ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল মালেক

বিড়াল কি উহাদের চক্ষে...

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮

বিড়াল কি উহাদের চক্ষে...

‘নির্বাচন যখন দোরগোড়ায় আর বিএনপি জোট ফ্রন্টের জবরদস্ত সেনাপতি কামাল সাহেব গলায় রক্ত উঠিয়ে বলে চলেছেন ‘যারা লোভ-লালসা নিয়ে লুটপাট করছে তাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করবোই’। কিন্তু এমন সময়েও দেশবাসীর চোখের ওপর ম্যাঁও আওয়াজ দিয়ে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল বিএনপির ঝুলিতে অতি সঙ্গোপনে লুকিয়ে রাখা আরেক নতুন কালো বেড়াল। হোক না কালো বেড়াল- তারপরও কতদিন আর মুখ লুকিয়ে থাকবে তাদের থলির অন্ধকারে? দেখে-শুনে মনে হচ্ছে তাদের থলিতে আরও কত যে বেড়াল মানুষের নজরের আড়ালে মুখগুঁজে আছে সর্বজ্ঞ আল্লাহতায়ালাই সেটা জানেন। এমতাবস্থায় আমার কানে কেন যেন বারবার বেজে যাচ্ছে একদা সংবাদপত্রে পাঠ করা এক সরস উক্তি- ‘বিড়াল কি উহাদের চক্ষে পেচ্ছাব করিয়াছে?’ বাংলাদেশের স্বনামখ্যাত সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া একবার সক্রোধে এই উক্তিটি পাকিস্তানী শাসকদের উদ্দেশে করেছিলেন অনেককাল আগে। আমেরিকার এফবিআই-এর বরাতে এক সংবাদ সংস্থার খবরে কদিন আগে হঠাৎ জানা গেল মওদুদ আহমদ যিনি ছিলেন খালেদা জিয়ার ক্যাবিনেটে আইনমন্ত্রী তিনি সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত নাইকো রিসোর্সের বেতনভোগী ব্যক্তি হিসেবে বর্তমান। একটি কানাডিয়ান কোম্পানিকে মন্ত্রী হিসেবে কন্ট্রাক্ট পাইয়ে দেয়ার পক্ষে ঘুষদাতা হিসেবে তিনি কাজ করেছেন। ডেবোরা লা গ্রিফিত নামে একজন এফবিআই এক্সপার্ট তদন্ত কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে একথা জানিয়েছেন। গত ১১ ডিসেম্বর বিডি নিউজ ২৪ ডট কম প্রকাশিত এতদসংক্রান্ত এক খবরে বলা হয়েছে যে, ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ঘুষের অর্থে মন্ত্রীর স্ত্রী হাসনা মওদুদের নামে আমেরিকায় বাড়ি ক্রয় করার তথ্য প্রকাশ করেছেন তিনি। সেখানে বলা হয়েছে, ওই সময় মওদুদ সাহেবের বার্ষিক বেতন ছিল মাত্র ৯,৫০০ ডলার। এফবিআই-এর প্রতিনিধি ডেবোরা গ্রিফিত তদানীন্তন মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের নামসহ আরও ক্ষমতাধরদের নামের সঙ্গে বলেন, ‘প্রমাণ সাপেক্ষে বলা যায় নাইকো প্রদত্ত যাবতীয় ঘুষের লেনদেনের আল্টিমেট বেনিফিট পেয়েছেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া’। ইতোপূর্বে কয়েক বছর আগে আরেক থলের বেড়ালের ঝাঁপ দেয়ার কথা অনেকেরই জানা আছে। সিমেন্স নামে একটি মোবাইল ফোন কোম্পানিকে ৪০.৯ মিলিয়ন ডলারের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র কোকো এবং তার সহযোগীদের ৫.৩ মিলিয়ন ডলার ঘুষ দেয়ার সেই ঘটনা। প্রথম আলো পত্রিকায় পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত একটি খবরে দেখা গিয়েছিল, খালেদা জিয়ার পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর প্রায় ১২ কোটি টাকা জব্দ করেছিল সিঙ্গাপুরের আদালত। খুব বেশি দূরের নয় ১/১১-এর পরবর্তী হাসিনা সরকারের আমলে আমেরিকার এফবিআই তদন্ত করে খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় পুত্র কোকোর পাচার করা অর্থ তার বেঁচে থাকাকালীন বাংলাদেশকে ফিরিয়ে এনে দিয়েছিল। এতে আর আশ্চর্যের কি আছে? খালেদা জিয়া ’৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরপর সেই শুরু থেকেই তো টাকা বানানোর নানা পথ খুলে দিয়েছিলেন পুত্রদের জন্য। কোকো-১, কোকো-২ ইত্যাদি ইত্যাদি জাহাজ তো স্বনামে সদম্ভে চলত দক্ষিণাঞ্চলের নদীতে। তাদের মালিক বানিয়ে আরও কত সব ব্যবসা হয়েছিল সে কথা মনে না করতে চাইলে চলবে কেন? ক্ষমতাবান প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও ভাইয়ের মালিকানায় ডান্ডি নামের মিল এসবও লুকোনো-ছাপানো কিছু ছিল কি? অর্থ পাচারকারী হিসেবেই শুধু নয়, দেশে-বিদেশে সন্ত্রাসী দল হিসেবে বিএনপি-জামায়াতের চেহারা দুনিয়াজোড়াই উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে। ওয়াশিংটনে এক আলোচনা সভায় মার্কিন কংগ্রেসম্যান জিম ব্যাঙ্কস মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য হুমকি হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত (কালের কণ্ঠ ১৫ ডিসেম্বর ২০১৮)। তিনি সম্প্রতি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ও তদীয় ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির সম্পর্কে মার্কিন কংগ্রেসে তার একটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এরা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। এতে বলা হয়, ২০১৩ সালের নবেম্বর থেকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৯৫টি হিন্দুবাড়ি ধ্বংস, ৫৮৫টি দোকানে হামলা ও লুটপাট এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় ভাঙচুর ইত্যাদি ঘটনায় জামায়াত-শিবির জড়িত। এই প্রস্তাবে পরিশেষে আরও বলা হয়েছে যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যে ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু, কোটি মানুষের উদ্বাস্তু অবস্থায় দেশ ত্যাগ ও দুই লাখ নারীর ধর্ষিত হওয়ার ঘটনাগুলোর অধিকাংশ কারণ হিসেবে এই দলের উগ্রবাদীরা চিহ্নিত হয়েছে। কানাডার ফেডারেল কোর্ট চলতি বছরেই পুনর্বার ব্যক্ত করেছে বিএনপি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। মোহাম্মদ মোস্তফা নামে একজন বিএনপি এক্টিভিস্ট ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করে কানাডা কোর্টে রিফিউজি হিসেবে আশ্রয় প্রার্থনা করেন দাবি করেন। কিন্তু ফেডারেল কোর্ট তার এই প্রার্থনাকে সাসপেন্ড এবং পরবর্তী সময় ডিসমিস করে তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর হুকুম জারি করে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে কানাডিয়ান সরকারের পাবলিক সেফটি এ্যান্ড ইমার্জেন্সি প্রিপায়ারডনেস বিভাগ বলেছে, মোহাম্মদ মোস্তফা নামের এই ব্যক্তিটি যথার্থভাবেই বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির একজন সদস্য। আর এই বিএনপি নামের দলটি তাদের দেশের সন্ত্রাসী কর্মকা- এবং নাশকতামূলক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। ইতোপূর্বে গত বছরে কানাডার আর এক খবরে জানা গিয়েছিল, বিএনপি দলীয় জুয়েল হাসান গাজী নামে এক ব্যক্তির স্থায়ী রেসিডেন্সের আবেদনের প্রেক্ষিতে ফেডারেল কোর্ট জাজ হেনরি এস ব্রাউন তার আবেদন ডিসমিস করে দেন। মে মাসে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তার সিদ্ধান্তে বলা হয় যে, গাজী বিশ্বাসযোগ্যভাবেই বিএনপি নামের এক সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। তাই নিরাপত্তার স্বার্থেই তাকে কানাডায় আশ্রয় দেয়া যায় না। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালীন প্রকাশ্যেই মানুষ বলত হাওয়া ভবনের অন্তহীন দুর্নীতির কথা। লোকে বলত দৈনন্দিন ওই স্থানে জমা হওয়া নগদ অর্থ গোনাগুনতি করা সম্ভব না হওয়ায় সেখানে ওজন করে টাকা নেয়া হতো। বিদ্যুত উৎপাদনের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে যত্রতত্র ফেলে রাখা হয়েছিল শুধু খুঁটি। বিদ্যুত নিয়ে সেখানে ব্যবসা করা হয়েছিল, কিন্তু বৈদ্যুতিক সংযোগের বিষয়টি ছিল বাদ। কিছুদিন আগে বিদ্যুত বিভাগের একটি দল অভিযোগ করলেন সেই যথা স্থানটিতে চাহিদামতো ভেট দিতে না পারার জন্য দেশে বিদ্যুতের সংযোজন দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সবাই জানেন বিএনপির দুর্নীতির ঘটনাগুলো উন্মুক্ত হয়ে এসেছিল ১/১১র শাসন আমলে। ড. কামাল, ড. ইউনূসের মদদপুষ্ট আর্মি ব্যাকড সরকারের সেই আমলে নানা দুর্নীতি ও অপকর্মের কারণে দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত সেই তারেক রহমান ক্ষমা চেয়ে নাকে ক্ষত দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যান। বর্তমান অর্থ পাচার ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় সেই তারেককে আদালত যাবজ্জীবন বছর কারাদন্ড দিয়েছে। খালেদা জিয়া এক এতিমখানার অর্থ আত্মসাতসহ দুটি দুর্নীতি মামলায় ১৭ বছরের কারাদন্ড হওয়ায় বর্তমানে তার জন্য স্থাপিত বিশেষ জেলখানায় রয়েছেন। এতিমের টাকা আত্মসাতের মামলাও ১/১১র সরকারের দায়ের করা। ক্ষমতায় যাওয়ার পর তো বটেই, আগেও কি বেগম জিয়া কম লোভ-লালসার পরিচয় দিয়েছেন? এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় থাকাকালীন বেগম জিয়াকে সেনাবাহিনী প্রধানের বাসস্থানটি ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে তাকে গুলশানের বিলাসবহুল বাসভবন মাত্র এক টাকার বিনিময়ে দান করেন। তিনি বিনা দ্বিধায় সেটি গ্রহণ করেও ক্যান্টনমেন্টের সেনাপ্রধানের বাড়িটি ছেড়ে না দিয়ে তাতে বসবাস অব্যাহত রাখেন। এমনকি যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী এরশাদ সাহেবের মাধ্যমে পাওয়া বাড়িটি তিনি ভাড়া দিয়ে রেখে দিলেন। সে সময় জেনারেল জিয়ার বিধবা স্ত্রী হিসেবে তিনি তার রাজ্যপাটি চালানোর জন্য এরশাদ সরকারের নিত্যনৈমিত্তিক ভাতা গ্রহণ করতেন। স্বাভাবিক স্মৃতিশক্তি যাদের তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কালো টাকা সাদা করার কথা। বস্তুত, খালেদা জিয়া, তার পুত্রদ্বয় ও ভ্রাতা এবং তার মন্ত্রিসভা ও দলের সদস্যরা আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল, যা পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে দেশ ও বিদেশের তদন্তে। এমনকি দশ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থেকেও বিএনপি-জামায়াত জোটের আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী বহু শীর্ষ নেতার মনোনয়ন আটকে গিয়েছিল ঋণ খেলাপীর দায়ে। এর ফলে জানা গিয়েছিল তাদের প্রাক্তন মন্ত্রী মোর্শেদ খানের ক্ষমতায় থাকাকালীন নিয়েছিলেন এক হাজার তিন শ’ কোটি টাকা। পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা, দেশের মোবাইল ফোনের একমাত্র ব্যবসাদার হিসেবে একেকটি মোবাইল সেট লক্ষাধিক টাকায় বিক্রি করে অঢেল অর্থ বানিয়েছিলেন। কিন্তু ’৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর তার মনোপলি ভেঙ্গে অর্থবিত্ত ও আভিজাত্যের প্রতীক মোবাইল চলে গেল রিক্সাওয়ালা, ডিমওয়ালা ও শ্রমিক-মজুরের হাতে। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর নয় শ’ পঞ্চাশ কোটি টাকা ঋণ খেলাপী রয়েছে সাতাশটি ব্যাংকে। সম্ভবত বর্তমান বাজারে উক্ত অর্থ পর্যাপ্ত মনে না হওয়াতে এই বোঝা কাঁধে রেখেই আবার নির্বাচন করার সাধ হয়েছে। এদের বাইরে কত যে ছুপা রুস্তম রয়েছেন কে তার হিসেবে রাখে! তাদের সর্দার এ সিলসিলা কামাল হোসেন বারবার বলে চলেছেন অন্যতম এক মজার কথা- এবার জনগণ নাকি তাদের মালিকানা ফেরত পাবে। যারা পাবে তারা কি জনগণ? দলের সদস্যদের জানা না জানা এরকম আরও কত সম্পদের মালিকানায় কি তিনি তৃপ্ত নন? এর পরিপ্রেক্ষিতে আবার যদি স্মরণ করি মানিক মিয়ার স্মরণীয় উক্তি ‘বিড়াল কি উহাদের চক্ষে পেচ্ছাব করিয়াছে।’ তবে কি কেউ দোষ নেবেন? লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×