ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমজাদ হোসেনকে নিয়ে চলচ্চিত্রকর্মীদের শোক

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮

আমজাদ হোসেনকে নিয়ে চলচ্চিত্রকর্মীদের শোক

গৌতম পান্ডে ॥ ‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো’, ‘আমি আছি থাকব ভালবেসে মরব’, ‘হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ’, ‘কেউ কোনো দিন আমারে তো কথা দিলো না’ এমন অনেক গান চলচ্চিত্রপ্রেমীদের অন্তরে এখনও থেকে থেকে স্পন্দন তোলে। যার গীতিকার আমজাদ হোসেন। কিংবদন্তিতুল্য চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী ও লেখক আমজাদ হোসেন আজ আমাদের মাঝে নেই। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে শুক্রবার বাংলাদেশ সময় বেলা ২-৫৭ মিনিটে ব্যাঙ্ককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে তিনি সবাইকে ছেড়ে চলে যান না ফেরার দেশে। তার মৃত্যুতে চলচ্চিত্র অঙ্গনসহ পুরো সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। বরেণ্য এই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কথা বলেছেন তার সহকর্মীরা। চিত্রনায়িকা ববিতা : চিত্রনায়িকা ববিতা বলেন, আমি আমজাদ ভাইয়ের একাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি এবং সেগুলো ব্যবসাসফলও হয়েছে। ওনার চলচ্চিত্রের মতো ব্যবসাসফল এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র কম নির্মাতাদের ক্ষেত্রে ঘটেছে। সবচেয়ে বড় গুণ ছিল উনি সবার সঙ্গে ছিলেন আন্তরিক। আমি অনেক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি কিন্তু জহির ভাইয়ের পরে ওনাকে প্রাধান্য দিতেই হবে। আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনে ওনার মতো আর কোন ব্যক্তিত্ব আসবে কিনা আমার জানা নাই। ওনার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। চিত্রনায়ক ফারুক : এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমার চলচ্চিত্রে কাজ শুরু হলেও আমজাদ হোসেনের সঙ্গে অনেক ভাল একটা সম্পর্ক হয় ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রে কাজ করার সময়। আলমগীর পিকচার্সের এ চলচ্চিত্রটি ছিল সুপারহিট। এরপর উনার পরিচালনায় এবং আমার অভিনীত ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রটিও খুব ভাল ব্যবসা করেছিল। শুধু একজন গুণী নির্মাতা নন, বড় ভাল মনের মানুষ ছিলেন আমজাদ হোসেন। তার মৃত্যুর সংবাদ মেনে নিতে পারছি না। তিনি ছিলেন এক কথায় অলরাউন্ডার একজন মানুষ। তার পরিচালনা, চিত্রনাট্য লেখার হাত, অভিনয় সবকিছুই ছিল দুর্দান্ত। তার অভাব পূরণ হওয়ার না। চিত্রনায়ক আলমগীর : আরও একটি দুঃসংবাদ যুক্ত হলো আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পে। গুণী একজন মানুষকে হারালাম আমরা। তার পরিচালনায় বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছি আমি। ‘কসাই’, ‘ভাত দে’ ও ‘সখিনার যুদ্ধ’ নামের চলচ্চিত্রগুলো ছিল দর্শকপ্রিয় ও সুপারহিট। অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে আজ। চিত্রনায়িকা সুচন্দা : জহির রায়হানের সহকারী পরিচালক হিসেবে যখন থেকে কাজ শুরু করলেন, ঠিক তখন থেকেই আমি আমজাদ হোসেনকে চিনি। শুধু একজন পরিচালক হিসেবে না, তিনি আমাদের পরিবারের একজন মানুষ ছিলেন। জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে কাজ করার সময় তিনি সহকারী পরিচালক ছিলেন। এরপর তো নিজের পরিচালনায় সব জনপ্রিয় চলচ্চিত্র দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রের সংলাপ রচয়িতা ছিলেন তিনি। অনেক গুণী একজন মানুষকে আমরা হারালাম। চিত্রনায়িকা রোজিনা : খবরটা শুনে খুব খারাপ লেগেছে। তার পরিচালনায় ‘কসাই’ চলচ্চিত্রে কাজ করেছিলাম। ১৯৮০ সালের কথা। সে সময়ই মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরিতে চলচ্চিত্রটি পুরস্কার জিতে নেয়। আমিও এ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছিলাম। অনেক গুণী একজন নির্মাতাকে হারালাম আমরা। চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন : কিছু সংবাদ অনেক কষ্ট দেয়। তার মৃত্যুর সংবাদে আমিও কষ্ট পাচ্ছি। আমজাদ হোসেনের মতো গুণী নির্মাতার সঙ্গে কাজের সুযোগ হয়েছিল আমার। উনার পরিচালনায় ‘হীরামতি’, ‘সুন্দরী’, ‘আদরের সন্তান’ চলচ্চিত্রে কাজ করেছিলাম। অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। আমরা একজন মেধাবী নির্মাতা ও ভাল মনের মানুষকে হারালাম। চিত্রনায়ক ওমর সানী : আমজাদ হোসেনের মতো প্রকৃত গুণী ব্যক্তিদের মৃত্যু নেই। সৃষ্টিতে চিরদিন বেঁচে থাকবেন তিনি। আজিজুর রহমান : তার চলে যাওয়ায় চলচ্চিত্রে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের ইন্ডাস্ট্রির। অনেক স্মৃতি রয়েছে আমাদের। সবই আজ মনে পড়ছে। আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন এ দোয়া রইলো। চিত্রনায়িকা মৌসুমী : আমজাদ হোসেন নেই- ভাবতেই পারছি না। এমন সংবাদ আর শুনতে চাই না। ধীরে ধীরে ইন্ডাস্ট্রির গুণী মানুষগুলোকে হারাচ্ছি আমরা। তার পরিচালনায় ‘আদরের সন্তান’ ছবিতে আমি ও ইলিয়াস কাঞ্চন ভাই অভিনয় করেছিলাম। তার ‘গোলাপী এখন বিলাতে’ চলচ্চিত্রে কাজ করেছি আমি। অনেক পুরনো কথা মনে পড়ছে আজ। আমজাদ ভাইয়ের মতো মানুষের ইন্ডাস্ট্রিতে খুবই প্রয়োজন ছিল। চিত্রনায়িকা শাবনূর : অনেক বড় মাপের একজন নির্মাতা ছিলেন তিনি। তার যে ক’টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি প্রত্যেকটিই দারুণ হিট হয়েছে। তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। চিত্রনায়ক ফেরদৌস : আমজাদ হোসেন পরিচালিত মোট তিনটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছি। এগুলো হচ্ছে ‘কাল সকালে’, ‘প্রাণের মানুষ’ ও ‘গোলাপী এখন বিলাতে’। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ‘কাল সকালে’ চলচ্চিত্রে কাজ করার সময়ের কথা মনে পড়ছে আজ। তার পরিচালনায় এ চলচ্চিত্রে কাজের সুযোগ হয়েছে আমার ও শাবনূরের। গুণী একজন নির্মাতাকে হারালাম আমরা। চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস : আমজাদ আঙ্কেল নেই- ভাবতে পারছি না। তার হাত ধরেই চলচ্চিত্রে কাজ শুরু আমার। ২০০৪ সালে তার পরিচালনায় ‘কাল সকালে’ চলচ্চিত্রে প্রথম কাজ করি আমি। আমার ক্যারিয়ারে তার অবদান অনেক। তার শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। সোহানুর রহমান সোহান : আমজাদ ভাই আমাদের চলচ্চিত্রের অভিভাবক ছিলেন। তার চলে যাওয়ায় আমাদের চলচ্চিত্রে বিরাট শূন্যতা তৈরি হলো। তার দীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের উত্থান-পতন সবই তিনি দেখেছেন। চলচ্চিত্রের যে কোন বিষয়ই তার কাছে গেলে জানা যেত, শেখা যেত। আমাদের চলচ্চিত্র বর্তমানে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ঠিক এই সময়ে তার চলে যাওয়াটায় আরও ক্ষতি হয়ে গেল। এখন চলচ্চিত্রের ভাল-মন্দ বলার আর কেউ রইল না। সরকার আলাউদ্দীন আলী : আমজাদ ভাই আর নেই খবরটি শোনার পর কী যে খারাপ লেগেছে, বলা যাবে না। আমার সঙ্গীতজীবনে তার সঙ্গে কতশত স্মৃতি, বলে শেষ করতে পারব না। তার চলচ্চিত্রের জন্য প্রচুর গান করেছি, যেসব গান বাংলাদেশের মানুষের কাছে আজও সমান জনপ্রিয়। একেকটি গান করতে গিয়ে দুজনের কত দিন কত রাত একসঙ্গে কেটেছে, তার হিসাব নেই। আমাদের দুজনকে একসময় চলচ্চিত্র, সঙ্গীতাঙ্গনের মানুষেরা ‘মানিকজোড়’ বলে ডাকতেন। সেই ‘মানিকজোড়’ ভেঙ্গে গেল। কিছুদিন ধরেই একের পর এক প্রিয় মানুষ চলে যাচ্ছেন। আমি নিজেও অসুস্থ। খবরটা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। মুশফিকুর রহমান গুলজার : তিনি একজন বহুমুখী প্রতিভার চলচ্চিত্রকার ছিলেন। তিনি চলচ্চিত্রে গল্প লিখতেন, গান লিখতেন, অভিনয় করতেন, পরিচালনা করতেন। তার চলচ্চিত্র, চলচ্চিত্রের গান এখনও মানুষের মুখে মুখে। বাংলাদেশের গুণধর চলচ্চিত্রকার হিসেবে জহির রায়হান, খান আতাউর রহমানের পরেই তার নামটি বলা যায়। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির পক্ষ থেকে তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
×