিন্তু এখন দুনিয়ার এ প্রান্ত ও প্রান্ত তন্নতন্ন করে খুঁজলেও আর তার বাবাকে পাওয়া যাবে না। জাতির কাছে নার্গিস আক্তারের প্রশ্ন-কী দোষ ছিল শরীফুলের, কী দোষ ছিল তার শিশুটির। কেন শরীফুলের জীবন বিএনপি-জামায়াত কেড়ে নিল, কেন তার শিশুরা বাবাকে হারাল। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার নিরীহ ট্রাকচালক শরিফুল পেট্রোলবোমায় নিহত... নিহতদের পরিবারের বেদনার বাষ্পে শনিবার ভারি হয়ে উঠেছিল জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জ। নীরব আর নার্গিসদের মর্মস্পর্শী কথায় চোখ ভিজেছে উপস্থিত লোকজনের। ভোটের মাঠে নতুন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সবাই একবাক্যে বলেছেনÑ যারা মানুষ পুড়িয়ে, মানুষ খুন করে ক্ষমতায় আসতে চায় তাদের যেন জাতি বর্জন করে। বাংলাদেশ অনলাইন এক্টিভিস্ট ফোরামÑবোয়াফ এই আলোচনার আয়োজন করে। শিরোনাম ছিল ‘মৃত্যুঞ্জয়ী আমি ও আমার জীবন’। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে টিকে আছেন যারা সেই আহতরা বলছেন, এত কষ্ট, এত যন্ত্রণার এ জীবন বয়ে বেড়ানো যায় না। প্রতিমাসেই নিয়ম করে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, কারও কারও প্রতিমাসে শরীরে রক্তও দিতে হয়। কোন কোন সময় তো মাথাটাও কাজ করে না। আর সেই দুঃসহ- ভয়ঙ্কর স্মৃতি আজও ঘুমের মধ্যে মনের অজান্তে তাকে তাড়িয়ে ফেরে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিশেষ অতিথি ছিলেন, ঢাবির সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ঢাবি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিন্নাত হুদা, সাংবাদিক ইশতিয়াক রেজা, সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ইয়াছিয়া জামান প্রমুখ। সংগঠন সভাপতি কবীর চৌধুরী তন্ময়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বোয়াফের যুগ্ম সম্পাদক সেলিনা সিমি। অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেয়া হয় পেট্রোলবোমা নিয়ে একটি মামলা চলমান আছে। ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলাটি করা হয়েছে। আদালত ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দিলে তা এসব অসহায় মানুষের মধ্যে বণ্টন করা হবে। আলোচনা অনুষ্ঠানে বলা হয়, রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের জন্যই রাজনীতি করে। কিন্তু তারা যদি সেই মানুষকেই পুড়িয়ে মেরে ফেলে তাহলে কাদের জন্য তারা রাজনীতি করবেন ? না’গঞ্জের নূরুল আলমের স্ত্রী জীবনের নির্মমতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছেন, পেট্রোলবোমার আগুনে স্বামী নিহত হওয়ার পর সাহায্য পাননি। সমাজের লোলুপ মানুষের ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছেন তিনি। সাহায্য একটু চাইতে গিয়ে বার বার তাকে শুনতে হয়েছে ‘তুমি তো সুন্দরী, তোমার সাহায্যের কি দরকার?’ রাত বারোটা পর্যন্ত স্থানীয় জনপ্রতিনিধির বাড়িতে দাঁড়িয়ে থেকেছেন। কিন্তু তার কথা শোনারও সময় হয়নি জনপ্রতিনিধির। নুরুল আলমকে কেন হত্যা করা হলো, কেন তার স্ত্রী আজ এভাবে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? যারা মরে গেছেন তারা তো মরে বেঁচেছেন। কিন্তু পৃথিবীতে তাদের পরিবার-পরিজন যে নির্মম কষ্টের জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন, এ লজ্জা কার- এমন প্রশ্ন রেখেছেন ’১৪ সালের নিহত ব্যক্তিদের পরিবার। আইনজীবী খোদেজা আক্তার নাসরিন হোসেন ঢাকা আইনজীবী সমিতি ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফিরছিলেন। দিনটি ছিল ২৩ নবেম্বর ’১৩ সাল। বাস যখন ঢাকা শিশু হাসপাতালের সামনে তখনই পেট্রোলবোমার আগুনের লেলিহান শিখা! বলছিলেন সেই সময়ের দুঃসহ কষ্টের স্মৃতি আজও তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ২৮ দিনের আইসিইউ, দীর্ঘ এক বছরের পচে যাওয়া দুই হাতের থেরাপি দিতে গিয়ে মনে হতো এর চেয়ে মরে গেলেই বুঝি ভাল হতো। ঘুমের মধ্যে এখনও আগুনের হল্কা দেখেন নার্গিস। হয়ত এই জীবনে আর কোনদিন স্বাভাবিক হতে পারবেন না তিনি। নার্গিসের প্রশ্ন? এই নির্মমতার জন্য যে মামলা করা হয়েছিল তার বিচার হবে কবে ? তিনি এ মামলার সাক্ষী কিন্তু তাকে কোনদিনই আদালতে যেতে বলা হয়নি। এসব মামলার বিচার কেন হলো নাÑ প্রশ্ন রাখেন তিনি। ঢাকার ইডেন কলেজের ছাত্রী সাথির বাবা খোকন মিয়া মেয়ের ভয়াবহ অবস্থার কথা তুলে ধরে বলেন, আমার মেয়ে তো পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিল। স্বাধীন দেশে কি আমার মেয়ের পরীক্ষা দেয়ার অধিকার নেই? পেট্রোলবোমা আমার মেয়ের জীবনই শুধু নয় আমার পরিবারটিকেই জ¦ালিয়ে দিয়েছে। কেবল পেট্রোলবোমার ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা তারাই বোঝে যাদের এই ভয়ঙ্কর আগুন স্পর্শ করেছে। সাথি এখন আর স্বাভাবিক নেই। কোন পারিবারিক অনুষ্ঠানে যায় না। ঘরের মধ্যেই নিজেকে বন্দী করে রাখে। খোকন মিয়া বলেন, ড. কামালের কাছে প্রশ্ন : আপনি যাদের নিয়ে জোট গড়েছেন তারা যে আর কোনদিন পেট্রোলবোমা মারবে না, তার নিশ্চয়তা কি আপনি দিতে পারেন? একই ঘটনায় আহত হন মোঃ খোকন। তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, সাত মাস হাসপাতালে অনেক কষ্টে কেটেছে, এখনও কষ্টেই কাটছে। খোকন স্বাভাবিক চেহারা হারিয়ে ফেলেছেন। পেট্রোলবোমার ভয়াবহতা খোকনের বর্তমান চেহারায় ফুটে ওঠে। এমনদিন যেন কারো জীবনে আর ফিরে আসে না, বলেন খোকন। সন্ত্রাসের শিকার ফুরকানউজ্জামান বলেন, আমি ২৩ জানুয়ারি ’১৪ অফিস থেকে বাসে বাসায় ফিরছিলাম। পথের মধ্যে বাসের ভেতর পেট্রোলবোমা নিক্ষেপ করা হয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আগুনে ঝলসে যায় অনেক মানুষ। এখনও সেই পোড়া জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। ক্ষমতার পালাবদলে কেন তার মতো মানুষকে হাতিয়ার হতে হয়Ñ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি প্রশ্ন রাখেন তিনি। সালমা অনিকা, ইডেন কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। নিজের ও পরিবারের ভয়াবহতার কথা তুলে ধরে বলেন, আমার মা ও ভাইসহ আমি হামলার শিকার হই। ডাক্তার দেখাতে নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে ঢাকায় আনা হয়েছিল। আমার বদলে আমার মা আর ভাইকে আগুনে পুড়ে ভর্তি হতে হয় হাতপাতালে। এখনও তাদের প্রতিমাসে চিকিৎসা দিতে হয়। এই অবস্থা যেন আর কোন রাজনৈতিক দল তৈরি না করে, আহ্বান জানান অনিকা। ’১৪ সালের ২৩ জনুয়ারি কাপাসিয়ার জমির উদ্দিন ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে ভয়াবহ পেট্রোলবোমা হামলার শিকার হন। তার সঙ্গে ২৯ জন হামলার শিকার হয়েছিলেন। কেউ কেউ তাদের মধ্যে মারাও গেছেন। শরীরের বিভিন্ন অংশ দেখিয়ে বলেন এখনও সবই পোড়া আর ঝলসানো। মাথাও ঠিকমতো কাজ করে না। এই জীবনই বয়ে বেড়াতে হবে, বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। যশোরের রুবেল হোসেন বলেন, চট্টগ্রাম থেকে ট্রাক নিয়ে ঢাকায় আসার পথে একসঙ্গে চারজন দগ্ধ হয়েছিলেন তারা। এরমধ্যে তিনজনই মারা গেছেন। এখনও প্রতিমাসেই নিয়ম করে ডাক্তার দেখাতে হয় তাকে। কিন্তু ওষুধের টাকার যোগাড় করাও তার পক্ষে সম্ভব হয় না। এমন দুঃসহ জীবন দেখার জন্য তিনি বিএনপি-জামায়াতকে আগামী নির্বাচনে বর্জনের আহ্বান জানান। পৃথ্বিরাজ চক্রবর্তী ভয়াবহ সেই দিনের বর্ণনা দিয়ে বলেন, মৃত্যুকে একেবারে কাছ থেকে দেখেছি। এখনও ঘুমের মধ্যে সেই দুঃস্বপ্ন আমাকে তাড়া করে ফেরে। অনুষ্ঠানে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, বিএনপি-জামায়াতকে এই নির্বাচনে প্রতিহত করতে হবে। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সাঈদী ও সাকা চৌধুরীর ছেলের মনোনয়ন বৈধ করেছে। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও ইসির ভূমিকার সমালোচনা করে তিনি বলেন, রাজারকারপুত্ররা সংসদে এলে ভয়াবহ লজ্জার ঘটনা ঘটবে। ড. কামালের সমালোচনা করে তিনি বলেন, তার আইনজীবী সনদ কেড়ে নেয়া উচিত। তিনি এখন ‘খামোশ’ বলছেন। এক সময় বিপক্ষের আইনজীবীকে ‘বাস্টার্ড’ বলেছিলেন। আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, কোন সভ্য দেশে এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটতে পারে না। ভোটের মাধ্যমে এই অপশক্তিকে প্রতিহত করতে হবে।
×