ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ এখন একটি নতুন গল্প -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৮:২৩, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশ এখন একটি নতুন গল্প -স্বদেশ রায়

বাংলা সিনেমা দেখতে দেখতে বা বাংলা উপন্যাস পড়তে পড়তে এক সময়ে খুব টায়ার্ড হয়ে যেতাম। শুধু দারিদ্র্য আর দারিদ্র্যের ছবি। আবার সত্য হলো ওইগুলোতে আমরা বা সকলে অভ্যস্ত ছিলাম। দুঃখ দারিদ্র্যের ছবি আঁকাই যেন ছিল আমাদের সাহিত্য। নিখুঁত দারিদ্র্যের ছবি আঁকতে পারলেই একটা সেরা সাহিত্য হতো। সেটাকে পর্দায় আরও নিখুঁতভাবে তুলে আনতে পারলে সেরা ছায়াছবি। পরে আবার ভেবেছি, আমাদের সাহিত্যিকদের, চলচ্চিত্রকারদের এর থেকে কী বা আর করার আছে! দেশের মানুষের কাছে পরিচিত তো দারিদ্র্য, সেই ছবিই তো আঁকতে হবে তাদের। রবীন্দ্রনাথ যে সময়ে গোরা বা শেষের কবিতা লিখেছেন ওই সময়ের বাংলাদেশে ক’জন মানুষ ছিল গোরা বা শেষের কবিতার কুশীলবদের শ্রেণীর! খুবই কম। হাতেগোনা কয়েকজন। সবই তো দারিদ্র্য দিয়ে ভরা। এখান থেকে যে বাংলাদেশ ও বাঙালী মুক্তি পাবে এই ভাবনাও খুব মানুষের ভেতর ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের ভেতর দিয়ে একটি স্বপ্ন মানুষের কাছে এসেছিল। তাও কেন যেন সীমাবদ্ধ ছিল। তার দিগন্ত খুব বেশি প্রসারিত ছিল না। সকলে কেমন যেন মনে করেছিল, আমরা পাটের দাম পাব। আমাদের দেশের সম্পদ আমাদের থাকবে। এর বেশি কিছু নয়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সোনার বাংলা হবে। কিন্তু মানুষ তখন এত দরিদ্র ছিল যে সোনার বাংলার দিগন্ত রেখা কতদূর বিস্তৃত তা কল্পনা করতে পারত না। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষ ও সমাজকে চিনতেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল ধীরে ধীরে মানুষকে তার সোনালী স্বপ্নের কাছে নিয়ে যাওয়া। সেখানেও বঙ্গবন্ধু বাধা পেলেন। তিনি প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করতে গেলেন নামী-দামী অর্থনীতিবিদদের নিয়ে। তারা অনেকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বুঝতে পারলেন না। অনেকে পরিকল্পনা কমিশন ছেড়ে চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধু নিজেই দেখালেন স্বপ্ন। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা করলেন। তার পরিণতিতে তাকে জীবন দিতে হলো। বাঙালী ও বাংলাদেশ আবার স্বপ্ন দেখা থেকে সরে গেল। আবার ফিরে এলো বাংলা সিনেমা ও উপন্যাসের সেই বাস্তবতা। স্বপ্নহীন একটি দরিদ্র জনগোষ্ঠী। যেখানে ঘোর বর্ষাকালে একভাবে ঝরা বৃষ্টির শব্দ, কাদা পানি ভরা পায়ে চলা পথ আর তার পাশে মাটির ঘরে উপবাসী মুখ। বাংলা সিনেমার এই মুখ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ তার চারপাশে দেখেছে। মাত্র কয়েক দিন হলো রাস্তায় জ্যামে বসে বসে ইউটিউবে একটি পুরনো দিনের বাংলা সিনেমা দেখছিলাম। সেখানে সেই দারিদ্র্যের গল্প। আর দারিদ্র্যের ভেতর মহত্ত্ব খুঁজে সান্ত¦না পাবার চেষ্টা। অর্ধেকের বেশি ছবি জ্যামে বসে বসে দেখলাম। এই ছবি দেখা ও রাস্তার জ্যাম মিলে দুটো বিষয় মনে এলো। প্রথমেই শুধু শহরের চারপাশ, শহরতলি নয়, দেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোর কথা মনে পড়ল। না কোথাও সেই ছায়াছবিটির মানুষ ও পরিবেশ নেই। কোথাও নেই ওই থম থমে দারিদ্র্য। বরং সব খানে একটা চঞ্চলতা। এখন আর খাবারের দোকানের সামনে করুণ দৃষ্টিতে কোন বালক বা বালিকা চেয়ে থাকে না। বরং গ্রামের রাস্তায় বালিকারা স্কুলের ড্রেস পরে এক হাতে আইসক্রিম নিয়ে অপর হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে প্যাডল করতে করতে চলেছে। আর প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে যেন একটি করে খামার, সেখানে গরু দুধ দিচ্ছে, মুরগি ডিম পাড়ছে, ঈদ এলে বিক্রি করার জন্য তৈরি করা হচ্ছে ষাঁড় বা বলদ। সকলের হিসাবে এখন লাখ লাখ টাকা। আর ঢাকার রাস্তার জ্যাম। না, এই জ্যাম আমাকে কষ্ট দেয় না। কারণ, এই জ্যাম আশি বা নব্বইয়ের দশকে, থাইল্যান্ডে, মালয়েশিয়ায় দেখেছি। আর তার থেকে বুঝেছি, এটা ডেভেলপমেন্টের পেইন। কোন দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করছে তার একটি ইন্ডিকেশন হচ্ছে এই রাস্তার জ্যাম। ঢাকার এই জ্যাম থাকবে না। কারণ, ঢাকা নতুন করে গল্প লিখতে যাচ্ছে। ঢাকা আগামী দশ বছরের মধ্যে একটি নতুন রূপ নেবে। ফ্লাইওভার, মেট্রো রেল, উপশহরগুলোর সঙ্গে শাটল ট্রেন, রাউন্ডআপ ট্রেন, এক্সপ্রেস এলিভেটর ইত্যাদির মাধ্যমে পৃথিবীর একটি আধুনিকতম শহর হতে চলেছে। অন্যদিকে গ্রাম, না, বাংলা সিনেমার সেই বর্ষাক্লান্ত গ্রাম, রবীন্দ্রনাথের সেই পোস্ট মাস্টারের উলিপুর গ্রাম এখন আর বাংলাদেশে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। গত দশ বছরেই গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে নাগরিক সুবিধা। গ্রামে এখন প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুতের আলো। আর ফ্রিজ, টিভি সবই এখন তাদের নিত্য সামগ্রীর মধ্যে চলে গেছে। দেশী তৈরি ফ্রিজ কিনছে মাত্র দুই হাজার টাকা কিস্তিতে। ছেলেমেয়েরা ল্যাপটপ কিনছে দুই হাজার টাকার কিস্তিতে। বাংলাদেশের মতো কম দামে শার্ট, প্যান্ট, জুতো পৃথিবীর কোথাও মেলে না। হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামের লুঙ্গি পরা মানুষগুলো। এখন ক্ষেতে কাজ করেও থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে। আর ক্ষেতে কাজ করার জন্য লোক পেতে হলে অন্তত সাত দিন আগে তাকে বুক করতে হয়। আট ঘণ্টার বেশি কেউ কাজ করে না। তাতেই কম করে হলেও সাত শ’ টাকা রোজগার। এক সময়ে এই বাংলাদেশে ক্ষেতমজুর ও শ্রমিকের মজুরি যাতে দিনে সাড়ে তিন কেজি চালের দামের সমান হয় সেটাই ছিল ক্ষেতমজুর বা শ্রমিক আন্দোলনের বামপন্থী নেতাদের স্লোগান। তারা বলতেন, তারা ক্ষমতায় গেলে এটা বাস্তবায়ন করবেন। এখন একজন ক্ষেত মজুর একদিন কাজ করে সাড়ে সতেরো কেজি সরু চাল কিনতে পারে। মোটা চাল কিনতে পারে বিশ কেজির বেশি। পার্শ্ববর্তী বড় দেশ ভারতে এটা এখনও স্বপ্নের বিষয় এটি। অন্যদিকে তৃতীয় বিশ্বের আরেকটি বিষয় দুর্নীতি। বাংলাদেশ এ মুহূর্তে যে দুর্নীতিমুক্ত তা কেউ বলবে না। তবে মাত্র একটি উদাহরণ থেকে একটা ধারনা নেয়া যেতে পারে যে উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতির সে চিত্রও বদলে যাচ্ছে। যেমন দেশের রাজধানী ঢাকা শহরের পরিবহনের চিত্র বদলে দিয়েছে, উবার, পাঠাও, ও ভাই, ইত্যাদি এ্যাপসভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থার মাধ্যমে। এখান থেকে বারো বছর আগে এ ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা রাজধানীতে নামাতে হলে প্রতিটি কোম্পানিকে কমিশনের টাকা বা ঘুষের টাকা গুনতে হতো সরকারপ্রধানের ছেলের অফিস হাওয়া ভবনে। আর এখন বাংলাদেশের রাজধানীতে এই এ্যাপসভিত্তিক পরিবহনগুলো দাপটে ছুটে বেড়াচ্ছে, ব্যবসা করছে অথচ তাদের অনুমোদন নিতে সরকারের কোন ব্যক্তিকে কোন ঘুষ দিতে হয়নি। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে একি একটি নতুন গল্প শুরু নয়? এ তো গেল দেশের ভেতরের গল্প, বাইরেও আজ বাংলাদেশের গল্প সবখানে শোনা যায়। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গেলে দেখা যায় বাংলাদেশের দারিদ্র্য জয়ের গল্প সেখানে কত বড় ভাবে স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশের কিছু কুচক্রী মহলের প্ররোচনায় পড়ে বাংলাদেশের বড় স্থাপত্য পদ্মা সেতু নির্মাণ থেকে ঋণ প্রত্যাহার করেছিল ওয়াল্ড ব্যাংক। দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল। কানাডার কোর্টে প্রমাণিত হয়েছে কোন দুর্নীতি হয়নি। আর এই নতুন যুগের গল্প এখানেই শেষ নয়, সেই বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখতে এসেছেন বিশ্বব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং একজন সাংবাদিক হিসেবে আনন্দ পেয়েছি ওই ছবি দেখে যে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান দেখা করতে গেছেন অর্থমন্ত্রীর সচিবালয়ের রুমে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের অধিবেশন থেকে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে শুষ্ক মুখ ও অপমান মাথায় নিয়ে বের হয়ে এসেছিলাম যেদিন পদ্মা সেতুর ঋণ সাসপেন্ড করে সেদিন। শুধু এখানেই শেষ নয়, পদ্মা সেতু আজ বাংলাদেশে বাস্তবতা। পাশাপাশি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বলছে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। আবার সমাজকল্যাণ অর্থনীতির মহীরুহ অর্মত্য সেনের মতে সমাজ কল্যাণের অর্থনীতিতে ভাল করছে এ মুহূর্তে এ উদাহরণ টানতে গেলে প্রথমে আসে বাংলাদেশের নাম। আমরা পুরনো দিনের বাংলা সিনেমায় দেখেছি, সন্তান জন্ম দিয়েই অধিকাংশ মা মারা যাচ্ছে। আশির দশকের জনপ্রিয় বাংলা ছায়াছবি ‘সুজন সখী’, যার নায়ক ফারুক এবারের নির্বাচনে একজন প্রার্থী। ওই সুজন সখী ছায়াছবির গল্পে দেখা যায় সখীর জন্ম দিতে গিয়ে তার মা মারা যায়। বাস্তবে আশির দশকে, নব্বইয়ের দশকে এ ছিল বাংলাদেশের একটি স্বাভাবিক চিত্র। আর সেখানে মাতৃ মুত্যুর হার দক্ষিণ এশিয়ায় সব থেকে কম বাংলাদেশে। এটা শুধু বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বলে না অর্মত্য সেনের লেখায়ও দেখা যাচ্ছে। এখন মা ছাড়া সখী খুবই কম গ্রাম বাংলায়। আর আগের সুজন, সখীরা যেখানে নৌকায় যেত এখন সেখানে পাকা রাস্তায় বাস চলছে, অটো রিক্সা চলছে আর সুজন সখীরা চলছে তীব্র গতির ২৮০ হর্স পাওয়ারের স্কুটারে। বিশ্বের সব থেকে প্রেস্টিজিয়াস অর্থনীতির কাগজ দি ইকোনমিস্টে সারণি করে ছাপা হয় বিশ্বের সেরা দশ জিডিপির দেশের তালিকা। তার দ্বিতীয় নম্বরে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ১৪৮০ মার্কিন ডলার। ইকোনমিস্টের মতে জিডিপি ৭.৭ আর বাংলাদেশের পরিসংখ্যান মতে ৭.৮। দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী বছর জিডিপি পৌঁছাবে ডাবল ডিজিটে অর্থাৎ ১০ এ। এখন বাংলাদেশের বাজেট ৫ লাখ কোটি টাকার। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুুল মুহিত বলেছেন আগামী অর্থবছরে বাজেট হবে ১০ লাখ কোটি টাকার। পাকিস্তান বলছে তাদের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে বাংলাদেশকে অনুকরণ করতে হবে। অন্যদিকে সাউথ ইস্ট এশিয়ার অর্থনীতির নতুন টাইগারগুলো বলছে, তাদের এখন হাত ধরতে হবে বাংলাদেশের। বঙ্গোপসাগরের অধিকারী এই দেশটি দুই প্রতিবেশী চীন ও ভারতের মাঝখানে সব থেকে সুবিধাজনক অর্থনীতিতে রয়েছে তা ভারত, আমেরিকা, ব্রিটেনের মিডিয়া নানা সময় প্রকাশ করে। এখন আর বাংলাদেশ কোন দারিদ্র্যের গল্প নয়, কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের গল্প নয়, বাংলাদেশ একটি উন্নয়নের গল্প। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভবিষ্যতে বহু উত্থান পতন হবে, তবে এই যে উন্নয়নের গল্প লেখা হচ্ছে বাংলাদেশে এর বুনিয়াদ তৈরি করে দিলেন বাংলাদেশের নেতা শেখ হাসিনা। আর এ উন্নয়নের গল্প বঙ্গোপসাগরের কূলে এই ছোট বদ্বীপ রাষ্ট্রটিতে লেখা সম্ভব হচ্ছে এ জন্যই যে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় লাভ করেছিলাম বলেই। এই উন্নয়নের গল্পের শিরায় শিরায় আছে আমাদের ৩০ লাখ শহীদের রক্ত। এর মুখে, চোখের মণিতে আছে সাড়ে ছয় লাখ মা বোনের আব্রু দান আর এক কোটি শরণার্থীর নয় মাসের দুর্বিষহ জীবনযাপনের কষ্ট। আছে শত্রু কবলিত দেশের ভেতর কোটি মানুষের পলাতক জীবনযাপনের সেই দুঃসহ দিন। তাই প্রতি বিজয় দিবসে আমরা স্মরণ করব এই সকল আত্মত্যাগ আর আমাদের স্বাধীনতার নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। পাশাপাশি একটি স্বাধীন দেশ যে দারিদ্র্যের গল্প ঝেড়ে ফেলে সমৃদ্ধির গল্প লিখতে পারে তার জন্য বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করার পরে আমরা গর্ব করব উন্নত বাংলাদেশের নেতা শেখ হাসিনাকে নিয়ে। তিনিও ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন বাঙালীর জীবনের সেই হাজার বছরের দুঃখের রাতের বদলে সমৃদ্ধির দিনের গল্প এনে দেয়ার জন্য।
×