ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র

প্রকাশিত: ০৮:৩২, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক টিভি নাটক ও চলচ্চিত্র

১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হওয়া প্রথম নাটকটি মুক্তিযুদ্ধের। ‘বাংলা আমার বাংলা’ নাটকটি লিখেছিলেন ড. ইনামুল হক, প্রযোজনা করেছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন। ১৯৭২ সালের মধ্যবর্তী সময়ের আলোচিত মুক্তিযুদ্ধের নাটক ‘জনতার কাছে আমি’। আমজাদ হোসেনের লেখা নাটকটি মুস্তাফিজুর রহমানের পরিচালনায় প্রচারিত হয়। এ সময়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাটক ‘এরা ছিল এধারে’। মোর্শেদ চৌধুরীর লেখা নাটকটি প্রযোজন করেছিলেন মোহাম্মদ বরকতউল্ল্যাহ। ১৯৭৩ সালে জেসমিন চৌধুরীর লেখা ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ নাটকটি প্রযোজনা করেন আবদুল্লাহ ইউসুফ ইসাম। শুধু তা-ই নয়, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে টিভি নাটকে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে বহুবার। একটা সময়ে এসে দেশের একমাত্র টেলিভিশন বিটিভিতে মুক্তিযুদ্ধের নাটক স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে নির্মিত হতে থাকে। আশির দশকের কাছাকাছি সময়ে এসে আরও কিছু চেতনাসমৃদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের নাটক বিটিভিতে প্রচারিত হয়। এরমধ্যে জিয়া আনসারীর ‘কোনো এক কুলসুম’, আতিকুল হক চৌধুরীর ‘কম্পাস’, রাবেয়া খাতুনের ‘বাগানের নাম মালানীছড়া, জোবেদ খানের ‘একটি ফুলের স্বপ্ন’ এবং রাজিয়া মজিদের ‘জোৎস্নার শূন্য মাঠ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বলতে গেলে, আশির দশকেই বেশি চেতনাসমৃদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের টিভি নাটক নির্মিত হয়েছে। হাবিবুল হাসানের রচনায় ও আবদুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় ‘আমার দ্যাশের লাগি’ নাটকটি সে সময়ের দর্শককে মুগ্ধ করেছে। এছাড়া মমতাজ উদ্দীন আহমেদের লেখা মোস্তফা কামাল সৈয়দের প্রযোজনার ‘এই সেই কণ্ঠস্বর’ নাটকটি দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। সে সময়ের আলোচিত মুক্তিযুদ্ধের টিভি নাটকের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘আয়নায় বন্ধুর মুখ’ ও ‘একটি যুদ্ধ অন্যটি মেয়ে’, আসাদুজ্জামান নূরের ‘এ মোর অহংকার’, রাহাত খানের ‘সংঘর্ষ’, আল মনসুরের ‘শেকল বাঁধা নাও’ ও ‘নয়ন সমুখে তুমি নাই’, আতিকুল হক চৌধুরীর ‘যদিও দূরের পথ’ ও ‘স্বর্ণতোড়ন’, মামুনুর রশীদের ‘খোলা দুয়ার’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। খ- নাটকের পর আশির দশকের শেষের দিকে মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী ও চেতনা নিয়ে ধারাবাহিক নাটক নির্মাণ শুরু হয়। সাইফুল বারীর লেখায় জিয়া আনসারীর প্রযোজনায় ‘জোনাকী জ্বলে’ এবং আমজাদ হোসেনের লেখায় ফখরুল আবেদীনের প্রযোজনায় ‘জন্মভূমি’ নামে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ধারাবাহিক নাটক বিটিভিতে প্রচারিত হয়। বিটিভির পর দেশে বেসরকারি টিভি চ্যানেলের যাত্রা শুরু হয়। ফলে টিভি মিডিয়া বিস্তৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়। তবুও নব্বইয়ের দশকে বিটিভিতে প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধের নাটকই সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। এরমধ্যে হাবিবুল হাসানের ‘মেঘের ছায়ার নিচে’, আখতার ফেরদৌস রানার ‘সেই এক গায়েন’, মোস্তফা কামালের ‘পোড়া মাটির গন্ধ’, বুলবন ওসমানের ‘পুষ্পের পবিত্রতা’, নাসির আহমেদের ‘কোন এক বুলা গল্প’, মুহম্মদ রওশন আলীর ‘নীল নকশা’ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এছাড়া বিটিভিতে প্যাকেজের আওতায় ফেরদৌস হাসানের ‘ঠিকানা’ এবং রেজানুর রহমানের ‘পতাকা’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। ২০০১ সালে বিটিভিতে প্রচারিত তারিক আনাম খানের ‘জেরা’ নাটকটিও ভাল নাটক হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সে সময়ে আবুল হায়াতের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক টেলিফিল্ম ‘পিতা’ দর্শকের কাছে প্রশংসিত হয়। এটিএন বাংলা সাইদুর রহমান জুয়েলের পরিচালনায় ‘কোন সীমানায় মুক্তি’ নামের একটি মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক নাটক প্রচার করে। একই চ্যানেলে ২০০৫ সালে মামুনুর রহমানের নাটক ‘অচেনা বন্দর’ আলোচিত হয়। এটিএন বাংলার আলোচিত নাটকের মধ্যে ‘একটি আত্মহত্যা’ ও ‘তুফান আলীর ভূত’ অন্যতম। চ্যানেল আই প্রচারিত ‘বিজয় নিশান’, ‘গল্পের শেষ আছে’, ‘ধূসর এ্যালবাম’, ‘স্মৃতি সপ্তাহ’, ‘অগ্নিদিনে তাহারা’, ‘খোঁজ’, ‘স্পার্টাকাস ৭১’, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ নাটকগুলোতেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রবলভাবে ফুটে ওঠে। একুশে টিভিতে প্রচারিত হয় ‘পাপপুণ্য’, ‘বলাকা’, ‘জন্ম’ প্রভৃতি। এনটিভিতে দেখানো হয় ‘শেকড়’, ‘মুক্তি’, ‘পেছনে তখন’ ইত্যাদি। এছাড়া আরটিভি, বাংলাভিশন, বৈশাখী টিভি, মোহনা, বিজয় ও দেশ টিভি প্রচার করে একাধিক মুক্তিযুদ্ধের নাটক। ২০০৮ সালে আলোচিত হয় ফেরদৌস হাসানের নাটক ‘দাগ’। একই বছর সৈয়দ শামসুল হক রচিত ও আশরাফী মিঠু পরিচালিত ‘ম্যাজিক’ নাটকটিও বেশ প্রশংসা অর্জন করে। ২০১০ সালে তাহের শিপনের ‘কক্ষপথের যুদ্ধ’ মুক্তিযুদ্ধের একটি ভাল নাটক হিসেবে প্রশংসিত হয়েছে। ওই বছরের ডিসেম্বরকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক প্রচার করা হয়। এরমধ্যে ১৬ পর্বের প্রতিদিনের ধারাবাহিক ‘মুক্তিযুদ্ধ-১৯৭১’ নাটকটি উল্লেখযোগ্য। ২০১১ সালে ‘ট্রানজিস্টার’ নামের নাটকটিও আলোচনায় আসে। ২০১৪ সালে প্রচারিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক নাটকগুলোর মধ্যে ‘গুডবাই কমান্ডার’, ‘পেজ সিক্সটিন’, ‘সাক্ষাৎকার’, ‘বাংলাদেশ’, ‘জনক ৭১’, ‘শহীদ মোসাম্মৎ কুলসুম বেগম’, ‘পালকি’ এবং ‘ডায়রি-৭১’ বিশেষভাবে সমাদৃত হয়। এরপর থেকে দেখা যায়, প্রতিবছর স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস এলে টিভি চ্যানেলগুলো প্রচার করে মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ নাটক। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে আমরা পাই ‘সেলিব্রেটি ৭১’, ‘একজন দুর্বল মানুষ’, ‘ঋণ শোধ’, ‘আলোর মিছিলে ওরা’, ‘একটি লাল শাড়ির গল্প’, ‘বীরমাতা’, ‘এবং অতঃপর’, ‘কাঁটা’, ‘মুক্তিযুদ্ধ ৭১’, ‘এ কোন ভোর’, ‘অলিভ গাছ, ক্রিস্টাল নদী’, ‘রক্তস্নান’, ‘ছোট বাড়ি বড় বাড়ি’, ‘আলোর পথে’, ‘বীরাঙ্গনা’, ‘বৈঠা’, ‘ফসিলের কান্না’, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’, ‘পতাকা’, ‘একাত্তরের দিনগুলি’, ‘অবশিষ্ট বুলেট’, ‘অবহন’, ‘শুক্লপক্ষের আহ্বান’, ‘ক্ষুদিরামের ফাঁসি’ প্রভৃতি। এছাড়া ফরিদুর রেজা সাগরের ছোটকাকু সিরিজের মুক্তিযুদ্ধের একটি বিখ্যাত গল্প নিয়ে আফজাল হোসেনের নির্মাণ এবং অভিনয় ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। বিগত বছরগুলোর মতো ২০১৭ সালেও নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক টিভি নাটক। গত বছরের ৯ ডিসেম্বর রাত ৯টায় বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ‘জননী’। নাটকটি রচনা করেছেন রেজাউর রহমান ইজাজ, প্রযোজনায় ছিলেন মাহফুজা আক্তার। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোমেনা চৌধুরী, সাজ্জাদ সাজু, সুষমা সরকার, মোহাম্মদ বারী, আঞ্জুমান আরা বকুল প্রমুখ। এছাড়াও নির্মিত হয়েছে ‘লাল শার্ট’। ইরানি বিশ্বাসের রচনা ও পরিচালনায় নাটকটির শূটিং শেষ হয়েছে কিছুদিন আগে। ১৩ ডিসেম্বর বিকেল ৩টা ৫ মিনিটে চ্যানেল আইয়ের পর্দায় নাটকটি প্রচারিত হয়। বরাবরের মতো ফরিদুর রেজা সাগরের গল্পে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নাটক ‘স্মৃতির বাড়ি’। এর নাট্যরূপ ও পরিচালনা করেছেন অরুণ চৌধুরী। তার ‘বাড়ি’ সিকোয়েন্সের এটি ১২তম নাটক। নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন আবুল হায়াত, রাইসুল ইসলাম আসাদ, আল মনসুর, নরেশ ভুঁইয়া, ইরফান সাজ্জাদ, অর্ষা, একে আজাদ, তিনু করিম, ফরহাদ, মম আলী প্রমুখ। এ বছরও বিজয়ের মাস ডিসেম্বর উপলক্ষে অনেক চ্যানেলে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক প্রচার শুরু হয়েছে। কোন কোন নাটক এখনও প্রচারের অপেক্ষায় রয়েছে। টিভির নাটকের পর আসি চলচ্চিত্রের দিকে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার চার বছর পর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একমাত্র রাষ্ট্রীয় ও সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৭৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের পর ৪০ বছরে ১৩টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। ১৯৭৫ সালে প্রথম চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য পুরস্কার দেয়া শুরু হয়। প্রতি বছর বিজয়ীদের নির্বাচন করে সরকার নিযুক্ত জাতীয় প্যানেল। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদানের প্রথম অনুষ্ঠানিকতা ১৯৭৬ সালের ৪ এপ্রিল সম্পন্ন হয়। এর পরের বছর ১৯৭৬ সালে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘মেঘের অনেক রং’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায়। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন হারুনর রশীদ। রতœা কথাচিত্রের ব্যানারে এটি প্রযোজনা করেছেন আনোয়র আশরাফ ও শাজীদা শামীম। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাথিন, ওমর এলাহী, রওশন আরা, আদনান প্রমুখ। ১৯৭৭ সালে ‘বসুন্ধরা’ চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়। ঔপন্যাসিক আলাউদ্দিন আল আজাদের উপন্যাস ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ কল্যাণ ট্রাস্ট প্রযোজিত ছবিটির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন ববিতা, ইলিয়াস কাঞ্চন, নতুন, সৈয়দ হাসান ইমাম, শর্মিলী আহমেদ প্রমুখ। এটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট ৬টি বিভাগে পুরস্কার অর্জন করে। ১৯৯০ সালে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ‘শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র’ হিসেবে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’ পুরস্কার পায়। ১৯৯২ সালে ‘শঙ্খনীল কারাগার’ চলচ্চিত্রকে শ্রেষ্ঠ কাহিনীর জন্য পুরস্কার দেয়া হয়। এতে শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে পুরস্কার পার নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তার একবছর পর হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করা হয়। এটিই তার পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এতে অভিনয় করেন বিপাশা হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াত, ডলি জহুরসহ অনেকে। বাংলাদেশ সরকারের অনুদানের ছবি আগুনের পরশমণি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। ১৯৯৫ সালে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলা প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। প্রামাণ্যচিত্রটি দক্ষিণ এশিয়া চলচ্চিত্র পুরস্কারে বিশেষ উল্লেখযোগ্য পুরস্কার এবং ২০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ‘শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র’ বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। ১৯৯৭ সালে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ অবলম্বনে নির্মিত ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ চলচ্চিত্রটি ৩টি বিভাগে পুরস্কৃত হয়। এটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। এই ছবিটি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম। ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুচরিতা, সোহেল রানা, অরুণা বিশ্বাস, অন্তরা, ইমরান, দোদুল ও আশিক প্রমুখ। হাঙর নদী গ্রেনেড সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে চাষী নজরুল ইসলাম, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে সুচরিতা এবং শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার হিসেবে সেলিনা হোসেন পুরস্কার অর্জন করেন। ‘বীর সৈনিক’ ২০০৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত যুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। ছবিটি রচনা ও পরিচালনা করেছেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু। এসডি প্রডাকশন্সের ব্যানারে ছবিটি নির্মিত ও পরিবেশিত হয়। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন মান্না, মৌসুমী, সাথী, নাসির খান, হুমায়ুন ফরীদি, রোজী আফসারী প্রমুখ। মান্না এই চলচ্চিত্রে দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। চলচ্চিত্রটি ২৮তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে দুটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। মান্না শ্রেষ্ঠ অভিনেতা এবং সাথী শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্র (অভিনেত্রী) বিভাগে পুরস্কৃত হন। ২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘জয়যাত্রা’ ছবিটি সে বছর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পায়। বিখ্যাত সম্পাদক, কাহিনীকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেনের কাহিনী নিয়ে সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন তৌকির আহমেদ। এটি তার পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিটি প্রযোজনা ও পরিবেশনা করেছে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। ‘জয়যাত্রা’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন একদল মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, মৃত্যু ও বেঁচে থাকার সংগ্রামের গল্প। ছবির বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিপাশা হায়াত, আজিজুল হাকিম, মাহফুজ আহমেদ, হুমায়ুন ফরীদি, তারিক আনাম খান, আবুল হায়াত, মেহবুবা মাহনূর চাঁদনী। ছবিটি শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ২৯তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকারের পুরস্কার লাভ করে। এছাড়া ছবিটি শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার, শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক, শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী ও শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। ‘গেরিলা’ ছবিটি ২০১১ সালে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পুরস্কার লাভ করে। নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত চলচ্চিত্রটি মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করা হয়েছে চলচ্চিত্রটি। এর চিত্রনাট্য করেছেন যৌথভাবে নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও এবাদুর রহমান। গেরিলা ছবিতে অভিনয় করেছেন সহ¯্রাধিক শিল্পী। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান, ফেরদৌস, এটিএম শামসুজ্জামান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শতাব্দী ওয়াদুদ, শম্পা রেজা, গাজী রাকায়েত প্রমুখ। এছাড়াও সিনেমাটি ২০১১ সালে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করে। এমনকি ১৭তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নেটপ্যাক পুরস্কার জিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। ২০১৪ সালে মাসুদ পথিক পরিচালিত ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ প্রাথমিকভাবে পাঁচটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের জন্য ঘোষিত হয়। পরে ‘বৃহন্নলা’ চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে গল্প চুরির অভিযোগ উঠলে নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগেও পুরস্কৃত হয়। অন্য বিভাগগুলো হলোÑ শ্রেষ্ঠ গীতিকার, শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক, শ্রেষ্ঠ সুরকার, শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী, শ্রেষ্ঠ রূপসজ্জাকার। কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ কবিতা অবলম্বনে সিনেমার চিত্রনাট্য লিখেছেন মাসুদ পথিক। সংলাপ লিখেছেন রাজিব আহসান ও মাসুদ পথিক। সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা ও পরিবেশনা করেছে ব্রাত্য চলচ্চিত্র। এতে নামচরিত্রে অভিনয় করেছেন জুয়েল জহুর এবং ফাতেমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন শিমলা। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্রে মামুনুর রশীদ, প্রবীর মিত্র, রানী সরকার, বাদল শহীদ, রেহানা জলি প্রমুখ। এছাড়া অভিনয় করেছেন কবি নির্মলেন্দু গুণসহ পনেরো কবি। চলচ্চিত্রে কাহিনীচিত্রের পাশাপাশি তথ্যচিত্রের আবহকে ধারণ করার চেষ্টা করে প্রেম, প্রকৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের গাথা সূত্রে-তথ্যের ইমেজ ধরে আবহমান বাংলার নিবিড় সংস্কৃতি, জীবনের অন্তর্গত দর্শন তথা জীবনবোধকে তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৫ সালে ‘অনিল বাগচীর একদিন’ ও ‘বাপজানের বায়স্কোপ’ যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। দুটিই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র। ‘অনিল বাগচীর একদিন’ পরিচালনা করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। প্রযোজনা করেছে বেঙ্গল ক্রিয়েশন্স। ছবিতে অনিল বাগচীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন নবাগত অভিনেতা আরেফ সৈয়দ। অন্যান্য চরিত্রে গাজী রাকায়েত, তৌফিক ইমন, জ্যোতিকা জ্যোতি, ফারহানা মিঠু এবং মিশা সওদাগর অভিনয় করেন। মোরশেদুল ইসলাম এরআগে খেলাঘর (২০০৬) এবং আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১) নামে দুটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। অনিল বাগচীর একদিন চলচ্চিত্রের উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয় ২০১৫ সালের অক্টোবরে শ্রীলঙ্কার কলম্বো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। পরে ২০১৫ সালের ১১ ডিসেম্বর ছবিটি মুক্তি পায়। ছবিটি ২০১৫ সালে ২৩ ডিসেম্বর কলকাতায় উপ হাইকমিশনে এবং ২০১৬ সালের ২৮ মে কানাডায় মন্ট্রিলে প্রদর্শিত হয়। ছবিটি ৪০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ও শ্রেষ্ঠ পরিচালক পুরস্কারসহ ছয়টি বিভাগে পুরস্কৃত হয়। এছাড়া ১৮তম মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারে তিনটি মনোনয়নের মধ্যে দুটি বিভাগে পুরস্কৃত হয়। একই বছর রিয়াজুল রিজু পরিচালিত ও প্রযোজিত ‘বাপজানের বায়স্কোপ’ সিনেমাটিও শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। কারুকাজ ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত চলচ্চিত্রটি রিয়াজুল রিজু পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। ছবির কাহিনী লিখেছেন মাসুম রেজা। চিত্রনাট্য লিখেছেন মাসুম রেজা ও রিয়াজুল রিজু। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম, শতাব্দী ওয়াদুদ ও সানজিদা তন্ময়। চলচ্চিত্রটি ২০১৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর মুক্তি পায়। ৪০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ছবিটি যৌথভাবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ আটটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে। সুতরাং বলা যায়, টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক ও প্রেক্ষাগৃহের চলচ্চিত্রগুলো আমাদের দেশপ্রেমকে সমুন্নত রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। আশা করি ভবিষ্যতেও এ যাত্রা অব্যাহত থাকবে। তবে চল্লিশ বছরে মাত্র ১৩টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়ার সংখ্যাটি খুব বেশি বলে মনে হয় না। আমরা চাই, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের সংখ্যা আরও বাড়ুক, সেই সঙ্গে বাড়ুক চলচ্চিত্র পুরস্কারে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের সংখ্যাও। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন পৃথিবী থাকবে, যতদিন মানুষ থাকবে।
×