ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এটিএম শামসুজ্জামান

ঘুরে এলাম একাত্তরের স্মৃতি বিজড়িত ভারত

প্রকাশিত: ০৮:২৫, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

ঘুরে এলাম একাত্তরের স্মৃতি বিজড়িত ভারত

অনেকদিন থেকেই মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল ভারতে যেয়ে পুরনো সেই সব স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো দেখে আসার কিন্তু নানাবিধ বাস্তব কারণে তা আর সম্ভব হচ্ছিল না। অবশেষে হঠাৎ সিদ্ধান্তটা নিয়ে নিলাম। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে যাত্রার দিনও স্থির করলাম। দীর্ঘ ৪৭ বছর পর আবার স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো দেখতে পাব বলে বেশ পুলকিত বোধ করছিলাম। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের কারণে ভারতে গিয়েছিলাম তিনবার। প্রথমবার মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্য প্রশিক্ষণের জন্য, দ্বিতীয়বার অপারেশন শেষে রিপোর্ট জমা দেয়ার জন্য আর তৃতীয়বার রাস্তা তখন আমরা নখদর্পণে। অল্প বয়স্ক বালক হওয়া সত্ত্বেও শেষবার আমিই যশোর এবং ফরিদপুরে বিরাট এক মুক্তিযোদ্ধা দলকে পথ চিনিয়ে ভারত থেকে এসেছিলাম। বেনাপোল, বয়রা, কল্যাণী, পেট্রোপোল, চাকুলিয়া ইত্যাদি নামগুলো মনে স্থায়ী আসন গেঁড়ে বসে আছে। ইচ্ছা হলেই তো আর পাখির মতো উড়ে যাওয়া যায় না আর তাই তো এতকাল অপেক্ষায় থাকতে হলো। অবশেষে দেখতে যেতে পারলাম নবগাঁ আর কল্যাণী। ধন্য আশা কুহকিনী! আশা এবং ইচ্ছা ছিল বলেই এত দীর্ঘদিন পরে হোলেও শেষ পর্যন্ত যেতে সক্ষম হলাম স্মৃতি বিজড়িত পুরনো শহর দুটিতে। খবরের কাগজের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম যে ভারতীয় দূতাবাস মুক্তিযোদ্ধাদের পাঁচ বছরের জন্য ভিসা দিচ্ছে। যথাযথ প্রক্রিয়ায় ভিসার জন্য আবেদন করে পাসপোর্ট হাতে পাবার পর কিছুটা হতাশ হলাম কারণ ভিসা দেয়া হয়েছে মাত্র এক বছরের। গড়িমসির কারণে ভিসা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতে যাওয়া সম্ভব হলো না; একদিন দুইদিন করে যেতে যেতে ভিসার মেয়াদই প্রায় শেষ হওয়ার জোগাড় হলো। অবশেষে তড়িঘড়ি করে সিদ্ধান্ত নিতে হোল ভারতে যাবার। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আমার এক খালাত বড় ভাইকে সঙ্গে নিতে চাইলাম। টুপি দাড়ির কারণে একা যেতে ভরসা পাচ্ছিলাম না কারণ টুপি দাড়িওয়ালারা এখন সারাবিশ্বেই সন্দেহের পাত্র, তার ওপর ভারত তো মুসলমানদের জন্য আরও ভয়ঙ্কর এক স্থান; সামান্য ছল ছুতাতেই এখন ভারতে মুসলমানদের হত্যা করা হচ্ছে, ভয় হচ্ছিল সেজন্যই তবে কিছুটা ভরসাও পাচ্ছিলাম সাদা দাড়িতে। দুইজন একত্রে থাকলে ভয়ের মাত্রা কিছুটা কমে, সে জন্যই বড় ভাইকে সঙ্গী হতে আহ্বান জানিয়েছিলাম, নানা কারণে তিনি এখন যেতে রাজি হলেন না। আমার পক্ষে আর দেরি করা সম্ভব ছিল না ভিসার মেয়াদের কারণে। অবশেষে একাই যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে যাত্রা করার প্রস্তুতি নিয়ে যাত্রা করার প্রস্তুতি শুরু করলাম। ভিসা আগেই করা ছিল কাজেই এসব ঝামেলা ছিল না আর বিমানের টিকিট জোগাড় করা আমার জন্য সমস্যা ছিল না। কাজেই দ্রুত রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে মাসের প্রথম দিনেই সকালের বিমানে উঠে পড়লাম। সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই কলকাতা পৌঁছে গেলাম। হোটেলে ব্যাগ-বোঁচকা রেখে কি করব সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না, ঐদিনই যাব অথবা পরদিন, কল্যাণী না বনগাঁ ইত্যাদি নানা চিন্তা, দ্বিধাদ্বন্দ্ব মনে ঘুরপাক খেতে শুরু করে দিল। কল্যাণীতে শুধু একটা স্থান দ্রষ্টব্য বনগাঁতে একাধিক, কাজেই নবগাঁতে সময় বেশি লাগবে চিন্তা করে কল্যাণীতে প্রথমে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে শিয়ালদা স্টেশনের দিকে রওনা হলাম। হোটেল থেকে হলুদ ট্যাক্সিতে চড়ে শিয়ালদা রেলস্টেশনে এসে হাজির হয়ে ট্রেনের খোঁজ করতে অনুসন্ধানে উপস্থিত হলাম, অনুসন্ধান থেকে জানাল যে অল্প সময়ের মধ্যেই ছয় নম্বর প্লাটফর্ম থেকে একটা ট্রেন ছাড়বে কল্যাণীর উদ্দেশে। টিকেট কাটার জন্য তাড়াতাড়ি টিকেট কাউন্টারের দিকে ছুটলাম। কাউন্টারের কাছে যেয়ে হতাশ হয়ে পড়লাম, কারণ লম্বা লাইন। এই লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কেটে ওই ট্রেন ধরা সম্ভব না; হাতে মাত্র মিনিট পনেরো সময়। বিকল্প খুঁজতে টিকেট ভেন্ডিং মেশিনের কাছে উপস্থিত হলাম। দুই তিনজনের পরেই আমার পালা এলে আমিও হাত লাগালাম মেশিনে, টিপাটিপি করতেই কল্যাণী স্টেশন পেয়ে গেলাম। ভাড়া দেখাল ৩০ টাকা; ফেরত টিকেটের অপশন দেখে সেটাতে চাপ দিলাম এবং নির্ধারিত ৬০ টাকা ঢুকাতেই ঘটাস করে টিকেট বেরিয়ে এলো। বাহ, চমৎকার! এত সুন্দর ব্যবস্থা থাকতে কি দরকার লাইনে দাঁড়াবার! টিকেট হাতে পেয়েই ছুটে গেলাম নির্ধারিত প্লাটফর্মে, নিশ্চিত হবার জন্য টিকেট চেকারকে জিজ্ঞাস করে ট্রেনে উঠে পড়লাম। বসার কোন সিট খালি নেই, কি আর করা অন্যদের মতো আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম একটা হাতল ধরে। কয়েক মিনিট পরেই ট্রেন চলতে শুরু করল। ট্রেনগুলো চলে বিদ্যুতের সাহায্যে, সেই ’৭১ সালেই এটা প্রত্যক্ষ করেছি। তখন ট্রেনগুলো ছিল নতুন, ঝাঁ-চকচকে এখন পুরাতন এবং নোংরা (বিগত যৌবনা নারীর মতো) যদিও গতি আমাদের থেকে অনেক বেশি। ১-২মিনিটের বেশি কোন স্টেশনে থামে না, যাত্রীরা যার যার মতো করে উঠছে-নামছে কোন চেঁচামেচি বা হৈ-হুল্লোড় নেই যদিও যাত্রীদের ট্রেন ঠাসা। ছাদের ওপর কোন যাত্রী নেই তার উপায়ও নেই কারণ সেখানে বিদ্যুতের তার; ফেরিওয়ালাদের উপস্থিতি আমাদের বাংলাদেশের মতই। এক ঘণ্টার কিছু পর ট্রেন কল্যাণী স্টেশনে থামলে ট্রেন থেকে নেমে আস্তে আস্তে সামনে হাঁটতে থাকি, এতদিন মানসপটে যে চিত্রটা আঁকা ছিল তার কোন কিছুই মিছছিল না, আন্দাজে কিছুটা পথ হেঁটে অবশেষে এক পথিকের সঙ্গে আলাপ করে পথের দিশা পেতে চেষ্টা করলাম কিন্তু কোন লাভ হলো না। পথের পাশের এক দোকানির সঙ্গে আলাপ করে আমার গন্তব্যের হদিস পেতে চেষ্টা করে সেখানেও ব্যর্থ হলাম তবে তার কাছ থেকে কিছু ক্লু বা ইঙ্গিত পেলাম। দোকানি কল্যাণী শহরে হনুমানের উপস্থিতির কথা অস্বীকার করলেন যদিও একাত্তরে আমাদের ট্রানজিট ক্যাম্পে যাবার পথে গাছে আমরা প্রচুর হনুমানের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছি। তিনি আমাদের ট্রানজিট ক্যাম্প অর্থাৎ নাসির্ং হোস্টেলেরও কোন সন্ধ্যান দিতে পারলেন না তবে আইএস নামের একটা হাসপাতাল এবং তার কিছু কোয়ার্টারের খোঁজ জানালেন আমি যে দিকটাতে অনুসন্ধান করছিলাম সেদিকটাতেই। একাত্তরে আমরা ট্রেন থেকে নেমে রেলস্টেশনের বাম দিক দিয়ে রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতাম বলেই মনে পড়ে, আমি সেই দিক লক্ষ্য করেই অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছিলাম। উল্টা দিকে অর্থাৎ হাতের ডান দিকে অপর একটি নার্স ট্রেনিং হাসপাতালে কথা তার কাছ থেকে জানতে পেলাম। হেঁটে সুবিধা হবে না চিন্তা করে একটা ইজি বাইক ভাড়া করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কাছেই একটা ইজি বাইক স্ট্যান্ড পেয়ে সেখানে যেয়ে দরদাম করে ভাড়া নির্ধারণ করে উঠে পড়লাম। বাইককে দুই স্থানের কথা উল্লেখ করেই ঠিক করেছিলাম প্রথমে বাম পাশের আইএস হাসপাতালের দিকে যেতে বললাম। কিছুদূর যাবার পর হাতের ডানে একটা হাসপাতাল দেখিয়ে জানাল যে এটাই সেই আইএস হাসপাতাল এবং বামে তার স্টাফ কোয়ার্টার। রাস্তা ধরে সামনের দিকে অগ্রসর হতেই মনে হলো যেন সেই পুরনো রাস্তা দিয়েই হাঁটছি; যদিও মানসপটে আঁকা রাস্তা থেকে কিছুটা সরু। কোয়ার্টারগুলোকে দেখে সেই পুরনো দালালগুলোর কথাই মনে হতে লাগল। হাসপাতালের সামনে উপস্থিত হয়ে দেখি লেখা ‘ওঊঝ ঐঙঝচওঞঅখ’ মানুষের মুখের বিকৃত উচ্চারণের কারণে আমার কাছে যেটা ‘আইএস’ হাসপাতালের মতো লেগেছিল। কোয়ার্টারগুলো অনেক জীর্ণশীর্ণ না হলেও পুরনো এবং বয়সের ছাপ স্পষ্ট। দালানগুলো অনেকটা স্মৃতির ভা-ারে রক্ষিত দালানের সঙ্গে মিলে গেল। শতভাগ নিশ্চিত না হলেও ৯৯ ভাগ নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মালো যে এগুলোই সেই পুরনো দালান যেখানে আমরা চাকুলিয়াতে ট্রেনিংয়ে যাওয়া এবং ফেরার পথে উঠেছিলাম। লক্ষ্য পূরণ হওয়াতে অন্যস্থান আর যাবার গরজ অনুভব করলাম না চালককে তাই ট্রেনস্টেশনের দিকে যেতে বললাম। স্টেশনে এসে দেখি একটা ট্রেন কলকাতা যাবার জন্য অপেক্ষা করছে, ফেরত টিকেট থাকার কারণে এবার আর টিকেট কাটার ঝামেলায় যেতে হলো না সরাসরি ট্রেনে যেয়ে উঠলাম। এবারও বসার জায়গা পেলাম না। আধাপথ আসার পর যাত্রীরা নেমে যেতে থাকলে একটা আসন খালি পাওয়ায় সেটিতে বসেই বাকি পথটুকু আসতে পারলাম। কলকাতা ফিরতে দুপুর গড়িয়ে গেল। লক্ষ্য হাসিল হওযাতে দুপুরে অনাহারের কষ্টটা আর গায়ে লক্ষ্যস্থলের সাফল্যের কারণে আগামীকালের বনগাঁ যাত্রার ব্যাপারে মোটামুটি স্থির নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখলাম। কল্যাণী থেকে কলকাতা স্টেশনে নেমে বনগাঁয়ের ট্রেন ভাড়া সম্বন্ধে ধারণা পেতে টিকেট ভেন্ডিং মেশিনের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে সেখানে যেতে ১৩০ টাকা লাগবে; ভাড়ার এই তফাতে কিছুটা আশ্চর্য বোধ করলাম কারণ আমার ধারণায় দুই স্থানের দূরত্ব মোটামুটি একই, কাজেই ভাড়া পার্থক্য খুব বেশি হবার কথা না, ভাবলাম আমারই ভুল। ভুল সবই ভুল! পরদিন আর নয় কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব, বনগাঁ যাবার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত কাজেই ভোর হতেই নাস্তা সেরে ‘শিয়ালদহ’ স্টেশনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। আগের মতোই টিকেট কাউন্টারে ভিড় অতএব সরাসরি মেশিন থেকে টিকেট কেটে যে প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ছাড়বে জিজ্ঞাসা করে সেই প্ল্যাটফর্মে যেয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম। হাতে সময় থাকাতে এবারে অবশ্য আসন পেতে সমস্যা হলো না, প্রচুর ফাঁকা আসন, দেখে শুনে পছন্দমতো একটা আসনে বসে পড়লাম। জানালার পাশে বসলাম যাতে বাইরের দৃশ্যগুলো ভালভাবে দেখতে পারি। মিনিট ১৫ পরেই ট্রেন চলতে শুরু করল। সেই ৭১ সালের কথা মনে পড়ে গেল তখনও এভাবেই বনগাঁ-কলকাতা-বনগাঁ ভ্রমণ করেছি অবশ্য বিনা টিকেটে। ‘জয় বাংলার’ লোকদের ট্রেনে টিকেট লাগতো না চেহারা দেখেই চেকাররা বুঝে নিত, সন্দেহ হলে জিজ্ঞাসা করত; জয় বাংলার লোক জানালে আর কিছু বলত না। এবারে অবশ্য কোন টিকেট চেকারই দেখলাম না এমনকি নামার পরে কাউকে টিকেট সংগ্রহ করতেও দেখলাম না। ট্রেন থেকে নেমে দিব্যি সবাই স্টেশন থেকে বের হয়ে গেল বিনা বাধায়। ভারতের মানুষরা অবশ্য আমাদের মতো এত অসৎ না, তারা লাইনে দাঁড়িয়ে যথাযথ টিকেট নিয়েই তারপর ট্রেনে ওঠে। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেন চলতে শুরু করার পর কলকাতা শহর থেকে যতই দূরত্ব বাড়ছিল গ্রামের চিত্রটা ততই স্পষ্ট হচ্ছিল। গ্রামের চিত্র বাংলাদেশের মতোই, ওখানেও দেখলাম শ্যালো টিউবওয়েলের সাহায্যে পানি তুলে জমিতে সেচ দিচ্ছে। চলার পথে বিশেষ যে জিনিসটি চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে টালির নির্মিত ঘর। (এরপর ১৮ পৃষ্ঠায়) ট্রেনলানের দুই পাশেই প্রচুর টালির ঘর এবং এগুলো নতুন অর্থাৎ আমাদের এখানে টালির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এখনও সেটা চালু আছে। পাকিস্তান আমলে সমর্থবানরাই আমাদের এখানে মূলত রান্নাঘরগুলো টালির দ্বারা তৈরি করাত। সাধারণত ছন অথবা টালি এই দুই উপাদানে রান্নাঘরগুলো তৈরি হতো। আগুন প্রতিরোধক হিসেবে টালি ব্যবহার করা হতো, খরচ সাপেক্ষ হওয়ায় সবাই টালির রান্নাঘর তৈরিতে সক্ষম ছিল না। আমাদের দেশে রেললাইনের দুইপাশে যেভাবে সারি সারি বস্তি লক্ষ্য করা যায় পশ্চিম বঙ্গে সেরকমটা দেখলাম না, সামান্য কিছু চোখে পড়লেও তাদেরগুলো আমাদের থেকে অনেক উন্নত এবং পানির অভাব আছে বলে মনে হলো না; এই দিক থেকে সম্ভবত তারা আমাদের চেয়ে ভাল অবস্থানে আছে। দুই ঘণ্টা চলার পর গাড়ি বনগাঁ স্টেশনে এসে থামতেই দ্রুত নেমে পড়লাম। দেখলাম যাত্রীরা ওভারব্রিজ পার হচ্ছে আমিও শহর যে পাশে সেই দিক লক্ষ্য করেই ব্রিজ পার হলাম, একাত্তরের কোন কিছুই আর মনে করতে পারলাম না। স্টেশন থেকে বের হয়ে মনের ইচ্ছা মতো হাঁটতে শুরু করলাম, বেশ কিছুটা হেঁটে কল্যাণীর মতো এখানেও কোন দিশা না পেয়ে অবশেষে ইজিবাইকের শরণাপন্ন হলাম, তার আগে অবশ্য এক বয়স্ক পথচারী মানুষের সঙ্গে কথা বলে টালিখোলা ক্যাম্পের কথা জানতে চেয়েছিলাম কিন্তু ব্যর্থ হলাম। ৫ নম্বর টালিখোলার কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি এ ব্যাপারে কোন তথ্যই দিতে পারলেন না। ইজিবাইক স্ট্যান্ডে একজন বয়স্ক ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। অল্প বয়স্করা পুরনো অনেক কিছুই চিনবে না জানবে না সেজন্যই বয়স্ক মানুষের সঙ্গে আলাপ। ৫ নম্বর টালিখোলা কেউ চিনলো না তবে ৩ নম্বর টালিখোলার হদিস পাওয়া গেল, জানালাম ওখানেই যাব। নৌকা সেতুর কথা জিজ্ঞাসা করলে জানালো যে সেটা এখন পাকা ব্রিজ আগে অনেকগুলো নৌকা সাজিয়ে রেখে তার ওপর কাঠের তক্তা ফেলে মানুষেরা রিক্সা ভ্যান পার করতো সেটা ওই ড্রাইভারও দেখেছে। এই ড্রাইভারকে পেয়ে খুশিই হলাম কারণ সে অন্তত কিছুটা হলেও আমার পরিচিত জায়গাগুলোর হদিস দিতে পারবে। দরদামের পর স্থির হলো ৭০ টাকায় (ভারতীয়) ব্রিজ, টালিখোলা এবং চাঁপাবাড়িয়া ঘুরিয়ে দেখাবে। ড্রাইভারের পূর্বপুরুষ পাকিস্তান থেকে গিয়েই ভারতের স্থায়ী হয়েছে। কিছুদূর যেতেই একটা সেতুর দেখা পেলাম ভাবলাম এটাই সেই ভাসমান সেতু। তবে সেতুতে ওঠার পর দূরে আর একটা সেতু দেখিয়ে জানালো যে ঐটাই সেই নৌকা সেতু। সেতুটি অবশ্য এখন পাকা। নদী এবং নদীর পানি প্রায় একই অবস্থায় পেলাম অর্থাৎ তখন যে পরিমাণ পানি ছিল এখনও প্রায় তাই আছে, নদীটির নাম ইছামতী। নদীতে তখনও কচুরিপানা ছিল এখনও আছে এবং স্বচ্ছতা আগের মতোই, আমাদের নদীর মতো দূষিত হয়ে কালো হয়ে যায়নি। নদী পার হয়ে ইজিবাইকটি যেতে থাকে টালিখোলার দিকে, কিছুদূর যেয়ে হাতের বামে নির্দেশ করে দেখালো যে, এগুলোই সেই টালিখোলা প্রথমে এক তারপর দুই এবং শেষেরটি তিন নম্বর টালিখোলা এর আর কোন টালিখোলা নেই; বুঝলাম আমার তখনকার ৫ নম্বর আসলে এই তিন নম্বর টালিখোলা। নিশ্চিত হলাম সেই ফটকের ডান দিক দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তাটি দেখে, যদিও এখন আর কোন ফটক নেই, নেই সেই টিনের দোচালা ঘরগুলো তার স্থানে সেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে দোতলা-তিনতলা পাকা দালান। উত্তর-দক্ষিণে প্রলম্বিত টিনের দোচালা ঘরের বদলে প্রায় একই স্থানে দালানটির অবস্থান। পেছনে ইছামতি নদীটিকেও দেখতে পেলাম। এই নদীর টলটলে পানিতেই আমার তখন ম্লান করে নির্মল হতাম। টালিখোলা ক্যাম্পের বাইরে ডান পাশ দিয়ে যে সড়কটি ধরে বায়রার দিতে যওয়া যেত সেই সড়কটি দেখে টালিখোলা ক্যাম্পের অবস্থানের ব্যাপারে নিশ্চিত হলাম, এই সড়ক ধরেই আমরা সেই সময় পিটি-প্যারেড করতে করতে সামনে অনেক দূরে গিয়ে তারপর আবার ফেরত আসতাম। ভাল লাগল জায়গাটা খুঁজে পেয়ে। এখান থেকে বিদ্রোহ করে রানাঘাট ক্যাম্পে যাওয়ার কারণেই সৌভাগ্যবশত প্রথম দিককার চ্যাচে চাকুলিয়া যেতে পেরেছিলাম ট্রেনিংয়ের জন্য। অনেক কথাই মনের পর্যায় ভেসে উঠতে শুরু করল, স্মৃতিকাতর হওয়াটাই স্বাভাবিক, মনের আর দোষ কী! বয়স হলে সে তো পেছন ফিরেই তাকাবে! আর সেই স্মৃতি যদি হয় মুক্তিযুদ্ধের মতো অসম্ভব গৌরবের এক স্মৃতি! টালিখোলা থেতে চলতে শুরু করলাম চাঁপাবাড়িয়ার দিকে। রাস্তাটাকে অনেক চওড়া করা হয়েছে তবে শিরিষ গাছগুলোর বিনিময়ে। পুরনো সেই গাছগুলো আর নেই সব কেটে ফেলা হয়েছে, স্থানে স্থানে একটা দুইটা গাছের দেখা অবশ্য এখনও পাওয়া যায় তবে অনেকটাই ন্যাড়া চাঁপাবাড়িয়ার সেই আমবাগানের আর কোন চিহ্ন নেই অবশ্য পুকুরের অস্তিত্ব আছে। প্রচুর দালানকোঠায় ভরে গেছে স্থানটি, ড্রাইভার জানাল যে দালানের পেছনে দিকে এখনও পুকুরের অস্তিত্ব বর্তমান। চাঁপাবাড়িয়া ক্যাম্পটিতে আমরা মাঝে মাঝে যেতাম ওই ক্যাম্পের তত্ত্বাবধায়ক বাশার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য। তিনি কলাবাড়িয়ার সন্তান এবং আত্মীয়। যশোর জেলা আনসার এ্যান্ডজুটান্ট হিসেবে কর্মরত অবস্থায় পালিয়ে এসে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। স্মৃতি জড়িত স্থানটি পিছনে ফেলে বনগাঁ রেল স্টেশনের দিকে যাত্রা শুরু করলাম কলকাতায় যাবার জন্য। স্টেশনে পৌঁছে জানতে পারলাম যে, কলকাতায় যাবার জন্য একটি ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। তাড়াতাড়ি কাউন্টারে গেলাম টিকেট কাটার জন্য, ভিড় না থাকায় সহজেই টিকেট বিক্রেতার নিকট উপস্থিত হয়ে ১৩০ টাকা প্রদান করে কলকাতার একটি টিকেট চাইলাম। তিনি জানতে চাইলেন টিকেটি কয়টা? আমি বললাম একটা। তিনি জিজ্ঞাা করলেন তাহলে এত টাকা দিচ্ছেন কেন? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ভাড়া কত? তিনি বললেন ২০ টাকা। আমি বিশ টাকার জন্য পকেট হাতড়াতে থাকলে পাশ থেকে এক যাত্রী উপদেশ দিলেন হাতের ৫০ টাকার নোটটা দেয়ার জন্য আমি তাড়াতাড়ি সেটা দিতেই কাউন্টারম্যান বাড়তি টাকাসহ একটি টিকেট হাতে ধরিয়ে দিলেন। টিকেট হাতে পেতেই আমি ত্রস্তপদে ব্রিজ পার হয়ে ট্রেনের দিকে ছুটলাম। ট্রেনের কাছে পৌঁছে ফাঁকা আসনের খোঁজ করে আান পেতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে ট্রেনের একটি বগিতে উঠে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকলাম ভুলটা কোথায় হলো? আসার পথে দিলাম ১৩০ টাকা আর যাবার সময় দিতে হচ্ছে ২০ টাকা অর্থাৎ ১১০ টাকা কম। বুঝলাম কাউন্টার থেকে টিকেট না কেটে ওস্তাদি করে মেশিন থেকে টিকেট কেটে এই ধরাটা খেয়েছি। আক্কেল সেলামি না হয় দিলাম কিন্তু ভুলটা কোথায় হলো সেটাই ধরতে পারছিলাম না। আসার পথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গবেষণা করতে শুরু করলাম। যেহেতু টিকেট কালেক্টর টিকেটগুলো নেয়টি কাজেই সবগুলো টিকেটেই আমার কাছে ছিল তা ভুলটা ধরতে সহজ হলো। মেশিনে টিকেট কাটার সময় নড়হমধ পর্যন্ত লিখেতেই ইড়হমধড়হ ংঃধঃরড়হ এসেছিল একটাই মাত্র স্টেশন ছিল কাজেই দ্বিধাদ্বন্দ্বের কোন প্রশ্নই আসে না আমি সেই স্টেশনেরই টিকেট কেটেলিাম প্রযোজ্য ১৩০ টাকা ঢুকিয়ে। পরে খেলাল করে দেখলাম ফেরত পথের টিকেটে লেখা আছে ইধহমধড়হ ঔঘ যার দূরত্ব ৭৭ কিলোমিটার আর যাবার টিকেটে লেখা ইঙঘএঅওএঅঙঘ যার দূরত্ব ৮২১ কিলোমিটার। পাঠক সাবধান। আমার মতো ভুল যেন না হয়। শিয়ালদহ স্টেশনে নেমে ফাঁকা একটা টিকেট মেশিনে গন্তব্যস্থানের ভুলের ব্যাপারটা নিশ্চিত হলাম (১১০ টাকা গচ্চা গিয়ে)।
×