ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাগরিক সংলাপে বক্তাদের অভিমত

জিডিপি প্রবৃদ্ধি মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছে না

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

জিডিপি প্রবৃদ্ধি মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছে না

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বর্তমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন হলেও তা মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারছে না। সেই সঙ্গে বাড়ছে ব্যাপক আয় বৈষম্যও। অন্যদিকে রাজনৈতিক দল গঠনের কোন বিধি বিধান না থাকায় যে যার মতো দল গঠন করছেন। এতে রাজনৈতিক দলগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে মানসম্মত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গুণগত মানসম্মত শিক্ষা, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং প্রতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার ওপর তাগিদ দিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। শনিবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে এলজিইডি মিলনায়তনে ‘মিডল ইনকাম উইথ কোয়ালিটি এ্যান্ড ডিগনিটি : সিভিক ডায়লগ এন এজেন্ডা ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক নাগরিক সংলাপে এ তাগিদ দেয়া হয়েছে। জাতীয় নির্বাপনকে সামনে রেখে পাওয়ার এ্যান্ড পার্টিশিপেশন রিসার্স সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার্স অব কমার্স বাংলাদেশ (্আইসিসিবি) যৌথভাবে এ সংলাপের আয়োজন করেছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে সংলাপে অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা প্রফেসর ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর এম.এ. তসলিম, সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, ঢাকা চেম্বার্স অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাসেম খান, আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান, মেট্রোপলিটন চেম্বার্স ও কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সাবেক সভাপতি নাসিম মঞ্জুর, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) গোলাম কাদের প্রমুখ। বক্তব্য রাখেন আইসিসিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট রোকেয়া আফজাল, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহিম, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ প্রমুখ। মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সাধারণত প্রবৃদ্ধি বাড়লে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় নিছু নেই। বর্তমানে দশমিক ৪৮ শতাংশ আয় বৈষম্য বিপজ্জনক অবস্থানের কাছাকাছি আছে। বিশ্বব্যাংকের সুশাসন ইনডেক্স নিচের দিকে আমরা আছি। এর মধ্যে দুর্নীতি, রাজনৈতিক সহিংসতা, রেগুলেটরি কোয়ালিটি সর্বনি¤œ অবস্থানে রয়েছে। এক্ষেত্রে নজর দিতে হবে। এছাড়া শুধু হাত থাকলে হবে না, তরুণদের দক্ষতা উন্নয়ন করে কাজে লাগানো জরুরী। বাজার উপযোগী শিক্ষায় নজর দিতে হবে। তফসিল জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, শ্রমিকদের মজুরি ইত্যাদি বিষয়গুলোর মধ্যে শুভঙ্করের ফাঁকির বিষয়টি তুলে ধরে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, উন্নয়ন দেখছি, কিন্তু সমতাভিত্তক উন্নয়ন দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে চলছে এক ধরনের বিক্রীত প্রণোদনা। তিনি বলেন, সমাজের একটি শ্রেণী অনেক উন্নত হচ্ছে, অপরটি নি¤œমুখী হচ্ছে। এজন্য স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা প্রয়োজন। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলেও মানসম্মত কর্মসংস্থানের প্রকট সঙ্কট রয়েছে। এর জন্য গভীর সংস্কার প্রয়োজন। তিনি বলেন, নির্বাচনী আয়োজনে দুধরনের পরীক্ষা রয়েছে। একটি হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য জনগণের ভোটের পরীক্ষা। অন্যটি হচ্ছে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা বা পরিচালনার পরীক্ষা। এ দুই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। বর্তমানে যে অবস্থায় অর্থনীতি চলছে তাতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে দিক পরিবর্তন করতে হবে। এ ছাড়া নাগরিক সক্রিয়তার অন্যতম উপাদান বজায় রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, অবকাঠামো খাতে যথেষ্ট বিনিয়োগ হলেও আউট কাম আসছে না। বরং চলাচলের গতি কমেছে, ধকল বাড়ছে। অর্থাৎ এখাতে বিনিয়োগ হচ্ছে ফলাফল হচ্ছে না। ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থমন্ত্রী কয়েকদিন আগে বললেন উন্নয়নের মহাসড়কে রয়েছে বাংলাদেশ, এসব কথা বাতুলতা মাত্র। কেননা মহাসড়কে যেতে হলে একটি ফিটনেস সম্পন্ন গাড়ি, একজন দক্ষ চালক এবং কিছু নীতি ও রেগুলশন দরকার। যার কোনটাই এখন বাংলাদেশে নেই। ফলে এসব কথা হলো বাতুলতা। আমাদের ড্রাইভার ঠিক করতে হবে, প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করতে হবে। আইন কানুন ঠিক করতে হবে। ব্যাংকিং খাতে যথেষ্ট আইন কানুন আছে, কিন্তু কত রকম যে ফাঁকি ও আছে তা বলা যায় না। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। বিভিন্ন খাতে বিকৃত প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও সুশাসন এক সঙ্গে চলতে হবে। ব্যাংকিং খাতে রকেট সাইন্স দরকার নেই। কারা করছে, কি করছে সবাই জানে। শুধু কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সাবেক নির্বাচন কমিশনার বি: জে: (অব) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন কমিশন এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারছে না। এ প্রতিষ্ঠানটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতায় ভুগছে। ক’দিন আগে সিইসি বলেছেন তিনি মর্মাহত এবং বিব্রত। এমন কথা আমি আগে কখনও শুনিনি। এখানকার প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থা শক্তিশালী নয়। এ জায়গাটা দুর্বল। রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে চলছে, ইসিও সেভাবে চলছে। ফলে নির্বাচনের পরিবেশ এখন পর্যন্ত ভাল আছে। কিন্তু দুদিন পর তা থাকবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। নির্বাচনটাই বা কি হবে সেটাও আমরা বলতে পারি। অথচ নেপাল, ভুটানের মতো দুর্বল ছোট দেশগুলোর নির্বাচন কমিশনও অনেক বেশি কার্যকর। আর ভারতের নির্বাচনসহ অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো আরও বেশি কার্যকর এবং শক্তিশালী। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি ঠিক না থাকে তাহলে ৭ দশমিক ৮ শতাংশের প্রবৃদ্ধি কোন কাজে আসবে না। তিনি আরও বলেন এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর চলে বেসরকারী খাতের মতো। সংবিধানেও রাজনৈতিক দল নিয়ে তেমন কিছু বলা নেই। ফলে অংসখ্য রাজনৈতিক দল গড়ে উঠছে। পলিটিক্যাল ইনস্টিটিউশন বলে কোন কিছু গড়ে উঠছে না। এতে রাজনৈতিক অবস্থা পিছিয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পিছিয়ে রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করলে লাভ হবে না। ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, নির্বাচন জনগণের চোখে অবশ্যই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়া প্রয়োজন। যা নির্বাচিত সরকারকে বৈধতা দেবে। দ্রুত প্রবৃদ্ধির জন্য বৈষম্য অবধারিত নয়। সুশাসন ও উন্নয়নে সমীকরণের পরিবর্তন দরকার। কেননা মধ্যবিত্ত শ্রেণী বাড়ছে। নতুন আকাক্সক্ষা বাড়ছে। কম খরচে বেশি সুবিধা পাওয়া সুয়োগ কমে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে যা স্বাধীনতা চেতনার পরিপন্থী। আবুল কাশেম খান বলেন, ডুয়িং বিজনেস এর খরচ অনেক বেশি। বিদ্যুত প্রাপ্তিতে সমস্যা, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। তাছাড়া আমলাদের মানুষিকতার পরিবর্তন দরকার। নাসিম মঞ্জুর বলেন, এখন আবার শুনছি ব্যাংক ঋণের সুদ হার বাড়ানো হবে। এটা ঠিক হবে না। জমির সমস্যাতো রয়েছেই। তাছাড়া কর ব্যবস্থার সংস্কার জরুরী। আবদুল মজিদ বলেন, সরকার রাষ্ট্রকে অধিগ্রহণ করে ফেলেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যে কারণে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। তাছাড়া জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ হতে পারত। কিন্তু জিডিপির আড়াই থেকে তিন শতাংশ লোপাট হয় যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতা রয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এখন আর কেউ শিক্ষার্থী নেই, সবাই পরীক্ষার্থী। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে।
×