ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মোমিন মেহেদী

মা মুক্তিযোদ্ধা, চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ...

প্রকাশিত: ০৮:৩১, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

মা মুক্তিযোদ্ধা, চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ...

প্রিয় জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে জান-মান বাজি রেখে লড়াই করেছেন অসংখ্য বীর বাঙালী, লড়েছেন নারীগণ। আমাদের বীর মা, চাচি-ফুফু, আমাদের প্রিয়জন। লাখ লাখ মা-বোনের চেষ্টা আর ত্যাগের হাত ধরে এসেছে বিজয়। তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ত্যাগী ও দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়েছেন যারা তাদেরই একজন তারামন বিবি বীরপ্রতীক। শুধু সম্মুখ যুদ্ধই নয়। তিনি নানা কৌশলে শত্রুপক্ষের তৎপরতা এবং অবস্থান জানতে গুপ্তচর সেজে সোজা চলে গেছেন পাক-বাহিনীর শিবিরে। কখনও সারা শরীরে কাদা-মাটি, চক, কালি এমনকি মানুষের বিষ্ঠা পর্যন্ত লাগিয়ে পাগল সেজেছেন তারামন। চুল এলোমেলো করে বোবা সেজে পাক সেনাদের সামনে দীর্ঘহাসি কিংবা কান্নার অভিনয় করেছেন। কখনও প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গুর মতো করে চলাফেরা করে শত্রুসেনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছেন নদী সাঁতরে গিয়ে। আবার কলাগাছের ভেলা নিয়ে কখনও পাড়ি দিয়েছেন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী। আর জান-মানের কথা না ভেবেই এসব দুঃসাহসী কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন একমাত্র দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য। স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনা এই অনন্য বীর এক ডিসেম্বর কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার কাচারীপাড়ার নিজ বাড়িতে শেষ নিদ্রায় শায়িত হয়েছেন। নিবেদিত থাকা কালোহীন আলোকিত মানুষদের মধ্যে অন্যতম তারামন বিবি। তার জন্ম ১৯৫৭ সালে কুড়িগ্রামের চর রাজিবপুর উপজেলার শংকর মাধবপুর গ্রামে। ১৯৭১ সালে তারামন বিবি ১১নং সেক্টরে নিজ গ্রামে ছিলেন। তখন ১১নং সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের। মুহিব হাবিলদার নামে এক মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। যিনি তারামনের গ্রামের পাশের একটি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি তারামনকে ক্যাম্পে রান্নাবান্নার জন্য নিয়ে আসেন। তখন তারামনের বয়স ছিল মাত্র ১৩ কিংবা ১৪ বছর। পরে তারামনের সাহস ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালনা শেখান। এরপর একদিন দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় তারামন ও তার সহযোদ্ধারা জানতে পারেন পাকবাহিনীর একটি গানবোট তাদের দিকে আসছে। তারামন তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নেন এবং তারা শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এরপর তারামন অনেক সম্মুখযুদ্ধে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অংশ নেন। এ কারণে ১৯৭৩ সালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর প্রতীক খেতাব প্রদান করে। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত দুজন নারীর মধ্যে একজন হচ্ছেনÑ তারামন বিবি। এই খেতাবপ্রাপ্তির কথা দীর্ঘ ২৫ বছরেও জানতে পারেননি তিনি। ময়মনসিংহের আনন্দ মোহন কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিমল কান্তি দে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান আলী এবং রাজিবপুর কলেজের সহকারী অধ্যাপক আব্দুস সবুর ফারুকীর সহায়তায় তাকে খুঁজে বের করেন। এরপর ১৯৯৫ সালের শেষ দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি বীরপ্রতীক খেতাবের পদক তুলে দেয়া হয় তার হাতে। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেন, কিন্তু চরম বাস্তবতা হলোÑ নারীদের সহযোগিতা না হলে সম্ভব হতো না এতবড় বিজয় অর্জন। যারা সরাসরি অস্ত্র ধরেছিলেন তাদের প্রাণ হারানোর আশঙ্কা ছিল সর্বাপেক্ষা বেশি। কিন্তু এটিও অস্বীকার করা যাবে না যে, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে যে কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাওয়াই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। আর সে ক্ষেত্রে নারীর শারীরিক নির্যাতনের ব্যাপারটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব ঝুঁকি সঙ্গে নিয়েও দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য পুরুষদের পাশাপাশি অসংখ্য নারী সশস্ত্র যুদ্ধসহ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্নভাবে অংশ নিয়ে প্রমাণ করেছিল তাদের অবদানও সমান গৌরবের। এই গৌবরবের রাস্তায় আমাদের স্বাধিকার-স্বাধীনতা অর্জিত হলেও আজ যুদ্ধাপরাধীরা রাজনীতির মাঠে, আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে ধর্ম ব্যসায়ীদের প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফা ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ইসলাম শব্দ ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠা পাওয়া জালিয়াতি প্রতিষ্ঠানগুলো। যেন কেউ নেই। আছে কেবল অন্ধকারের মোসাহেবী আর দালালি। যে কারণে আজ ম্লান হতে বসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর রক্ত-সম্মান। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ দুইটি অবিচ্ছেদ্য শব্দ। বাঙালী জাতির হৃদয়ের গভীরের একটি শব্দ ‘মুুক্তিযুদ্ধ। বেশি ’। কিন্তু এটিও অস্বীকার করা যাবে না যে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে যে কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাওয়াই ছিল ঝুঁকিপূণ। আর সে ক্ষেত্রে নারীর শারীরিক নির্যাতনের ব্যাপারটি একটি গুরুত্বপূর্ণবিষয়। এসব ঝুঁকি সঙ্গে নিয়েও দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য পুরুষদের পাশাপাশি অসংখ্য নারী সশস্ত্র যুদ্ধসহ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্নভাবে অংশ নিয়ে প্রমাণ করেছিল তাদের অবদানও সমান গৌরবের। পাকিস্তানীদের হাতে প্রায় তিন লাখ মানুষ শহীদ হয়েছিল। আর নির্যাতনের শিকার হয়েছিল দুই লাখ নারী। সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার কিশোরী, তরুণী, প্রৌঢ়া এমনকি প্রবীণ অবিবাহিতা নারী ও বিবাহিত নারী কিভাবে তাদের ক্ষতবিক্ষত জীবন পার করেছেন তা কল্পনার অতীত। বরবর্তার শিকার এই নারীদের কয়েকজন অক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন। কেউ কেউ এসএসসি পাস থেকে শুরু করে এমএ পাস, এমনকি এমবিবিএস ডাক্তারও ছিলেন। যারা বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত হয়েছেন। অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্যও নেই। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা এসব নারীদের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক শ্রমজীবী নার্স, সমাজসেবী, গৃহকর্মী, চাকরিজীবী, অধিকাংশই গৃহিণী। এসব নারীদের দু’একজন অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন বাংলাদেশের ভেতরে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভারতে স্থাপিত হাসপাতালে নার্স হিসেবে, চিকিৎসক হিসেবেও কাজ করেছেন কয়েকজন। দেশের বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতাদের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পৌঁছে দেয়ার ঝুঁকিপূর্ণ কাজও করেছেন অনেকে। এই নারীরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধাদের চেষ্টার হাত ধরে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ-মানচিত্র সমৃদ্ধ হবে ভেবে এগিয়ে চলছি আমরা গত ৪৮ বছর। সেই দীর্ঘতায় আজ জাতির মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকে পরিমাপ করা যাবে না। এই বিশালতায় যেসব নারী বিভিন্ন অবস্থানে থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যম-িত করেছেন তাদের অনেকের নাম এখনও অজানা। তবে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রীরা সারা দেশেই তৎপর ছিলেন। তারা বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষের বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত হওয়ার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেছেন। মমতাজ বেগম, কাজী রোকেয়া সুলতানা, বেবী মওদুদ, রানী খান, রোকেয়া কবীর, মনিরা আক্তার প্রমুখ নারী জনমত গঠনের পাশাপাশি ফিজিক্যাল ফিটনেস, মার্চ-পাস্ট, অস্ত্র চালনা, ফাস্টএইড, ট্রেঞ্চ করা এবং আত্মরক্ষার নানা কৌশলÑ এসব ব্যাপারে ট্রেনিং নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষা দিতেন। বদরুন্নেসা আহমেদ পুনর্বাসন কার্যকলাপ ও মহিলা সংগঠন মুজিবনগরের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন একাত্তরে। বেগম নুরজাহান খুরশীদ বিভিন্ন সেক্টরগুলোর কর্মকা- পরিদর্শন ও রিপোর্ট আদান-প্রদানের কাজ করলেও পরবর্তী সময়ে কূটনীতিকের দায়িত্বও পালন করেন। সাজেদা চৌধুরী তার বক্তৃতা বিবৃতির মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেন। সেই সঙ্গে সচেতন করতেন কোন কোন বিষয়ে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে মহিলা মুক্তিফৌজের হাল ধরেছিলেন। এই মহিলা কমিটি মহান মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়। এই কমিটিতে প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ ছাড়াও গীতারানী নাথ, নিবেদিতা দাস, সুধারানী কর মঞ্জুদেবী, সুষমা দাস ও রমা রানী দাস এদের নাম উল্লেখযোগ্য। কাজের সুবিধার্থে প্রশিক্ষণ সেবা ধাত্রী বিদ্যা, প্রাথমিক চিকিৎসা, কুটির শিল্প, মুদ্রণ ও রামকৃষ্ণ মিশন এ রকম কয়েকটি সাব-ইউনিটে বিভক্ত হয়ে কাজ করেছেন নারীরা। তাদের মধ্যে প্রশিক্ষণ সেবার দায়িত্বে কানন দেবী, উপাসনা রায়, সুধারানী কর, পূর্ণিমা রানী দাস ও নিপা রানী মুজমদারের নাম উল্লেখযোগ্য। প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ, সুক্লা রানী দে, হেমলতা দেব ছাড়াও আরও অনেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। নাজিয়া ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়া রণাঙ্গনে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। সেলিনা বানু স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখাও শরণার্থীদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগাতে তৎপর ছিলেন। এসব কাজে বেগম মুস্তারী সাফী, মতিয়া চৌধুরী, মালেকা বেগম, আয়েশা খানম, রীনা খান প্রমুখের নামও উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে যোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখা এবং সক্ষম নর-নারীদের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করে তোলার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কমর্কা-ের খুবই গুরুত্বপূর্ণভূমিকা ছিল। শাহনাজ বেগমের কণ্ঠেÑ সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা, কল্যাণী ঘোষের পূর্বদিগন্তে সূর্য উঠেছে, এ রকম আরও অজ¯্র গানের সুর শুনে মানুষ শিহরিত হয়েছে আর ঝাঁপিয়ে পড়েছে দেশ রক্ষার সংগ্রামে। প্রাণ বিষণœœ হতে পারে এ কথা জেনেও যেসব স্ত্রী, মাতা, ভগ্নি কন্যারা তাদের প্রাণপ্রিয় স্বামী, পুত্র, ভাই ও বাবাকে যুদ্ধে পাঠিয়েছেন তাদের এই মহানুভবতার উৎসও অবশ্যই দেশপ্রেম। এক্ষেত্রে শেখ ফজিলাতুন্নেসার নাম সর্বাগ্রে । এছাড়াও জাহানারা ইমাম ও বেগম সুফিয়া কামালসহ আরও হাজারও নাম না জানা নারী যোদ্ধারা ছিলেন। বেগম নূরজাহান মুরশিদ, আমেনা আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী ও মালেকা বেগম প্রমুখ এসব নারীরা পেশাদার কূটনীতিক না হলেও দেশের প্রয়োজনে তাদের সেই চরম মুহূর্তে এ রকম গুরু দায়িত্বে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনতে যে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেখানে এ দেশের নারীদের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। মুক্তি সংগ্রামে শত শত নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সার্থক ফসল আমাদের বিজয়...। এই বিজয়ের হাত ধরে এগিয়ে গেলে জানা যায়, নারী তার সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিল স্বাধীনতার মতো একটি বড় অর্জনে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ ছিল তার জীবন বাজি রাখার ঘটনা। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীকে মূলধারায় স্থাপন না করার ফলে নারীর প্রকৃত ইতিহাস যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। নারী মুক্তিযুদ্ধে যে গৌরবগাথা রচনা করেছিল তা ধর্ষিত এবং নির্যাতিত নারীর ভূমিকায় অদৃশ্য হয়ে আছে। প্রকৃত অবদান খুঁজে নারীকে মূলধারায় না আনার আরও একটি কারণ, নিম্নবর্গের নারীরাই ব্যাপকভাবে এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। নিম্নবর্গনারীর ইতিহাস ক্ষমতাশীল সুশীল সমাজের কাছে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গৃহীত হতে শুরু করে স্বাধীনতার তিন দশক পরে। বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের শেষ পর্বে পাক বাহিনীর হাতে নির্যািতত মেয়ে বেনু বলছে মুক্তিযোদ্ধা প্রেমিককে, ‘স্বাধীনতার জন্য তুমি দিয়েছ পা আর আমি জরায়ু। আমরা দুজনেই এখন নতুন করে ঘর বাঁধব।’ আসলে এ ঘর বাঁধা মানে ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে নারী-পুরুষ মিলে গড়ে তোলা। কিন্তু বাস্তবে কী এটি হয়েছে? যুদ্ধের সময়ে আহত মুক্তিযোদ্ধারা পেলেন বীরের মর্যাদা কিন্তু শারীরিকভাবে পাক বাহিনীর হাতে নিগৃহীত নারীদের কেউ আত্মহত্যা, কেউ পরিবার থেকে বিতাড়িত, কেউবা অপমানে আর বেদনায় ঠাঁই নিয়েছিলেন পতিতালয়ে এমনকি কেউ কেউ পাক সেনাদের সঙ্গী হয়ে নিরুদ্দেশের পথে। হায় নারীর শরীরই যেন আজন্ম পাপ! অথচ এদের শরীরই তো আহত হয়েছিলÑ তবে? যুগ যুগ ধরে লালিত শারীরিক সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি সমাজ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে তাদের ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধি দিলেন পরম সম্মানে। কিন্তু এ শব্দটি উপশমের চেয়ে নারীত্বের ওপর আক্রমণ ও পাশবিক অত্যাচারের দ্যোতক হিসেবে রূপ নেয় যার ফলে সে শতকের শেষ সময় পর্যন্ত নারীরা লজ্জায় অধোবদন হয়ে থাকতেন। স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় ছিনিয়ে আনতে যে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেখানে এ দেশের নারীদের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। মুক্তি সংগ্রামে শত শত নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সার্থক ফসল আমাদের বিজয়। অন্যদিকে এ দেশের লাখ লাখ গৃহবধূ, মা ও বোন মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে জীবন রক্ষা করেছেন, খাদ্য দিয়েছেন, ভালবাসা দিয়েছেন, প্রেরণা দিয়েছেন সেই সঙ্গে পাক হানাদার ও দোসরদের সন্ধান দিয়েছেনÑ তা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রচারিত হওয়া অনুষ্ঠানÑ ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’Ñ অতঃএব একজন সাহসী নারী ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বেরিয়ে এলেন বিজয়ের পতাকা হাতেÑ এরপর ধীরে ধীরে আরও অনেকে। এরপর তারা কেবল বীরাঙ্গনা নন, পেলেন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান। এই সম্মানের সঙ্গে সঙ্গে তিলোত্তমা মা হয়ে উঠুক আমার ভালবাসার বাংলাদেশ, প্রত্যয়ে পথ চলি আর বলি- বিজয় বাংলাদেশ। কেননা, আমি জানি- যে বায়ান্নতে ভাষা আন্দোলন হয়েছে, সে বায়ান্নতে আমরা হারিয়েছি সালাম, রফিক, জব্বারসহ ভাষা শহীদদের, দিয়েছি রক্ত। সে ভাষা আন্দোলনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘জিন্দাবাদ’-এর মতো একটি উর্দু শব্দকে ‘না’ বলতে হবে। একই সঙ্গে ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত ‘বাংলাদেশ’ কে বাংলা বলে খাটো করতে চাই না। চাই এগিয়ে যাক বাংলা, বাংলা ভাষায় আলো আশায়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যেসব নারী পাক বাহিনীর বা তাদের দেশীয় দোসরের হাতে অপহৃত হয়ে নিখোঁজ বা স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেন তারা সবাই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু ১৯৯৯ সালের আগ পর্যন্ত নারী শহীদদের কোন তালিকা প্রণীত হয়নি, বিচ্ছিন্নভাবে লেখা হয়েছে শুধু তাদের মৃত্যুর ইতিহাস। ২ মাচের্র কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী রওশন আরা বুকে মাইন বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েন একটি পাকিস্তানী ট্যাঙ্কের সামনে। এতে ট্যাঙ্কটি ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রওশন আরাও শহীদ হন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে লেখা হলোÑ ‘বীর রওশন আরা বেগম বুকে মাইন বেঁধে জল্লাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের কিশোরী দেহের সঙ্গে একটা আস্ত পেট্রোল ট্যাঙ্ক ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।’ আমরা এগিয়ে যাব বিজয় বাংলাদেশ বলে, তবে তার সঙ্গে চাই আলোর ইশারায় এগিয়ে চলা, সত্য বলা। যাতে করে মুক্তিযুদ্ধে চেতনায় অগ্রসর হওয়ার নামে অনগ্রসর না হয় আর আমার প্রিয় জন্মভূমি। যেন সবাই সম্মান-ভালবাসায় অগ্রসর হতে পারে প্রতিদিন, সেই প্রত্যয়ে চাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান, চাই স্মৃতি সংরক্ষণ আর ভালবাসা সবসময়... ভালবাসার দেশটা আমার স্বপ্ন নিয়ে চলা, মা মুক্তিযোদ্ধা, চেতনা মুক্তিযুদ্ধ বলা; এই বলাতে হাসি, দেশকে ভালবাসি-চলুন আলোহাসি...
×