ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানওয়ালী কারাগার ॥ বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও অতঃপর...

প্রকাশিত: ০৭:৫৮, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

মিয়ানওয়ালী কারাগার ॥ বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও অতঃপর...

দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মহুতির মধ্যে দিয়ে এ দেশের মানুষ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করেছে সত্য। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ছিল উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা; কেননা তখনও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য বাংলার ঘরে ঘরে রোজা রাখা ও বিশেষ দোয়ার আয়োজন চলছিল। বাঙালীর কাছে বঙ্গবন্ধুবিহীন বিজয় অপূর্ণ। অবশেষে বাঙালী পরিপূর্ণ বিজয়ের স্বাদ অর্জন করে সেদিন যেদিন ১৯৭২-এর ১০ই জানুয়ারি বুক ভরা আনন্দ আর স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। আপনারা জানেন বঙ্গবন্ধুকে ২৬ মার্চ প্রত্যুষে ১.২০ মিনিটের সময় ধানম-ির ৩২নং বাড়ি থেকে আটক করার পর পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী কারাগারে নির্জন প্রকোষ্ঠে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়। আর সেই কারাগারের প্রিজন ছিলেন গবর্নর হাবীব আলী। মিয়ানওয়ালী কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে বঙ্গবন্ধুর ৯ মাস ১৪ দিনের কঠিন কারাজীবন, এবং অতঃপর মুক্তি প্রসঙ্গে প্রিজন গবর্নর হাবীব আলীর স্মৃতিচারণের ওপর ভিত্তি করে আজকের নিবন্ধের অবতারণা। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ১০ দিন পর ২৬ ডিসেম্বর রাতে মুজিবকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ায় উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশের পরপরই প্রিজন হাবীব আলী একটি ট্রাক নিয়ে মিয়ানওয়ালী কারাগারে যান। কারাফটক খুলে দেখে বঙ্গবন্ধু মুজিব সেলের ভেতর একটি কম্বল জড়িয়ে বিছানার ওপর ঢুুলছেন। কয়েদিরা মুজিবকে ফিসফিস করে বলল ‘ওরা এসেছে’। মুজিবও কয়েদিদের বলল ‘শেষ পর্যন্ত আমি মাথানত করব না’। কয়েদিরা মুজিবকে আরও বলল ‘যদি আজকে আপনি বের হন তারা আপনাকে মেরে প্রকোষ্ঠের সামনে খননকৃত গর্তে কবর দিয়ে দিবে।’ মুজিব প্রিজন হাবীব আলীসহ কয়েদিদের উদ্দেশ্য করে বললেন ‘কবরকে আমি ভয় পাই না। আমি জানি ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে’ (কেননা অক্টোবর মাসে সামরিক আদালতে আমার ফাঁসির আদেশ হয়েছে)। কিন্তু আমি জানি আমার বাংলাদেশ একদিন স্বাধীন হবে। আমি এও জানি যে বাংলার দামাল ছেলেরা হাসি মুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে, সেই বাঙালী জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। শুধু মিনতি করে প্রিজন হাবীব আলীকে বলেন, ‘আমাকে হত্যা করে এ কবরে না, এ লাশটি আমার বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও। যে বাংলার আলো বাতাসে আমি বর্ধিত হয়েছি। সে বাংলার মাটিতে আমি চিরনিদ্রায় শায়িত থাকতে চাই’। ১৯৭১ সালর ১৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পর ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন এবং ২৬/১২/১৯৭১ইং ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব ভারগ্রহণ করেন। ক্ষমতা হস্তান্তরকালে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর কাছে প্রার্থনা করেন যে, ‘আমার ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে শেখ মুজিবকে হত্যা করার অনুমতি দাও। আমার জীবনে যদি কোন ভুল করে থাকি তাহলে শেখ মুজিবকে ফাঁসির কাষ্ঠে না ঝোলানো।’ তখন প্রেসিডেন্ট ভুট্টো প্রিজন হাবীব আলীর কাছে এ মর্মে জরুরী বার্তা পাঠান ‘যেন শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে দ্রুত নিরাপদ কোন স্থানে সরিয়ে ফেলা হয়।’ যথারীতি প্রিজন হাবীব আলী ট্রাক নিয়ে কারা ফটকে আসে এবং সেলের মধ্যে গিয়ে মুজিবকে তার সঙ্গে যেতে অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধু মুজিব প্রথমে বাঁধা দেন। প্রিজন হাবীব আলী তখন বলেন ‘শেখ, আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্খী, বন্ধু। উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমি আপনাকে নিরাপদস্থানে নিয়ে যেতে এসেছি। কারণ এখানে কমান্ডো আসতে পারে। তারা আপনাকে হত্যা করবে। আমার ওপর আপনি আস্থা রাখুন।’ অতঃপর বঙ্গবন্ধু মুজিবকে ট্রাকে তুলে, ট্রাকের মধ্যে লুকিয়ে প্রিজন হাবীব আলী তার চশমা ব্যারাজ নামক বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে বঙ্গবন্ধু মুজিব তার স্ত্রীর কাছে টেলিফোন করার ইচ্ছা পোষণ করলে প্রিজন হাবীব আলী বলেন, ‘এটা সম্ভব নয়, আমার একমাত্র কাজ আপনার জীবন রক্ষা করা।’ তখন মুজিব বলেন ‘আমি কি খবরের কাগজ পড়তে পারি’। প্রিজন হাবীব আলীর উত্তর ছিল, ‘না’। এরপর মুজিব বলেন ‘আমি কি এক কাপ চা পেতে পারি ?’ তখন বঙ্গবন্ধুকে এক কাপ চা দেয়া হয়। এ বাড়িতে বঙ্গবন্ধু ২ দিন অবস্থান করেন। ২ দিন পর প্রিজন হাবীব আলী বঙ্গবন্ধু মুজিবকে নিয়ে এক সময়কার ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর শাহুল্যা নামকস্থানে অবস্থিত একটি রেস্ট হাউসে নিয়ে যান। রাওয়ালপিন্ডি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে এই শাহুল্যাতে প্রেসিডেন্ট ভুট্টো মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসেন। শুরুতেই ভুট্টো বলেন, ঘড়ি ও ধস ঃযব চৎবংরফবহঃ ড়ভ চধশরংঃধহ ধহফ ঈযরবভ গধৎঃরধষ খধি অফসরহরংঃৎধঃড়ৎ”। তারপর মুজিব বলেন, গৎ. ইযড়ঃঃড়, ঞবষষ সব ভরৎংঃ, যিধঃবাবৎ ও ধস ধ ভৎববসধহ ড়ৎ ঢ়ৎরংড়হবৎ?” উত্তরে ভুট্টো বলেন, ঘবরঃযবৎ ুড়ঁ ধৎব ধ ঢ়ৎরংড়হবৎ, হড়ৎ ুড়ঁ ধৎব ধ ভৎববসধহ” তখন মুজিব বললেন, ওহ ঃযধঃ পধংব ও রিষষ হড়ঃ ঃধষশ ঃড় ুড়ঁ” তখন ভুট্টো বাধ্য হয়ে বললেন ণড়ঁ ধৎব ধ ভৎববসধহ” এরপর দু’জনের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়। ভুট্টো অনেক রকম প্রস্তাব দিলেন- ‘যেমন কীভাবে একসঙ্গে থাকা যায়, কীভাবে একটা কনফেডারেশন করা যায়’। বঙ্গবন্ধু মুজিব চুপ থেকে শুধু বললেন ‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আমার প্রিয় সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে না পারব, ততক্ষণ আমার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভবপর নয়’। এরপর মুজিবকে একটা যৌথ ইশতেহার দেয়া হয়েছিল স্বাক্ষর করার জন্য। বঙ্গবন্ধু মুজিব সেটাও প্রত্যাখ্যান করেন। শেষে মুজিব বললেন, আমি কি এখন দেশে যেতে পারি ? ভুট্টো বললেন, ‘হ্যাঁ, যেতে পারেন। কিন্তু কিভাবে যাবেন ? ‘পাকিস্তানের চওঅ ভারতের ওপর দিয়ে যায় না’। তখন মুজিব বললেন, ‘সেক্ষেত্রে আমি লন্ডন হয়ে যাব’। এরপর ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি পেয়ে চওঅ এর একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। লন্ডনে পৌঁছে বঙ্গবন্ধু বিবিসি’র বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান সাংবাদিক সিরাজুর রহমানের কাছ থেকে জানতে পারেন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে সকল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন দানের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। অতঃপর তিনি লন্ডন থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা। যাত্রা বিরতিতে তিনি দিল্লীতে শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধীর কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামে অকুণ্ঠ সমর্থন ও ১ কোটির বেশি শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানান এবং এ ও জানতে চান কবে নাগাদ ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা হবে। জবাবে ইন্ধিরা গান্ধী বলেন, স্বাধীন দেশে আপনার জন্মদিন পালনের পূর্বে অর্থাৎ ১৭/০৩/১৯৭১ইং সব ভারতীয় সৈন্য চলে আসবে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ ও একটি বিরল দৃষ্টান্ত। মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্ত ঝরা দিনগুলোতে দেশ মাতৃকার সংগ্রামে সমস্ত জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণে সফল জনযুদ্ধের মাধ্যমে সুমহান বিজয় অর্জন করেছে। আর এখানেই নিহিত আছে বঙ্গবন্ধুর মুজিবের ঐতিহাসিক সাফল্য। স্বাধীনতার ডাক দিয়ে একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রুপান্তর করেছিলেন। প্রিজন হাবীব আলী স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্যে যথার্থই বলেছেন, ‘বাঙালীরা মহা সৌভাগ্যবান যে শেখ মুজিবের মতো একজন নেতা পেয়েছে’। অথচ ভাবতে অবাক লাগে, যে পাকিস্তানের কারাগার বঙ্গবন্ধুকে আটকে রাখতে পারেনি, মৃত্যুদ- দিয়েও কার্যকর করতে পারেনি, অথচ তার স্বপ্নের স্বাধীন দেশে সাড়ে ৩ বৎসরের মাথায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট নিজ বাসভবনে স্বপরিবারে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ‘বিজয়ের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী; আর পরাজয়ের গ্লানি দীর্ঘস্থায়ী’। বাঙালী জাতিকে আজীবন এ গ্লানি বহন করে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী চারটি দশকে পারস্পরিক হানাহানি ও সহিংসতা এবং সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অনুপস্থিতে এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকা- অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবুও আমাদের অর্জন ও সাফল্য কম নয়। ঘাত ও প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান যেখানে ৫৮তম ছিল আর সেটি ২০১৭ সালে হয় ৪২তম। আশা করি ২০২১ সালে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে মধ্যম আয়ের দেশ, ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ এবং ২০৩০ সালে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে ২০৪১ সালে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের কাতারে সামিল হবে- ইনশাআল্লাহ্। বিশ্বায়নের এ যুগে সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামের বিজয় সুনিশ্চিত করতে হলে পরমুখাপেক্ষিতা বাদ দিয়ে সর্বক্ষেত্রে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর নীতিগ্রহণ করতে হবে। দেশের মাটিতে দু’পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে দেশের পতাকাকে উর্ধাকাশে তুলে ধরে বলতে হবে-ওই পতাকাতে যেমন বাংলাদেশের শ্যামলিমা আছে তেমনি এতে শহীদের রক্ত লেগে আছে। এর অমর্যাদা আমরা কোনদিন হতে দিতে পারি না- এ হোক আমাদের বিজয় দিবসের অঙ্গীকার।ারা বহু ত্যাগের বিনিময়ে দেশের বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল তাদের সবাইকে জানাই সকৃতজ্ঞ অভিনন্দন ও সালাম।
×