ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জয় বাংলা

প্রকাশিত: ০৮:৩৭, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

জয় বাংলা

আহমদ ছফা ‘অলাতচক্র’ উপন্যাসে লিখেছেন, ‘কলকাতা শহরের লোকদের মুখে ইদানীং (১৯৭১) জয় বাংলা শব্দটি শুনলে আমার অস্তিত্বটা যেন কুঁকড়ে আসতে চায়। শেয়ালদার মোড়ে মোড়ে সবচে সস্তা, সবচে ঠুনকো স্পঞ্জের স্যান্ডেলের নাম জয় বাংলা স্যান্ডেল। ... যে চোখ ওঠা রোগটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল, কলকাতার মানুষ মমতাবশত তারও নামকরণ করেছিল জয়বাংলা।’ জয় বাংলা একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ লোকজনের কাছে ছিল আবেগ আর আতঙ্কের নাম। একদিকে জয় বাংলার সহায়তায় নিজের সবকিছু নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, অন্যদিকে ‘জয় বাংলার’ মতো চোখের অসুখে বিপর্যস্ত হয়েছিল দৈনন্দিন জীবন। এবড়ৎমবং ঈযরষফং কড়যহ তাঁর গ্রন্থ “ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ ড়ভ চষধমঁব ধহফ চবংঃরষবহপব: ঋৎড়স অহপরবহঃ ঞরসবং ঃড় ঃযব চৎবংবহঃ” গ্রন্থে একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চাশ লাখ লোক চোখ ওঠায় আক্রান্ত বলে উল্লেখ করেন। সমসাময়িক পত্র পত্রিকায় এই সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা পাওয়া যায়। আক্রান্তদের মধ্যে শরণার্থীরা যেমন ছিল তেমনি সংক্রামক এই রোগটি দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল স্থানীয় অধিবাসীরাও। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারী হিসাব মতে প্রায় ৫ লাখ লোক Acute Hemorrhaging Conjunctivitis (AHC)-এর চিকিৎসা সেবা নেন। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি। কলকাতা শহরের শতকরা ৬৫ জন লোক এই রোগে আক্রান্ত হন। এই অঐঈ চোখ ওঠা বা ঈড়হলঁহপঃরারঃরং এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর ভ্যারাইটি। একাত্তরে মে মাস থেকে শুরু করে আগস্ট মাস পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের অনেকাংশে এই সংক্রামক রোগটি ছড়িয়ে পড়ে। মূলত এটি ছিল চোখের কনজাংটিভার প্রদাহ বা চোখ ওঠা। বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের মাধ্যমে এই রোগটি বিস্তার লাভ করেছে দেখে স্থানীয়রা একে ‘জয় বাংলা’ রোগ বলে অভিহিত করেন। একাত্তরে জয় বাংলায় পশ্চিমবঙ্গ কতটা বিপর্যস্ত হয়েছিল ৪ জুন ১৯৭১ এর দৈনিক যুগান্তরের একটি শিরোনামে তা স্পষ্ট। ‘চোখের রোগে ট্রেন বন্ধের আশঙ্কা’ রিপোর্টটিতে বলা হচ্ছে চোখ ওঠায় রেলওয়ের বিপুল সংখ্যক কর্মী আক্রান্ত হয়েছে। পূর্ব রেলের শিয়ালদহ ডিভিশনের ৪৯ জন গার্ড এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ছুটি নিয়েছেন। বহু সংখ্যক বুকিং ক্লার্ক চোখের রোগে আক্রান্ত। সাধারণ ছুটিতে থাকা ২৭ কর্মীর ছুটি বাতিল করেও ট্রেন চলাচল অসম্ভব হয়ে পড়েছে। চোখ ওঠায় বাতিল হয়ে গেছে ফুটবল ম্যাচ। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি স্কুল। পত্রিকার পাতায় পাতায় চোখের রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার বিজ্ঞাপন, কেউবা দিচ্ছে হোমিওপ্যাথিকের বিজ্ঞাপন, কেউবা সালফাসিটল কিংবা তরল সাবানের বিজ্ঞাপন। হাওড়ার ক্ষেত্র ব্যানার্জী লেনের ‘সুরেন্দ্রনাথ সেবা সদন’ সকাল ৭ টা থেকে ১০ টা পর্যন্ত জয় বাংলায় আক্রান্ত রোগীদের হোমিওপ্যাথি ওষুধ বিতরণের বিজ্ঞপ্তি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত প্রতিদিন। আক্রান্ত লোকজনকে একটি শিশিসমেত লাইনে দাঁড়ানোর অনুরোধ করত দোকানটি। বিশাল লাইন লেগে থাকত দোকানে। আবার অনেকেই এই মহামারীতে চেষ্টা করেছেন আনন্দ খোঁজে নেওয়ার। যুগান্তরে বিকাশভানু লিখেছেন রম্য কথন ‘চোখের রোগের টোটকা নিন’। পত্রিকাগুলো ছাপাতে শুরু করল, জয় বাংলা থেকে রেহাই পাওয়ার নানা কৌশল। বিনামূল্যে মেডিকেল ক্যাম্পের আয়োজন করে এই রোগের চিকিৎসা দেয়া হতো। ৬ জুন ১৯৭১ পশ্চিমবঙ্গের সিনিয়র চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. নীহার মুন্সি, ডা. অমল সেন, ডা. আই এস রায়, ডা. প্রকাশ ঘোষ, ডা. জলধর সরকার ও কলকাতা পৌরসভার স্ট্যান্ডিং হেলথ কমিটির চেয়ারম্যান ডা. বীরেন বসু জনসাধারণকে আতঙ্কিত না হয়ে জয় বাংলা রোগে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বিবৃতি দেন। পৌরসভার মেয়র শ্যামসুন্দর গুপ্ত তাদের সঙ্গে বৈঠক করে, জনসাধারণকে কয়েকটি পরামর্শ দেন। যথাÑ ১. নূন জল দিয়ে চোখ পরিষ্কার করুন ২. এই রোগের কোন ঔষুধ নেই। গরম জল দিয়ে চোখ পরিষ্কার করে এতে রেকিউরোক্রোম বা পেনিসিলিন দেয়া যেতে পারে। খুব বেশি যন্ত্রণা হলে সালফা সেটামাইডের ফোঁটা দিলে উপকার পাওয়া যাবে। ৩. পৌরসভার বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রে বিনামূল্যে এসব ঔষুধ পাওয়া যাবে। ৪. অপরিষ্কার হাত দিয়ে চোখ স্পর্শ থেকে বিরত থাকুন। ৫. যাদের গলা ব্যথা তাদের নূন জল দিয়ে গার্গল করতে হবে। আবার কলকাতার হোমিও চিকিৎসকরা জয় বাংলা রোগের বিভিন্ন স্তর ও স্তর অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কি ওষুধ খেতে হবে তা সাধারণকে জানিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। যুগান্তরের রবিবারের সাময়িকী রম্য করে লিখেছেন, ‘জ¦ালা দিতে ঠাঁই নাই জ¦ালা দেয় সতীনের ভাই, কলকাতার লোকের হয়েছে সেই দশা। একেই তো জ¦ালা যন্ত্রণার সীমা নেই, তার ওপরে কোথা থেকে এক চোখের রোগ এসে চেপে বসল। ‘জয় বাংলা জয় বাংলা ডাক ছাড়তে ছাড়তে সারা শহর যেন কটা দিনের জন্য... ধুলি পড়ে একেবারে কলুর... হয়ে গেল।’ সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে কার্টুন। এতসবের মাঝেও কলকাতার সাধারণ মানুষ পাশে দাঁড়িয়েছিল শরণার্থীদের। সংক্রামক জেনেও ক্যাম্পগুলোতে শরণার্থীদের মাঝে সাহায্য, সহায়তা ও ওষুধপত্র নিয়ে সহায়তা করেছে। আনন্দবাজার পত্রিকা ১৩ জুন লিখছে পশ্চিমবঙ্গের এমন কোন বাড়ি নেই, যে বাড়িতে ২/১ জন করে জয় বাংলা রোগে আক্রান্ত হয়নি। বাজারে চোখ ওঠা রোগের ওষুধ ও রঙিন চশমার সঙ্কটের কথা পত্রিকাটি তুলে ধরেন। চোখ ওঠা পশ্চিমবঙ্গে এত বেশি প্রভাব ফেলেছিল একাত্তরে, স্থানীয় গণমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে এসেছিল জয় বাংলার প্রাদুর্ভাবের কথা। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চাশ লাখ লোকের জয় বাংলায় আক্রান্ত হওয়ার সংবাদ ছাপে। বাংলাদেশের সংবাদ সংগ্রহে এসে পশ্চিমবঙ্গে বিদেশী গণমাধ্যমের কয়েকজন কর্মীও আক্রান্ত হয়েছেন চোখের এই প্রদাহে। জনাব কড়যহ তার স¤পাদিত বইটিতে চোখ ওঠা রোগটির সংক্রমণের যে দিক নির্দেশ করেছেন তাতে বাংলাদেশ থেকে একটি তীর পশ্চিমবঙ্গের দিকে নির্দেশ করেছেন। তিনি বইটিতে আরও উল্লেখ করেছেন এটি ধারণা করা হয় যে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া শরণার্থীদের মাধ্যমে এই রোগ কলকাতায় সংক্রমিত হয়। সত্য যাই হোক। রোগটির নামকরণ তেমনটিই বলছে। লোকের কাছে চোখের এই প্রদাহের স্থায়ী নাম পায় ‘জয় বাংলা’ রোগ। চোখ ওঠা অর্থাৎ চোখের পর্দা কনজাংটিভার প্রদাহকে পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা এখনও জয়বাংলা বলে। তবে রোগটির নাম জয় বাংলা হলেও অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, যদি জয় বাংলার লোকেরা এই রোগটি ছড়ায়ে থাকে তাহলে মুম্বাইয়ে কেন প্রথম সংক্রমণ ঘটল এবং মুম্বাই থেকে অন্যান্য অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়ল কিভাবে? তাছাড়া বাংলাদেশ (জয় বাংলা)-এর শরণার্থীর মাধ্যমে রোগটি যদি ছড়িয়ে থাকে তবে কেন বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে চোখওঠা রোগ ছড়াল না? বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীরা পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তর তিনদিকেই আশ্রয় নিয়েছিল। তবে জয় বাংলা রোগের উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও এটা স্পষ্ট করে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গে একাত্তরে জয় বাংলা রোগের যে ব্যাপক বিস্তৃতি, সেটা ঘটেছে শরণার্থী ক্যাম্পের অস্বাস্থ্যকর ঘিঞ্জি পরিবেশ থেকে। আহরার হোসেনের একটি ব্লগে তিনি এই রোগে পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি অবরুদ্ধ বাংলাদেশেও ব্যাপক বিস্তৃতির কথা বলেছেন। ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে কনজাংটিভাইটিস বা চোখ ওঠা রোগ মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়ে। এই রোগে মুক্তিযোদ্ধারা ভুগেছেন, ভুগেছে পাকিস্তানী সৈন্যরা। পাকি বাহিনীর ভোগান্তিটা একটু বেশি ছিল, কারণ তারা এই রোগের সঙ্গে পরিচিত ছিল না। অনাকাক্সিক্ষত এই মহামারী কোন কোন ক্ষেত্রে ট্যাকটিকালি গেরিলা যোদ্ধাদের কিছুটা সুবিধা এনে দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা চোখ ওঠা রোগকে মজা করে বলতেন জয় বাংলা রোগ। উ.উ চৎধসধহরশ তার গবেষণা নিবন্ধ ঔড়ু ইধহমষধ : অহ বঢ়রফবসরপ ড়ভ পড়হলঁহপঃরারঃরং রহ ওহফরধ তে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন পশ্চিবঙ্গের জনজীবন একাত্তরে সামান্য এই চোখের প্রদাহে কিভাবে আলোড়িত হয়েছিল। রোগটির ব্যাপক বিস্তৃতির জন্য শরণার্থীদের ভূমিকা, ক্যাম্পের জীবন তিনি তুলে ধরেছেন। এই রোগ কল্যাণী, চাপড়ার বড় আন্দুলিয়া, বেতাই, করিমপুর, শিকারপুর শরণার্থী শিবিরে ছড়িয়ে পড়ে। একসময় এটি আক্রান্ত করে কলকাতা শহরের শিবিরগুলোতে।
×