ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হারুন উর রশীদ

ড. কামালের ‘খামোশ’ কাহিনী

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

ড. কামালের ‘খামোশ’ কাহিনী

প্রশ্নটি ছিল সাধারণ এবং প্রাসঙ্গিক। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে গিয়ে জামায়াত বিষয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন। ড. কামালের একই মালার ‘ফুল’ জামায়াতকে নিয়ে তার অবস্থান জানতে চেয়েছেন সাংবাদিকরা। আর তাতেই তিনি বাংলা ছেড়ে উর্দুতে হুঙ্কার ছাড়েন, ‘খামোশ’। ‘খামোশ’ শব্দটি মূল ফার্সি হলেও বহুল ব্যবহৃত হয় উর্দুতে। তবে তার এই উর্দু ভাষায় হুমকি কিন্তু আমার তেমন খারাপ লাগেনি। আমরা সাধারণ গড়পড়তা বাঙালী যেমন রেগে গেলে ইংরেজী বলি, তেমনি আইনজ্ঞ এবং সুশীল রাজনীতিক ড. কামাল রেগে গিয়ে উর্দু বলেছেন। জামায়াত আর পাকিস্তানকে আলাদা করে যেমন ভাবা যায় না। ড. কামালকে এখন জামায়াতের বাইরে ভাবা যায় না। তাই জামায়াত থেকে পাকিস্তান প্রেমে রাগের মাথায় উর্দুতে মুখ ফসকে বের হয়ে আসতেই পারেÑ ‘খামোশ’। তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। আর আপত্তি থেকেই বা কী হবে! এটা যার যার ব্যক্তিগত রুচির ব্যাপার। শুনেছি, তাদের নাকি পাকিস্তানে আত্মীয়তার সূত্রও আছে। এই খামোশ শব্দের মানে খুঁজতে আমি উর্দু ভাল জানেন এমন দু-একজনের সঙ্গে কথাও বলেছি। তারা আমাকে জানিয়েছেনÑ খামোশ শব্দটি সাধারণ অর্থে ‘চুপ কর’কে বুঝায় না। চুপ করিয়ে দেয়াকে বোঝায়। চুপ করতে হুমকি দেয়াকে বোঝায়। এখন আমার কাছে খামোশ শব্দের অর্থ আরও পরিষ্কার করে দিয়েছে ছোটবেলায় দেখা পোশাকি সিনেমা (রাজাদের কাহিনী নিয়ে চলচ্চিত্র)। আর সেখানে যারা খারাপ রাজা থাকতেন, তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ কেউ করলেই রাজা অগ্নিশর্মা গিয়ে বলতেন ‘খামোশ বেয়াদব, তোমার গর্দান আমি কেড়ে নেবো’। এই ধরনের রাজাদের ভূমিকায় তখন আমরা অভিনয় করতে দেখেছি- আহমেদ শরীফ ও আদিলের মতো খল নায়কদের। আরও কেউ হয়তো ছিলেন, এখন আর তাদের কথা মনে নেই। এবার খামোশ প্রসঙ্গ থামিয়ে ড. কামাল হোসেনের পুরো বক্তব্যটি সাংবাদিকের প্রশ্নসহ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। স্থান : মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ দিন : ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস-২০১৮, সকাল সাংবাদিক : জামায়াতের বিষয়ে আপনাদের অবস্থান কী? ড. কামাল : এখন না, এখন না। শহীদ মিনারে কোনও কথা না... সাংবাদিক : জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে.. তাদের সঙ্গে নির্বাচন... ড. কামাল : প্রশ্নই ওঠে না, প্রশ্নই ওঠে না। বেহুদা কথা। কত পয়সা পেয়েছো এই প্রশ্নগুলো করতে? কার কাছ থেকে পয়সা পেয়েছো? তোমার নাম কী? জেনে রাখব তোমাকে, চিনে রাখব। পয়সা পেয়ে শহীদ মিনারকে অশ্রদ্ধা কর তোমরা। শহীদদের কথা চিন্তা কর। হে হে হে করছো। চুপ কর। সাংবাদিক : শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যদের কথা যে, আপনারা জামায়াতের সঙ্গে... ড. কামাল : চুপ করো। চুপ করো। খামোশ। তোমার নাম কী?... চিনে রাখলাম... এবার এই কথোপকথন বিশ্লেষণ করলে অনেক কিছু স্পষ্ট হবে। এখানে তার বক্তব্যের দুটি দিক আছে। আমি পর্যায়ক্রমে দুটি দিকই তুলে ধরছি। ক. ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে জামায়াতের তালিকা অনুযায়ী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। এখন জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছে ঐক্যফ্রন্ট। এমনকি ড. কামালের গণফোরামও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছে। ফলে জামায়াত-বিএনপি-ড. কামাল একাকার হয়ে গেছে ধানের শীষে। তারা এখন একই আদর্শের সৈনিক। একই মালার একেকটি ফুল। খ. ড. কামাল হোসেনরা ঐক্যফ্রন্ট গড়ার শুরুতে বলেছিলেন জামায়াতকে বাদ দিয়ে বিএনপিকে ঐক্যফ্রন্টে আসতে হবে। জামায়াতকে কোনভাবেই ঐক্যফ্রন্টে নেয়া হবে না। গ. এখন দেখা যাচ্ছে, জামায়াতই ঐক্যফ্রন্টকে গ্রাস করেছে। বরং জামায়াতই এখন বলতে পারে ড. কামালকে ফ্রন্টে রাখা হবে কিনা। ঘ. আর এই পরিস্থিতিতে সাংবাদিক যখন ড. কামালকে জামায়াত নিয়ে প্রশ্ন করলেন, তখন তিনি আসলে কোন উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে দাঁড়িয়েও বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী জামায়াতের বিরুদ্ধে তিনি কোন কথা বলতে পারলেন না। কারণ, তিনি বড় লোভে পড়েছেন। উল্টো চটে গেলেন সাংবাদিকদের ওপর। ঙ. ড. কামাল এখন আর জামায়াতকে ছাড়তে পারবেন না। কারণ, এখানে ঢোকার পথ আছে। বের হওয়ার পথ নেই। তাই এখন যত দোষ সাংবাদিকদের। আসলে ড. কামাল এখন এক ধরনের ক্ষমতার ভাবের মধ্যে আছেন। মনে করছেন আর তো মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরই ক্ষমতায়। তাই কথার কোন লাগাম নেই। আমি মনে করি, নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা এবং স্বপ্ন যে কেউ দেখতে পারেন। কিন্তু সেই ক্ষমতা পেতে ড. কামাল এখন জামায়াতকেও ‘হালাল’ জ্ঞান করছেন। জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা, একাত্তরে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা তার কাছে এখন আর দোষের নয়। বুদ্ধিজীবী দিবসে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি আসলে তার ভেতরের আসল চেহারাটা প্রকাশ করে দিলেন। তাকে নিয়ে আর সংশয় থাকল না। হয়তো ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ড. কামাল হোসেন বাণী দেবেন, ‘আস্থা রাখুন জামায়াতে।’ সাংবাদিকরা কত টাকা খায় ড. কামাল? ছোটবেলা থেকে জেনে আসছি ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আইনজীবী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর। তারপর তাকে দেখেছি, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ‘গণআদালতে’। কিন্তু সেই ড. কামালকে আমি এখন আর মেলাতে পারছি না। হয়তো সেই কথাই সত্য, ‘বিধাতা যার পতন চান, তাকে পাগল করে দেন।’ সাংবাদিকদের নিয়ে আজ তিনি যে মন্তব্য করলেন, তাতে আমার মনে হয়েছে- তার স্বাভাবিক বিবেচনা ও বিবেকবোধ লোপ পেয়েছে। নিজের মধ্যে ক্ষমতা অনুভব করছেন। তিনি আর ড. কামাল হোসেন নেই। বাজারি কামালে পরিণত হয়েছেন। যেমন, বাজারি মানুষ না জেনেশুনেই বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্য করেন। সাংবাদিকদের গালাগাল করেন। মতের বিরুদ্ধে কিছু লিখলেই দালাল বলেন। সাংবাদিকরা কত টাকা খেয়েছে এটা জানতে ড. কামালকে প্রকাশ্যে এরকম অশোভন ও অভব্য প্রশ্ন করতে হবে কেন? তার মেয়েজামাই ডেভিড বার্গম্যানই তো সাংবাদিক। এতদিনেও কি তিনি মেয়েজামাইয়ের কাছ থেকে এই তথ্যটি জানতে পারেননি? তার মেয়েজামাইতো যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কাজ করেন। তাই বলে কেউ কি প্রশ্ন তুলেছেন যে, তার মেয়েজামাই যুদ্ধাপরাধীদের কাছ থেকে কত টাকা খেয়েছেন? তবে এখন একটি প্রশ্ন করতে চাই ড. কামালের কাছে- আপনি কি আপনার মেয়ের জামাইয়ের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জামায়াতের প্রেমে পড়েছেন? ড. কামাল হোসেন মূলত একটি পেশাকে অপমান করেছেন তার অশ্লীল প্রশ্নের মাধ্যমে। তিনি সাংবাদিকতা পেশাকে হেয় করেছেন। তার ঘরে যদি এরকম অসৎ সাংবাদিক থেকে থাকে, সেটা তার ব্যক্তিগত সমস্যা। তার পরিচিত যদি কোন অসৎ সাংবাদিক থেকে থাকে, তাহলে সেটা তার অভিজ্ঞতার সমস্যা। তাই বলে হঠাৎ করেই তিনি কোন সাংবাদিককে প্রশ্ন করতে পারেন না কত টাকা খেয়েছেন? তিনি যদি পারেন, তাহলে আমিও ড. কামালকে প্রশ্ন করতে পারি জামায়াতকে রক্ষার মিশনে নেমে আপনি কত টাকা ফি নিয়েছেন? আর ড. কামাল যে সাংবাদিকদের এই প্রশ্ন করেছেন, তারা তার চেয়ে অনেক কম বয়সী। আমি নিশ্চিত ড. কামালের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব বা লেনদেনের সম্পর্ক থাকার কথা নয়। হয়তো কাউকে ড. কামাল অতীতে দিয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু আপনার সেই সাংবাদিক বন্ধুকে দিয়ে সবাইকে মাপবেন কেন? আর এই তরুণ সাংবাদিকদের অপমান করার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে। আপনি তো একটি পেশাকে অপমান করতে পারেন না। শুক্রবার (১৪ ডিসেম্বর) মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ থেকে বের হওয়ার পথে ড. কামাল হোসেনের গাড়িবহরে হামলা হয়েছে। ড. কামাল অক্ষত থাকলেও তার অনুসারী কয়েকজন আহত হয়েছেন- এই খবরও সাংবাদিকরা সংবাদ মাধ্যমে বড় করে, ফলাও করে প্রচার করেছেন। এখন ড. কামালের কাছে আমার প্রশ্ন, আপনি আপনার গাড়িবহরে হামলার খবর প্রচার করতে সাংবাদিকদের টাকা দিয়েছেন? কত টাকা দিয়েছেন? পাদটীকা: জামায়াত বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের মাত্র দু’দিন আগে হত্যা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালী জাতিকে মেধাশূন্য করা। আর ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর সেই জামায়াতকে নিয়ে প্রশ্ন করায় ড. কামাল হোসেন সাংবাদিকদের নাম পরিচয় জেনে রাখার কথা বলেছেন। চিনে রাখার কথা বলেছেন। ড. কামাল, আপনার উদ্দেশ্য কী? লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×