ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জয় বাংলার জয়গান ঢাবি মাঠে

লাল-সবুজের দারুণ দোলা, আয়োজনের ভিড়েও অনবদ্য ছায়ানট

প্রকাশিত: ০৫:০১, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮

লাল-সবুজের দারুণ দোলা, আয়োজনের ভিড়েও অনবদ্য ছায়ানট

মোরসালিন মিজান ॥ বিজয় দিবসে কত না আয়োজন! শহর ঢাকার প্রতি প্রান্তে উৎসব অনুষ্ঠান। এত কিছুর মাঝেও ঠিক আলাদা করা গেল ছায়ানটকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছিল। গত তিন বছরের ধারাবাহিকতা। রবিবার ছিল চতুর্থ আয়োজন। শুদ্ধ পরিপাটি ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান। গান নাচ কবিতার ভাষায় আজকের হাসি আনন্দকে যেমন ফুটিয়ে তুলে ধরা হয়, তেমনি গ্রন্থিত করা হয় একাত্তরের বেদনাগুলোকে। প্রাণপণ লড়াই করা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পাওয়া দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার, সকল মানুষকে ভালবাসার আহ্বান জানানো হয় লাল সবুজের মঞ্চ থেকে। মাঠের মতো গ্যালারিতেও তখন শত শত দর্শক। সকলেই অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। হ্যাঁ, বরাবরের মতোই লাল সবুজের মঞ্চ। আগে থেকেই ছবিটা চোখে লেগেছিল। এর পরও বিকেলে মাঠে প্রবেশ করতেই অপলক চোখ। বিশাল খোলা মাঠের গ্যালারি সংলগ্ন অংশটি কী যে সুন্দর করে সাজিয়ে নেয়া হয়েছে! মাঝখানে বিশাল মঞ্চ। ভূমি থেকে বেশ কিছুটা উপরের দিকে ওঠে যাওয়া মঞ্চে পতাকার সবুজ। এর চারপাশ ঘিরে বসেছিলেন শিল্পী ও বাদ্যযন্ত্রীরা। সাধারণ দর্শক শ্রোতাও পাশাপাশি বসেছিলেন। সবার সামনে খোলা সবুজ মঞ্চ। আর শিল্পীরা এসেছিলেন লাল পোশাকে সেজে। দু’য়ে মিলে জাতীয় পতাকার রং নয় শুধু, আবেগটাকে তুলে ধরে। মূল আয়োজনের শুরু জাতীয় সঙ্গীতে। সবাই দাঁড়িয়ে একসঙ্গে গেয়ে যান, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ সমবেত সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা ওড়ান ছায়ানটের সহসভাপতি ডাঃ সারওয়ার আলী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান। এর পর কোন আলোচনা নেই। সরাসরি গান নাচ এবং কবিতা। বেশির ভাগই ছিল সম্মেলক গান। পঞ্চকবির কয়েকজনকে বেছে নিয়েছিলেন শিল্পীরা। তাদের গানের সঙ্গে ছিল দলীয় নৃত্য। একক গান কবিতায়ও দেশের কথা। মানুষকে ভালবাসার আহ্বান। প্রথম সম্মেলক গান ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, এই মা মানে দেশমাতা। দেশমাতার টানে এক হওয়ার আহ্বান জানান সঙ্গীত শিল্পীরা। দূর থেকে দেখা না গেলেও, মেঝেতে বসে লাইভ গাইছিলেন তারা। আর মঞ্চে নাচের পরিবেশনা। চমৎকার সংযোগ। ছায়ানটের শিক্ষক শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় অপেক্ষাকৃত নবীনদের নিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখেন। অনুষ্ঠানের জন্য কাজী নজরুল ইসলামের তিনটি গান বেছে নেয়া হয়। ‘চল্ চল্ চল্’ সম্মেলক গানে ঊষার দুয়ারে আঘাত হানার আহ্বান। রাঙা প্রভাত আনার সংকল্প। গানের সঙ্গে যথারীতি ছিল নৃত্যায়োজন। সুকান্ত ভট্টাচার্য থেকে গাওয়া হয়: ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ/কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে...।’ এ গানের কথা ও সুরকে নিখুঁতভাবে অনুসরণ করেন ছায়ানটের নৃত্য শিল্পীরা। বিশেষভাবে দোলা দেয় লোকসঙ্গীত। ‘হেঁইয়োঁরে হেঁইয়োঁ’ গানের সঙ্গে নেচে ওঠে যেন গ্যালারি। ‘আমি টাকডুম টাকডুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল...। এই গানেও ফুটে ওঠে বিজয়ের আনন্দ। একক সঙ্গীত বলতে ডালিয়া নওশীন ও সেমন্তি মঞ্জরী। নজরুল থেকে বাংলা মায়ের রূপ বর্ণনা করেন ডালিয়া নওশীন। তার কণ্ঠে ছিল : এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী। /ফুলে ও ফসলে কাদা মাটি জলে ঝলমল করে লাবনি...। সেমন্তি মঞ্জরী বেছে নেন অতুল প্রসাদের গান। সবাইকে ভালবাসতে হবে। ভালবাসার আহ্বান ছিল তার গানে। গানটিÑ সবারে বাস রে ভালো, /নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে। /আছে তোর যাহা ভালো /ফুলের মতো দে সবারে। /নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে...। বিশাল মঞ্চে একক পরিবেশনা। কিছুটা ফাঁকা লাগে বটে। তবে শিল্পীর পরিবেশনার সৌন্দর্যে তা আর মনে থাকে না। ইংরেজী নববর্ষ সামনে। আর মাত্র কয়েকদিন পর বিদায় নেবে ২০১৮ সাল। হয়ত তাই পুরনোকে বিদায় জানানো হয় ছায়ানটের মঞ্চ থেকে। সম্মেলক কণ্ঠে গাওয়া হয়Ñ ‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো। /একলা রাতের অন্ধকারে আমি চাই পথের আলো।’ শেষ গানে একাত্তরের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। তারিক সুজাতের কবিতা থেকেও বর্ণনা করা হয় যুদ্ধদিনের ইতিহাস। কবিতার সঙ্গে কোরিওগ্রাফি। এই মঞ্চের নতুন আয়োজন বলা চলে। বেশ উপভোগ করেন সবাই। এসবের বাইরে অনুষ্ঠানে নিয়মিতভাবেই দেয়া হয় ‘জয় বাংলা স্লোগান।’ গগনবিদারী স্লোগানে অদ্ভুত এক উত্তেজনা। গায়ে কেমন যেন শিহরণ জাগিয়ে যায়। অনুষ্ঠান শেষ করা হয় জাতীয় সঙ্গীতে। আমার সোনার বাংলা বলে শুরু। আমার সোনার বাংলা বলে শেষ। আহা, কী দারুণ। কী যে উপভোগ্য একটা আয়োজন! সত্যি মনে রাখার মতো।
×